Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪
স্কুলে পাশ-ফেল ফিরলেও শিক্ষার হাল ফিরবে না

শিক্ষা এবং ছাঁকনি-দর্শন

কথা হচ্ছে শিক্ষার সর্বজনীনতা নিয়ে। সম্প্রতি ভারত সরকারের একটি পদক্ষেপ এ বাবদে উদ্দেশ্য-বিধেয় ঘুলিয়ে দিল ফের এক বার।

অচিন চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৬:০০
Share: Save:

ভারতের এক প্রত্যন্ত রাজ্যে ঠিক দুশো বছর আগে এক কিশোরী রানি উন্নয়নচিন্তায় এক নিঃশব্দ বিপ্লব এনে ফেলেছিলেন। ১৮১৭ সালে ত্রিবাঙ্কুরের (বর্তমান কেরলের দক্ষিণাংশ) রানি পার্বতীবাই তাঁর দেওয়ান পেশকারের কাছে একটি রাজকীয় অনুশাসন পাঠালেন। রানির বয়স তখন পনেরো। দিদির আকস্মিক প্রয়াণে খানিক বাধ্য হয়েই অন্তর্বর্তী কালের জন্যে রাজকার্যের ভার নেন, প্রকৃত উত্তরাধিকারী যেহেতু তখনও শিশু। অনুশাসনে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় লেখা হল ‘জনসাধারণের শিক্ষার জন্যে যাবতীয় ব্যয় রাষ্ট্রকেই করতে হবে, যাতে শিক্ষার আলো প্রসারে কোনও বাধা না থাকে, শিক্ষার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে যাতে তারা আরও ভাল প্রজা ও জনগণের সেবক হয়ে উঠতে পারে, এবং যার ফলে রাষ্ট্রের সুনামও বাড়বে’।

ইতিহাসবিদরা অবশ্য বলেন, এক জন পঞ্চদশী বালিকার পক্ষে এমনটা ভেবে ফেলা খুব স্বাভাবিক নয়; ত্রিবাঙ্কুরের তৎকালীন রেসিডেন্ট জেমস মানরো-র প্রচ্ছন্ন প্রভাব থাকতে পারে এর পিছনে। তবে অনুশাসনটি যারপরনাই বৈপ্লবিক। এটি যেমন শিক্ষার সর্বজনীনতার কথা বলছে, শিক্ষাপ্রসারের কাজটি যে সর্বতো ভাবে রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব, সেটিও জোরালো ভাবে বলছে। সর্বজনীন শিক্ষার সঙ্গে রাষ্ট্রের সুনামের প্রশ্নও জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। দুশো বছর আগে এমন ভাবনা ব্রিটিশ ভারতের কোথাও দেখা যায়নি। ভারতের মতো একটি উপনিবেশে শিক্ষাকে সর্বজনীন করতে হবে ভেবে ইংরেজ শাসকরা মাথা ঘামাবেনই বা কেন? এই নয় যে তাঁরা শিক্ষা নিয়ে একেবারে ভাবেননি, কিন্তু অনুগত রাজকর্মচারী বানানোর লক্ষ্যে শিক্ষা আর সর্বজনীন শিক্ষা এক নয়, তাদের দর্শনও আলাদা।

কথা হচ্ছে শিক্ষার সর্বজনীনতা নিয়ে। সম্প্রতি ভারত সরকারের একটি পদক্ষেপ এ বাবদে উদ্দেশ্য-বিধেয় ঘুলিয়ে দিল ফের এক বার। শিক্ষার অধিকার আইনের আট বছর যেতে না যেতেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা এই আইনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধারাটি সংশোধনের জন্যে বিল-এ সিলমোহর দিয়ে দিল। সংশোধনীতে বলা হয়েছে, রাজ্য সরকার চাইলে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে ‘ফেল’ করা ছাত্রছাত্রীদের আটকে দিতে পারে। শিক্ষার অধিকার আইন ২০০৯ অনুসারে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত একই শ্রেণিতে একাধিক বছর রেখে দেওয়া সম্ভব ছিল না। আইনের এই ধারাটিই ছিল সবচেয়ে বৈপ্লবিক। বুনিয়াদি শিক্ষা বিষয়ে যাঁরা বিশেষজ্ঞ, তাঁদের মধ্যে এ নিয়ে বিশেষ দ্বিমতও ছিল না। অথচ, বাচ্চারা স্কুলে যাচ্ছে কিন্তু শিখছে না, বিশেষত সরকারি বিদ্যালয়গুলিতে, এই ধারণাটি যত বদ্ধমূল হতে থাকল, কোপটা গিয়ে পড়ল ‘নো ডিটেনশন পলিসি’র ওপর। এমনকী পশ্চিমবঙ্গে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দল তো ‘পাশ-ফেল’ ফিরিয়ে আনার দাবিতে ধর্মঘটও ডেকে ফেলেছে একাধিক বার।

স্বাধীন ভারতে রাষ্ট্রের উদ্যোগে সর্বজনীন শিক্ষার প্রসারের ইতিহাসটি তেমন গৌরবোজ্জ্বল নয়। সাম্প্রতিক কালের শিক্ষানীতিতে এক শ্রেণিতে আটকে রাখা নিয়ে এই কিম্ভূত দোলাচলের পাশাপাশি দুশো বছর আগেকার এক পঞ্চদশীর নীতিচিন্তায় যে সুনির্দিষ্ট প্রজ্ঞার ছাপ দেখি, তা অবাক করে। দুঃখের কথা, এ যুগে শিক্ষার সর্বজনীনতার প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এক ধরনের বিবেচনাহীন ছাঁকনি-দর্শন, যা রাষ্ট্র এবং তথাকথিত শিক্ষিত জনকে একই অবস্থানে এনে ফেলে। শিক্ষাব্যবস্থা যেন এক প্রকাণ্ড ছাঁকনি, যা ‘সফল’দের ছেঁকে নেওয়ার জন্যে তৈরি। পিছিয়ে পড়াদের হাত ধরে এগিয়ে নেওয়ার জন্যে নয়। এই ছাঁকনি-দর্শনের প্রবল দাপটে রাষ্ট্রকে এক পা এগিয়ে দু’পা পিছোতে হয়।

সে দিন টেলিভিশনে এক ‘বিশেষজ্ঞ’কে বলতে শুনলাম, ‘আমাদের সময়ে পাশ-ফেল না থাকলে আমার এত দূর পড়াশোনাই হত না।’ অর্থাৎ, পরীক্ষায় ফেল করবেন, এই ভয়েই নাকি প্রাণপণ পড়া মুখস্থ করে গেছেন তিনি। তিনি যেমন এক এক করে পরীক্ষা-দরিয়া পার হয়েছেন, তাঁর সহপাঠীদের অনেকেরই সেই সৌভাগ্য হয়নি নিশ্চয়ই। তাঁরা যে হালে পানি না পেয়ে লেখাপড়ায় ইতি টেনেছেন, এই সত্যটি বিশেষজ্ঞমশাইকে ভাবিয়েছে কি? আর পাঁচ জন গড়পড়তা ‘শিক্ষিত’র মতোই তিনিও স্পষ্টতই ছাঁকনি-দর্শনে বিশ্বাসী। পাশ-ফেলের ছাঁকনি থাকলে ভয় থাকবে, আর সেই ভয়ের ঠেলায় শিক্ষার মান ঊর্ধ্বপানে ছুটবে। অথচ, যারা পাশ করতে পারল না, তাদের একই শ্রেণিতে আটকে রাখলে তারা শিখবে বেশি— এ তত্ত্বের সপক্ষে তেমন জোরালো তথ্যপ্রমাণ নেই। বরং, এর উল্টোটাই দেখা গেছে বেশি। পিছিয়ে পড়ার লজ্জায় তারা শেষে স্কুলে আসাই বন্ধ করে দিয়েছে। বুনিয়াদি স্তরে বিদ্যালয়-ছুটের সংখ্যা অনেকটা কমানো গিয়েছিল। এ বার তা ফের বাড়বে। আর, এই স্কুলছুটের অধিকাংশই সামাজিক ভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ছেলেমেয়েরা। নিশ্চয় কেউ বলবেন না, একটি বারো-তেরো বছরের ছেলে বা মেয়ের স্কুলে আসার থেকে স্কুলে না আসায় অধিক কল্যাণ।

উদ্দেশ্য যদি হয় বিদ্যালয়-শিক্ষার গুণগত মানের উন্নয়ন, ফেল করা ছাত্রকে একই শ্রেণিতে আটকে রাখা যে তার প্রধান উপায় হতে পারে না, এই কথাটি কেউ কেউ যেন কিছুতেই বুঝতে চান না। আর, তার ফলে বিকল্পগুলি নিয়ে গণ-পরিসরে তথ্যভিত্তিক আলোচনা দেখাই যায় না। শিক্ষার অধিকার আইনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল মূল্যায়নের বিকল্প পদ্ধতির প্রবর্তন। বছরশেষে একটি পরীক্ষা এবং তার ফলাফলের ভিত্তিতে শাস্তি (একই শ্রেণিতে আটকে থাকা) বা পুরস্কার (উচ্চতর শ্রেণিতে ওঠা)— এই প্রথাগত পদ্ধতি থেকে সরে এসে ধারাবাহিক ও সার্বিক মূল্যায়ন পদ্ধতির প্রয়োগ নীতিগত দিক থেকে প্রশ্নাতীত। সারা বছর ধরে ধারাবাহিক ভাবে ছাত্র বা ছাত্রীটির প্রগতির দিকে নজর রাখা পদ্ধতিগত ভাবে কিছুতেই ভুল বলা চলে না। তবে, প্রয়োগের দিক থেকে বাস্তব অসুবিধাগুলি নিয়ে চর্চা হতে পারত। হল না। সামগ্রিক ভাবে কোন কোন ঘাটতিগুলো এখনও শিক্ষার্জনে বাধা সৃষ্টি করছে— যেমন স্কুলে আকর্ষক পরিবেশের অভাব, গতানুগতিক পাঠ্যবিষয়, নিকৃষ্ট পাঠ্যবই, শিক্ষণপদ্ধতি বিষয়ে অজ্ঞ শিক্ষক, ইত্যাদি— তা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারত। গেল না। এগুলির প্রত্যেকটিই মনোযোগ দাবি করে। অথচ, এ সব ছেড়ে একতরফা ভাবে পাশ-ফেল ফিরিয়ে আনাকেই গুণগত মানের খামতির অব্যর্থ ওষুধ বিবেচনা করা হল। শিক্ষার দর্শন? সে দায় রাজনীতির নয়।

এই তীব্র ‘পাশ-ফেল’প্রিয়তার ব্যাখ্যা কী? একটি ঘটনা বলি। আমার আগের কর্মস্থল ছিল দক্ষিণ ভারতের একটি নামকরা গবেষণা প্রতিষ্ঠান। সেখানে অধিকর্তা ঠিক করলেন, অফিসকর্মীদের পদোন্নতির জন্যে পরীক্ষা দিতে হবে। দু’জন পরীক্ষা দিলেন। এক জন পেলেন পঁচিশে বাইশ, আর এক জন সাড়ে পাঁচ। দু’জনেরই পদোন্নতি হল। কিন্তু প্রথম জন এই ‘অবিচার’-এ প্রবল ক্ষুব্ধ। অধিকর্তা যতই বোঝান, ‘তোমার তো পদোন্নতি হয়েছে, অবিচার হল কোথায়?’, তিনি মানবেন না কিছুতেই। যে পরীক্ষায় সবাই পাশ করে, সেটা পরীক্ষা নাকি?

একটু খোঁজ নিয়ে দেখবেন, যাঁরা পাশ-ফেলের পক্ষে, সাধারণত তাঁদের ছেলেমেয়েদের ফেল করার সম্ভাবনা কম। পাশ-ফেল থাকা না-থাকার সঙ্গে তাদের শিক্ষার্জনের সম্পর্ক ক্ষীণ। এই মা-বাবারা আসলে দেখতে চান তাঁদের ছেলেমেয়েরা, শুধু তাঁদের ছেলেমেয়েরাই, তাদের কৃতিত্বের জন্যে পুরস্কৃত হোক। আমার ছেলে একানব্বই পেল আর রামা কৈবর্তর ছেলে পেল সাত, অথচ দু’জনেই দিব্য অষ্টম শ্রেণিতে উঠে গেল, এটা ‘ন্যায্য’ হতে পারে? রামার ছেলে ফেল না করলে আমার ছেলের কীর্তিটি ‌ম্লান হয়ে যায় যে।

অধিকর্তা, আইডিএসকে। মতামত ব্যক্তিগত

অন্য বিষয়গুলি:

Education system Schools Pass-Fail
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE