কেবল দায়িত্বজ্ঞানহীনই নয়, বিপজ্জনক এবং অক্ষমণীয়। আরজি কর-কাণ্ডে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য বিষয়ে এই কথাটি দ্ব্যর্থহীন ভাবে বলা প্রয়োজন। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, তিনি অপরাধীর ফাঁসি চান। অভিষেকের দাবি, সাত দিনের মধ্যে অপরাধীকে এনকাউন্টারে মেরে ফেলা প্রয়োজন। দুই শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিকের এ-হেন মন্তব্যে স্তম্ভিত হতে হয়। অভিষেক যে ‘বিচার’-এর কথা বলছেন— এবং, কেন কেন্দ্রীয় সরকার অধ্যাদেশ জারি করে এমন ব্যবস্থা চালু করতে পারে না বলে হাহুতাশ করছেন— সেটি সোশ্যাল মিডিয়ার ভাষায় ‘হায়দরাবাদ মডেল’ হিসাবে পরিচিত। ২০১৯ সালে হায়দরাবাদে এক তরুণীর ধর্ষণ ও হত্যায় অভিযুক্ত চার জনকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারে সেই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত পুলিশকর্মীরা অপরাধী সাব্যস্ত হয়েছে বটে, কিন্তু নাগরিক আবেগে তারা এখনও ‘নায়ক’। আরজি কর-কাণ্ডেও অনেকেই এমন হাতেগরম ন্যায়বিচার চান। নাগরিকের সেই অধৈর্য, অস্থিরতা তবু বোঝা যায়। কিন্তু, এক জন দায়িত্বশীল রাজনীতিক যখন এই দাবি করেন, তখন বুঝতে হয় যে, গণতন্ত্র, সংবিধান বা দেশের বিচারব্যবস্থা, কিছুর প্রতিই তাঁর কোনও আস্থা নেই। এবং, তিনি নাগরিক অসন্তোষের অভিমুখ নিজেদের থেকে অন্য দিকে ঘোরাতে এমনই ব্যাকুল যে, তাঁর সেই আস্থাহীনতার বিজ্ঞাপন করতেও তিনি বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেন না। ঘটনা হল, আরজি কর-কাণ্ডে তাঁর এই ‘বৈপ্লবিক অবস্থান’ সম্ভবত তাঁর অন্ধভক্তের কাছেও যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য হয়নি। কিন্তু, তাতেও এই অক্ষমণীয় দায়িত্বজ্ঞানহীনতার গুরুত্ব লাঘব হয় না।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে ফাঁসির দাবি করেছেন, তা-ও একই রকম আপত্তিকর। কোনও অপরাধীরই প্রাণদণ্ড আদৌ সামাজিক ভাবে কাম্য কি না, সে তর্ক দূরে সরিয়ে রেখে বলা প্রয়োজন, অপরাধীর শাস্তির দাবি করেই মুখ্যমন্ত্রী তাঁর দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলতে পারেন না। স্পষ্ট ভাবে বলা প্রয়োজন, অপরাধীর কী শাস্তি হবে, তা স্থির করবে বিচারবিভাগ— সে কাজটি মুখ্যমন্ত্রীর এক্তিয়ারভুক্ত নয়। তাঁর দায়িত্ব ছিল রাজ্যের প্রশাসনিক সক্রিয়তা বজায় রাখা, পুলিশ-প্রশাসনকে নিরপেক্ষ ভাবে নিজেদের কাজ করতে দেওয়া। এ কথা দ্ব্যর্থহীন ভাবে প্রমাণিত যে, সেই দায়িত্ব পালনে তিনি সমূহ ব্যর্থ। আরজি কর-এ যে ঘটনা ঘটেছে, তা পারম্পর্যবিহীন নয়। এ রাজ্যে একের পর এক অপরাধ ঘটেছে— দলীয় আনুগত্যের বিচার করে পুলিশ-প্রশাসন তাতে নিষ্ক্রিয় থেকেছে। অপরাধীরা ক্রমেই আশ্বস্ত হয়েছে যে, পশ্চিমবঙ্গে শাসক দলের ছত্রছায়ায় থাকতে পারলে যে কোনও অপরাধ করেই নিস্তার পাওয়া যায়। আরজি কর-কাণ্ডের পর সে হাসপাতালের পরিসরে চলতে থাকা বিবিধ কার্যকলাপ যত প্রকাশ্যে আসছে, ততই স্পষ্ট হচ্ছে সেই একই নিশ্চিন্ততার ছবি— শাসক দলের পক্ষে থাকলে কোনও ভয় নেই! পরিস্থিতিটি যাতে এমন না হয়, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব ছিল মুখ্যমন্ত্রীর। তিনি তাতে ব্যর্থ। এখন ফাঁসির দাবি করে কি সেই ব্যর্থতা ঢাকা চলে?
ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের পরও যে অপরাধীদের আড়াল করার প্রবণতা বিন্দুমাত্র কমেনি, তার একাধিক নিদর্শন মিলেছে। হাসপাতালের অধ্যক্ষের চটজলদি পুনর্বাসন, সংস্কারের নামে অপরাধস্থল ভাঙচুর, হাসপাতাল পরিসরে গুন্ডাবাহিনীর তাণ্ডব, সবই ঘটেছে পর পর। এর দায় মুখ্যমন্ত্রী ছাড়া আর কার? পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্যটি কোন অতলে তলিয়ে গিয়েছে, আরজি কর-কাণ্ড তার সার্বিক প্রমাণ পেশ করল। এর পরও যদি রাজ্য শাসন করার নৈতিক অধিকার বজায় রাখতে হয়, তবে দায় ঝেড়ে ফেলার প্রবণতাটিকে বিসর্জন দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে রাজধর্মে ফিরতে হবে। সে যাত্রাপথ অতি কঠিন। তার জন্য যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন, পশ্চিমবঙ্গের শাসকদের তা অবশিষ্ট আছে কি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy