কেন্দ্রের বিজেপি সরকার দেশের সর্বত্র শ্রম কোড বলবৎ করতে তৎপর হচ্ছে, কিন্তু বিরোধিতায় অনড় শ্রমিক ইউনিয়নগুলি। সিটু, আইএনটিইউসি, ইউটিইউসি প্রভৃতি সংগঠনগুলি সংসদে শ্রম কোডের প্রস্তাব পেশ করার সময় থেকেই তীব্র বিরোধিতা করে আসছে। সম্প্রতি শিলিগুড়িতে শ্রম আইনের প্রতিবাদ করে পথসভা করল সঙ্ঘ পরিবারের শ্রমিক সংগঠন ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘও। যদিও বেশ কিছু বিরোধী রাজ্য-সহ অধিকাংশ রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ইতিমধ্যেই শ্রম কোড বলবৎ করার উদ্যোগ করেছে, তবু পশ্চিমবঙ্গ-সহ চার-পাঁচটি রাজ্যের সরকার এখনও অনড়। তৃণমূল সরকার ইতিমধ্যেই কেন্দ্রকে জানিয়ে দিয়েছে, শ্রমবিধি চালু করবে না। তবে এই রাজ্যগুলিতেও কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিতে নতুন বিধি কার্যকর হতে পারে। যার অর্থ, একই দেশে শ্রমিকদের অধিকার ও শ্রমিক কল্যাণের জন্য একাধিক আইন চালু থাকবে, শিল্প-শ্রমিক সম্পর্কে জটিলতা বাড়বে। যা কেন্দ্রীয় আইন পাশ করার যুক্তিকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়। ভারতে প্রচলিত দেড়শোরও বেশি শ্রম-সংক্রান্ত আইনের মধ্যে ঊনত্রিশটি নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার চারটি শ্রমিক কোড তৈরি করেছে। সেগুলির বিষয় ছিল মজুরি, শিল্পে মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক, শ্রমিকের সুরক্ষা, স্বাস্থ্য ও কাজের পরিবেশ, এবং শ্রমিকের সামাজিক নিরাপত্তা। উদ্দেশ্য ছিল শ্রমিক আইনগুলিকে সহজ ও সংহত করা। অথচ, শ্রম কোডকে কেন্দ্র করে সংসদ বয়কট, ধর্মঘট-সহ নানা প্রতিবাদ হয়ে চলেছে। ২০১৯ সালে করোনা অতিমারি চলাকালীন কোনও আলোচনা ছাড়াই সংসদে এই কোডগুলি পেশ করা হয়, এবং মজুরি সংক্রান্ত কোডটি চালু হয়ে যায়। বাকি তিনটি শ্রমিক কোড সংসদের স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়। ২০২০ সালে সেগুলিকে কার্যত বিনা বিতর্কে পাশ করিয়ে নেয় কেন্দ্র।
অথচ, বিতর্কের প্রয়োজন কিছু কম ছিল না। শ্রম আইনে সংস্কার আনা, শিল্পের প্রয়োজনের নিরিখে আইনে নমনীয়তার প্রয়োজন অনেক দিন ধরেই অনুভূত হয়েছে। সেই সঙ্গে থাকতে হবে উভয় পক্ষের জন্য ন্যায্যতা, কার্যকারিতা। শ্রমিকের দক্ষতা অনুসারে, শ্রমজীবী পরিবারের অত্যাবশ্যক খরচ এবং সামাজিক সুরক্ষার হিসাব কষে মজুরি নির্ধারিত হয়েছে কি না শ্রম কোডে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কর্মক্ষেত্রে যে ধরনের নিরাপত্তা দিয়েছে সংবিধানের ধারা এবং সুপ্রিম কোর্টের বিভিন্ন নির্দেশ, নতুন শ্রমিক আইনে তা যথাযথ প্রতিফলিত হয়েছে কি না, তা নিয়েওসংশয় রয়েছে। পানীয় জল, শৌচাগার, ক্রেশ, ক্যান্টিন ইত্যাদির ব্যবস্থা নিয়ে আইনি নির্দেশগুলি শিথিল হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। নিয়োগের নকশায় বদল হয়েছে, অথচ গিগ কর্মীদের মতো নতুন শ্রেণির কর্মীদের স্বার্থের সুরক্ষার প্রতি আইন যথেষ্ট মনোযোগী হয়নি। অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত শ্রমিক, যাঁরা শ্রমিকদের ৯০ শতাংশ, তাঁদের অবস্থা যথা পূর্বং। বিরোধী দল এবং শ্রমিক সংগঠনগুলি এমন নানা ধরনের ঘাটতি বা শিথিলতার কথা তুলে ধরেছে।
এসেছে নানা ধরনের বিকল্প প্রস্তাবও। যেমন, শ্রম আইনের কড়াকড়ি এড়াতে শিল্পগুলি অতি-ক্ষুদ্র বা ক্ষুদ্র হয়ে থেকে যেতে চায়, নথিভুক্তি এড়াতে চায়। ভারতে অসংগঠিত শিল্পের অত্যধিক প্রসারের অন্যতম কারণ স্থায়ী শ্রমিক নিয়োগে অনীহা। তাই শ্রমিকদের সুবিধার নির্ণয়ে স্থায়ী-অস্থায়ী বিভেদ তুলে দিয়ে যদি কেবল উৎপাদনশীলতাকেই শর্ত করা যায়, তা হলে শিল্প ও শ্রমিক উভয়েরই সুবিধা হতে পারে। তেমনই, অধিকাংশ শ্রমিক যখন সরাসরি নিয়োগের পরিবর্তে ঠিকাদারের মাধ্যমে নিযুক্ত হচ্ছেন, তখন ঠিকাদার সংস্থাগুলিকে শিল্পক্ষেত্র অনুসারে নথিভুক্ত করা ও সেই সূত্রে দায়বদ্ধ করার বিধি আনা প্রয়োজন। শিল্প-শ্রম সংঘাতের সাবেক মনোভাব থেকে বেরিয়ে, শ্রমিকের দক্ষতা ও নিরাপত্তার মাধ্যমে শিল্পের উন্নতির পথ খুঁজতে হবে সরকারকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy