যে দেশে বছরের শুরুই হয় এক সাংবাদিকের নিখোঁজ হয়ে যাওয়া আর দু’দিন পরে তাঁর মৃতদেহ খুঁজে পাওয়ার খবর দিয়ে, সেই দেশ নিয়ে অধিক কিছু বলার থাকতে পারে কি? তবু বলা দরকার, এবং বারংবার— যে অমানুষিক বীভৎসতায় ছত্তীসগঢ়ের সাংবাদিক মুকেশ চন্দ্রকরের মৃত্যু তথা হত্যা ঘটানো হল, এবং এই ঘটনার পূর্বাপর বৃত্তান্ত যে অসুস্থ রাষ্ট্রব্যবস্থাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, সে কারণেই। ছত্তীসগঢ়ের সাংবাদিক মুকেশ তাঁর ইউটিউব চ্যানেলে সেই সব খবর তুলে ধরতেন যা স্থানীয় ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনেরও প্রবল অস্বস্তির কারণ। সম্প্রতি ১২০ কোটির সড়ক নির্মাণ প্রকল্পে যুক্ত এক ঠিকাদার সংস্থার আর্থিক দুর্নীতি নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেছিলেন, তাঁর খবরের জেরে সরকার সংস্থাটির বিরুদ্ধে পদক্ষেপও করে। তার পরেই নিখোঁজ হন মুকেশ, দু’দিন পরে তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে সেই ঠিকাদার সংস্থার নির্মাণ প্রকল্পের একটি ট্যাঙ্ক থেকে। আটাশ বছরের তরুণ সাংবাদিককে যে নিষ্ঠুরতায় হত্যা করা হয়েছে তা জেনে শিউরে উঠতে হয়: শুধু মাথাতেই পনেরোটি ফ্র্যাকচার, লোহার রডের উপর্যুপরি আঘাতে ভেঙে গিয়েছে ঘাড়, বুকের পাঁচটি পাঁজর; হৃৎপিণ্ড বেরিয়ে এসেছে, লিভার চার টুকরো।
সাংবাদিকের স্বাধীনতা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে ভারতের অবস্থান, এই সব কিছু আজ কোন জায়গায় পৌঁছেছে তা নিয়ে অগণিত বার লেখা হয়েছে সম্পাদকীয় স্তম্ভে। কিন্তু দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় এক সাংবাদিকের এ-হেন মৃত্যু তথা হত্যার আতশকাচে দেখলে আজকের ভারতে গণতন্ত্রের এই ধারণাগুলিকে অলীক, মৃত বলে বোধ হয়। দেশের শাসকেরাও নিশ্চয়ই বারংবার বলা এই কথাগুলিকে প্রলাপ বা প্রহসন বলে ভাবেন, কিংবা তাঁরা সমস্ত বোধবুদ্ধির পারে এমন এক চিত্তবৈকল্যে গ্রস্ত যে তাঁদের দরজায় এই কথাগুলি ঘা খেয়ে ফিরে আসে। সাংবাদিক-হত্যার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসাবে কয়েকটি পদক্ষেপ করা হয়: দুঃখপ্রকাশ, নিন্দা বিবৃতি, পুলিশ বা তদন্তকারী সংস্থা দিয়ে তদন্ত। মুকেশ চন্দ্রকরের মৃত্যুর পরেও হয়েছে: কয়েকজন অভিযুক্ত ধরা পড়েছে, ছত্তীসগঢ়ের বিজেপি-শাসিত সরকার কড়া শাস্তি নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করেছে। এই সবই পুরনো ছক, বহুব্যবহারে ক্লিষ্ট। কথাই সার, কাজ কিছু যে হয় না, তার উদাহরণ মিলবে ভূরি ভূরি।
উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, বিহার, ছত্তীসগঢ়, কর্নাটক: অকুস্থল বদলে যায়। সাংবাদিকদের নামগুলিও: করুণ মিশ্র, রঞ্জন রাজদেব, সন্দীপ শর্মা, শুভম ত্রিপাঠী, শশীকান্ত ওয়ারিশে, গৌরী লঙ্কেশ, নবতম সংযোজন মুকেশ চন্দ্রকর। এঁরা সরকারের উগ্র নীতি ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে খবর করেছিলেন, কিংবা বালি ও জমি মাফিয়া, অসাধু নির্মাণ বা ঠিকাদার সংস্থার হাতে পরিবেশ ও প্রকৃতির মুছে যাওয়া নিয়ে। প্রতিটি ঘটনার গভীরে রয়েছে রাজনীতি ও ব্যবসার অশুভ আঁতাঁত, যার বলি হচ্ছেন ভারতীয় সাংবাদিকরা। যে প্রশাসন সাংবাদিক-হত্যায় নিন্দা করছে, তারই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কল্যাণহস্তে পুষ্ট হচ্ছে অসাধু ব্যবসাচক্র— এই সত্য অস্বীকারের কোনও উপায় নেই। বিজেপি শাসনকালে গত দশ বছরে সাংবাদিক-হেনস্থার খতিয়ান নাহয় ঊহ্যই থাক, শুধু সাংবাদিক-হত্যার হিসাবটুকুই আয়নার কাজ করতে পারে। শাসকেরা যদি ভুল করেও কখনও তাতে নিজেদের মুখটি দেখতেন!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy