রেনম্যান-এর ডাস্টিন হফম্যানকে মনে পড়ে? আত্মনিমগ্ন অলৌকিক স্মৃতিধর একটা লোক, সারাক্ষণ নানা রকম কঠিন খেলা নিজের সঙ্গেই খেলে চলেছে। নিজের কাজে আর নিজেতে এতটাই নিমগ্ন যে, বাকি দুনিয়ায় কী হচ্ছে না হচ্ছে তার খেয়ালই নেই। এমনকী কেউ তার সঙ্গে কথা বলছে কি না, কেউ তার কুশল জিজ্ঞেস করছে কি না, সে দিকেও কোনও হুঁশ নেই। সে কারও দিকে তাকায় না, কারও কথার উত্তর দেয় না, অথচ ক্ষুরধার বুদ্ধি, অঙ্ক যত কঠিন, যত জটিল, সমাধানে তার তত উৎসাহ।
শুধু আত্মনিমগ্ন বললে কিন্তু ব্যাপারটার ঠিক ব্যাখ্যা হয় না। সিনেমা ছেড়ে বাস্তবে এলে বলতেই হবে, এটা এক ধরনের সমস্যা। বড় অর্থে যাকে বলা চলে পারভেসিভ ডেভেলপমেন্ট ডিসঅর্ডার বা বড় হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সামগ্রিক গোলযোগ। এ সমস্যা যাদের থাকে, তারা অনেকেই হয়তো কোনও একটা বিশেষ কাজে খুব মনোযোগী বা দক্ষ হয়, কিন্তু তাই বলে সমস্যাটাকে অস্বীকার করার কোনও যুক্তি নেই। তা ছাড়া, তারা যথাযথ সুযোগ ও পরিচর্যা না পেলে ওই বিশেষ দক্ষতাও অর্জন করতে পারে না, তাই সে দিক থেকেও সমস্যাটা বোঝা এবং ঠিক ভাবে তার মোকাবিলা করা জরুরি। এই গোলযোগের চরিত্র নানা ধরনের হয়ে থাকে। আপাতত তার একটা ধরন নিয়ে আলোচনা করব। সেটা হল অটিজ্ম। এই সমস্যাটির উপর জোর দেওয়ার কারণ, প্রথমত, এটি বেশ বড় আকারের সমস্যা: এ দেশে আনুমানিক কুড়ি লাখ মানুষ এর শিকার; এবং দ্বিতীয়ত, একেবারে ছোটবেলা থেকে সন্তানের দিকে নজর রাখলে এই সমস্যাটিকে শুরুতেই ধরে ফেলা সম্ভব এবং তার মোকাবিলা সম্ভব।
প্রথমেই দুটি কথা বলা দরকার। এক, অটিজ্ম কোনও একটা বিশেষ রোগ নয়। এর নানা ধরন, নানা মাত্রা, একটা দৃষ্টান্ত থেকে আর একটায় অনেক তারতম্য। দুই,এটা জিনগত সমস্যা কি না, সেটা মনটা এখনও প্রমাণিত হয়নি। হয়তো কোনও একটা বা দু’টো জিনের প্রভাব থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু এখনও নিশ্চিত করে তা বলা যাচ্ছে না।
একটি শিশুর অটিজ্ম-এর সমস্যা আছে কি না, সেটা সাধারণত দু’বছর বা তিন বছরের মধ্যেই ধরা পড়ে। কী ধরনের লক্ষণ দেখা যায় অটিজ্ম-এ আক্রান্তদের আচরণে? সঙ্গের তালিকাটি এ বিষয়ে সাহায্য করবে। মনে রাখতে হবে, এই তালিকায় যে বিভিন্ন ধরনের গোলযোগের কথা বলা হয়েছে, তার অন্তত কয়েকটি দেখা গেলে অটিজ্ম-এর আশঙ্কা আছে, কোনও একটা লক্ষণ মিলে গেলেই ভয় পেয়ে যাওয়ার কারণ নেই। আবার একই সঙ্গে এটাও বলা দরকার, অটিজ্ম-এর প্রাথমিক লক্ষণগুলো যে খুব সাংঘাতিক কিছু, তা কিন্তু নয়। হয়তো বাচ্চা দেরিতে কথা বলা শুরু করল, হয়তো সে নতুন জায়গায় গেলেই প্রচণ্ড কাঁদতে থাকে, হয়তো অন্য কারও দিকে তাকায় না। বাবা-মা ভাবেন, এ সব বড় হওয়ার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। বস্তুত, বেশির ভাগ স্বাভাবিক বাচ্চার মধ্যেই হয়তো এর একটা বা দুটো লক্ষণ থাকে। কিন্তু যাদের অল্প মাত্রায় অটিজ্ম থাকে, তাদের মধ্যে এগুলোই প্রধান লক্ষণ। সে জন্যই নজর রাখা জরুরি। সাবধানের মার নেই। যেমন ধরা যাক, যে বাচ্চা স্তন্যপানের সময় মায়ের দিকে তাকায় না, তার প্রতি একটু বিশেষ নজর রাখতে হবে, কারণ তার এই সমস্যা দেখা দিতেই পারে।
আর যাদের মধ্যে এই অসুখের মাত্রা অনেক বেশি আকারে থাকে, তাদের সাধারণত কথা বলতে অনেক দেরি হয়, কথা কিছুটা জড়ানো থাকে, অনেক বড় বয়স অবধি নাল পড়ার প্রবণতা থাকে, ক্রমাগত দুলে যাওয়ার স্বভাব তৈরি হয়, এক কথা বার বার বলার প্রবণতা থাকে, অন্যের কথা কিছুতেই শুনতে চায় না, অন্যের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে চায় না, আমরা যাকে বলি ইন্টারঅ্যাকশন, সেটাতে কিছুতেই যেতে চায় না। নিজের একটা জগত্, একটা দুনিয়া বানিয়ে নেয়, সেখানেই থাকতে চায়। এই লক্ষণগুলোর দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
এবং সে জন্য মা-বাবাকে প্রথম মানতে হবে যে, শিশুর এই সমস্যাটা আছে বা থাকতে পারে। তা না হলে কিন্তু শিশুর উন্নতি সম্ভব নয়। তাই অভিভাবকদের বলব, একদম শিশুকাল থেকেই আচরণের প্রতি নজর রাখুন, যদি বয়স অনুযায়ী কোনও অস্বাভাবিকতা নজর করেন, তা হলে সেটা উড়িয়ে না দিয়ে ডাক্তারকে সে কথা জানান। তিনি আপনাকে বুঝতে সাহায্য করতে পারবেন, সত্যিই ভাবনার কোনও কারণ আছে কি না।
শুনে অনেকেই বলতে পারেন, খামখা ভয় দেখাচ্ছেন কেন? সব বাচ্চার প্রতিই যদি এমন নজর দিতে হয় তখন ডাক্তাররাই তো বলবেন, অবসেসড পেরেন্টস। ঠিক কথা। হয়তো অনেককেই এ কথা শুনতে হবে। হয়তো অনেককেই শুধু শুধু কিছুটা চিন্তার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। কিন্তু যে বাচ্চাটি অটিজ্ম আক্রান্ত, সে অনেক তাড়াতাড়ি চিকিৎসা আর কাউন্সেলিং-এর সুযোগ পাবে, সমস্যা জটিল হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটা কমানো যাবে। আমার বক্তব্য হল, সমস্যাটাকে অবহেলা করবেন না।
অনেক সময় বাড়ির বয়স্করা বলেন, ওর বাবা কিংবা মা অনেক বড় বয়সে কথা বলেছিল, অনেক পরে হেঁটেছিল। হয়তো ঠিক, কিন্তু স্মৃতির ওপর এতটা ভরসা করা যায় কি? পঁচিশ, তিরিশ, পঁয়ত্রিশ বছর আগে বাবা বা মা প্রথম কোন বয়সে হেঁটেছিলেন, এটা কি কারও পক্ষে মনে রাখা সম্ভব? যদি না সেই ঘটনা কারও মনে কোনও ভাবে দাগ কেটে যায়? হয়তো সেই সময়ের কাছাকাছি কোনও অ্যাসোসিয়েশন থাকতে পারে, কিন্তু তার ওপর ভরসা করে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকাটা খুব কাজের কাজ হবে না।
সুতরাং, প্রথম কাজ হচ্ছে অটিজ্ম আছে কি না সেটা সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া। দুই, ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা এবং কাউন্সেলিং। প্রথম কাউন্সেলিংটা কিন্তু মা-বাবাকেই করতে হবে। মা-বাবাদের জন্যে কাউন্সেলিং কোর্সও আছে। আগে নিজে জেনে নিন পুরো ব্যাপারটা, তা হলে আপনি সবচেয়ে ভাল সাহায্য করতে পারবেন আপনার সন্তানকে। বাচ্চাকে নিয়ে অনেক বেশি করে বেরিয়ে পড়ুন, লোকজনের মাঝখানে নিয়ে যান। যত পারেন বাচ্চার সঙ্গে কথা বলুন। অটিজ্ম-এর নানান ধরন এবং নানান মাত্রা হয় বলেই তার মোকাবিলাও কিন্তু নানা রকমের হতে পারে। এমন অনেক শিশু আছে, যারা সাধারণ স্কুলে, সাধারণ শিশুদের সঙ্গেই পড়াশোনা করে। কেবল তাদের প্রতি হয়তো একটু বেশি মনোযোগ দিতে হয়। প্রথম দিকে যদি সমস্যাটা ধরে ফেলা যায়, তা হলে এই সব শিশুও অনেকটা সাধারণ জীবনযাপন করতে পারে। কারও অটিজ্ম থাকা মানেই কিন্তু জীবন শেষ হয়ে যাওয়া নয়। চেষ্টা করলে একটা স্বাভাবিক জীবন অনেকটাই দেওয়া যায়।
আর, ধৈর্য দরকার। না হলে কিন্তু আপনার হতাশা বা উদ্বগের প্রভাব শিশুর ওপর পড়বে। এবং জীবনের দৌড়ে সেটা ওকে পিছিয়ে নিয়ে যাবে অনেক বেশি। এটা একটা লড়াই, যেটা সারা জীবন লড়তে হতে পারে। তাই ম্যারাথন দৌড়ের প্রস্তুতি নিন, একশো মিটার নয়। আর যারা ম্যারাথন দৌড়য় তাদের মানসিক দৃঢ়তা কিন্তু অনেক অনেক বেশি। সেই দৃঢ়তা থাকলে আপনিও ঠিক পারবেন আপনার সন্তানকে একটা ভাল জীবন দিতে।
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ; ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেল্থ-এর অধিকর্তা; মতামত ব্যক্তিগত
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy