Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

নিজেকেই শুরু করতে হবে

২৬০ দিন ধরে ৩৮০০ কিলোমিটার হেঁটেছেন সৃষ্টি। ‘ইন্ডিয়ান স্কুল অব বিজ়নেস’ থেকে এমবিএ করা এক মেয়ের বাণিজ্যিক সংস্থার দামি চেয়ার ছেড়ে এসে এই অভাবনীয় হাঁটার সিদ্ধান্ত দেশকে রীতিমতো চমকে দিয়েছে।

সোনালী দত্ত
শেষ আপডেট: ৩০ মে ২০১৮ ০১:০৮
Share: Save:

সন্ধের বাস ধরে বাড়ি ফিরছিলেন সেন্ট্রাল হংকংয়ের বাসিন্দা, বছর তিরিশের সৃষ্টি বক্সী। এই সময় তিনি দেশের খবরাখবরে চোখ বোলান। হঠাৎ চোখে পড়ল উত্তরপ্রদেশের বুলন্দশহরের ঘটনায়; গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন মা মেয়ে দু’জনেই। ঘটনাটি তাঁকে খুব নাড়া দিল। আসলে কর্মসূত্রে তাঁকে বহু জায়গায় ঘুরতে হত। বিদেশিদের সঙ্গে এক টেবিলে বসে ব্যবসা সংক্রান্ত আলোচনা সারতে হত। সৃষ্টি বলতেন, ‘‘তোমরা আমাদের দেশে যাও না কেন? আমাদের দেশ ভারী সুন্দর।’’ তাঁদের উত্তর, ‘‘যাই না কারণ তোমাদের দেশ নিরাপদ নয়।’’ সৃষ্টি তখন বিভিন্ন তথ্য, পরিসংখ্যান দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করতেন, হিংসা এখন সারা পৃথিবীর সমস্যা। তবু শেষমেশ তাঁকে তর্কে হারতে হত। নারী নির্যাতনের বীভৎস বর্ণনাগুলি তাঁর সব যুক্তিকে নস্যাৎ করে দিত। উত্তরপ্রদেশের ঘটনার কথা রাতে খাবার টেবিলে পরিবারের সদস্য, পরে বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করতে গেলেন সৃষ্টি। কিন্তু তাঁরা সবাই বললেন, ধর্ষণ ভারতে প্রাত্যহিক ব্যাপার। সৃষ্টির তা গ্রহণযোগ্য মনে হল না। তাঁর মতে, আমরা বছরের পর বছর পরিবর্তনের জন্য অপেক্ষা করে থাকি। আর ভাবি, কেউ এক জন এসে পরিবর্তন ঘটিয়ে দেবে। ক্রমশ তাঁর সিদ্ধান্ত, পরিবর্তন নিজের মধ্যে থেকেই আনতে হবে। তোমাকেই শুরু করতে হবে।

ভারতীয় সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল অশ্বিনী বক্সীর মেয়ে সৃষ্টি। লড়াই তাঁর রক্তে। ঠিক করলেন, হংকংয়ে বিলাসবহুল জীবন, গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি, সব ছেড়ে দিয়ে দেশের মেয়েদের জন্য কাজ শুরু করবেন। স্বামী-সহ শ্বশুরবাড়ির সকলে তাঁকে সমর্থন জানালেন। বাবা-মা এগিয়ে এলেন সহায়তায়। সৃষ্টি তৈরি করলেন ‘ক্রস বো’— তাঁর নিজের সংস্থা, যা প্রচার চালাবে নারীর ক্ষমতায়ন ও সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে। নারী নিপীড়ন নিয়ে প্রচুর আলোচনা হচ্ছে। অথচ কথা যত হচ্ছে, কাজ সেই তুলনায় কিছুই হচ্ছে না। সৃষ্টি পরিকল্পনা নিলেন কন্যাকুমারিকা থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত এক লং মার্চের। সঙ্গে থাকবেন বারো জন মহিলা স্বেচ্ছাসেবী। ‘ক্রস বো মাইলস ক্যাম্পেন’-এর পাশে দাঁড়ালেন অনেকেই। অমিতাভ বচ্চন, সুস্মিতা সেন, দিয়া মির্জ়া প্রমুখ। কিন্তু হাঁটা কেন? কারণ বেশির ভাগ ভারতই তো হাঁটে। ভারতের সাধারণ মানুষের সংস্পর্শ তো পথেঘাটেই পাওয়া যায়। তাঁদের শেখাতে হবে, তাঁদের কাছ থেকে শিখতেও হবে।

প্রস্তুতি কম নয়। না ছিল সমাজসেবার পূর্বপাঠ, না কোনও লম্বা পথ হাঁটার অভিজ্ঞতা। ‘ইউনাইটেড নেশনস এমপাওয়ার উইমেন: চ্যাম্পিয়ন্স ফর চেঞ্জ’ কর্তৃক নির্বাচিত হলেন, প্রশিক্ষণ নিলেন সৃষ্টি। ভারতীয় নারীদের বিষয়ে বহু তথ্য, বিশ্লেষণ পড়লেন। বিশেষ শারীরিক কসরত শিখলেন। এর মধ্যে ভারোত্তোলনও ছিল। শুরু করেছিলেন পনেরো কেজি দিয়ে, এখন একশো কেজিও তুলে ফেলেন। বাবার সহায়তায় রুট ম্যাপ তৈরি হল। যাত্রা শুরু করলেন গত বছর ১৫ সেপ্টেম্বর।

২৬০ দিন ধরে ৩৮০০ কিলোমিটার হেঁটেছেন সৃষ্টি। ‘ইন্ডিয়ান স্কুল অব বিজ়নেস’ থেকে এমবিএ করা এক মেয়ের বাণিজ্যিক সংস্থার দামি চেয়ার ছেড়ে এসে এই অভাবনীয় হাঁটার সিদ্ধান্ত দেশকে রীতিমতো চমকে দিয়েছে। ভোর সাড়ে চারটেয় শুরু করতেন, হাঁটতেন রাত সাড়ে বারোটা পর্যন্ত। কোনও কোনও দিন তো গোটা রাত। এই ভাবে চলেছেন আট মাসের উপর। প্রত্যেক দিন গড়ে পঁচিশ থেকে ত্রিশ কিলোমিটার পেরোতেন। হাঁটার ফাঁকে ফাঁকেই আসল কাজ। মহিলাদের নিরাপত্তা বিষয়ে গণসচেতনতা তৈরি করা। মাঝে মাঝেই আয়োজন করতেন আলোচনাসভা বা কর্মশালার। গ্রামের সাধারণ মহিলা, সরকারি স্কুল-কলেজের ছাত্রী, শহরের শ্রমজীবী নারী— এঁদের সঙ্গে বসতেন সৃষ্টি। কী ভাবে নিজেদের নিরাপদ রাখতে হয়, প্রযুক্তি ও অর্থকরী বিষয়ে যোগদান করতে হয়, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা অর্জন করতে হয়, লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়তে হয়, অত্যাচারিত হলে বা কাউকে হতে দেখলে তৎক্ষণাৎ অভিযোগ নথিভুক্ত করে আসতে হয়, এই সব ছিল তাঁদের আলোচ্য বিষয়। সৃষ্টি শিখেছেনও অনেক কিছু। দশ জন গ্রামের মহিলার মধ্যে সাত জনই কী ভাবে গার্হস্থ্য হিংসার শিকার হন, দেখেছেন। তাঁর ভাষায়, “সমস্ত অভিজ্ঞতাই যথেষ্ট উত্তেজক। অনেক সময় চোখে জল এসে গিয়েছে। আমি বুঝেছি, সংখ্যালঘুর উপর নির্যাতন এবং সংখ্যাগুরুর নীরব থেকে যাওয়া, এর থেকেই যত অপরাধের সৃষ্টি। যখনই তুমি একটি সামাজিক সমস্যা দেখেও নির্বিকার থাকলে, তখনই তুমি সেই দোষের ভাগীদার হয়ে গেলে।”

সৃষ্টি বক্সীর কথা আমরা সে ভাবে না জানলেও ইংল্যান্ডের রানি দ্বিতীয় এলিজ়াবেথ জানেন। ছাব্বিশতম ‘কমনওয়েলথ পয়েন্ট অব লাইট’ হিসাবে তিনি নির্বাচন করেছিলেন ভারতের সৃষ্টিকেই, নারীর ক্ষমতায়নের কাজে তাঁর অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ। গত নারী দিবসে পুরস্কারের মঞ্চে উপস্থিত ব্রিটিশ হাইকমিশনার (ভারতে) ডমিনিক এসকিথ বলেন, ‘‘এই পুরস্কার সৃষ্টির বার্তাকে সারা পৃথিবীতে পৌঁছে দেবে।’’

তামিলনাড়ুর এক আতা বিক্রেতার সঙ্গে চলতে চলতেই আলাপ হয়েছিল সৃষ্টির। সেই মহিলা ভারী সুন্দর করে বলেছিলেন, “আমি জানি তুমি যা করবে বলে বেরিয়েছ, তা আমার জীবনে সম্ভব নয়। কিন্তু আমি এও জানি, আমার মেয়ে তার সুফল পাবে।”

ঠিকই, ওই আতা-বিক্রেতার মেয়েই তো ভবিষ্যৎ ভারতবর্ষ। সৃষ্টি বক্সীর লং মার্চ তাকেই ছুঁতে চেয়েছে মাত্র।

অন্য বিষয়গুলি:

gender equality Srishti Bakshi Movement
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE