কাউকে না পোষালে নোটা-য় দিবি, কিন্তু ভোট দিতে যাবি না কেন?’’ উত্তেজিত প্রশ্ন শিশিরের। সূর্য ঘোষণা করেছে, এই গরমে সে মোটেই ভোটের লাইনে দাঁড়াতে রাজি নয়।
‘‘নোটায় ভোট দেওয়া যে একেবারেই ভোট না দেওয়ার চেয়ে ভাল, সেটা কে বলল তোকে?’’ পাল্টা প্রশ্ন সূর্যের।
‘‘ভাল নয়?’’ শিশির অবাক। ‘‘এই যে তুই নিজের প্রতিবাদটা ইভিএম-এ জানিয়ে এলি, সেটার গুরুত্ব নেই? যত জন মানুষ নোটায় বোতাম টিপল, তারা যে দেশের সব রাজনৈতিক দলকেই একধারসে প্রত্যাখ্যান করল, দলগুলো সব চোর-জোচ্চোর আর গুন্ডা-বদমাশে ভরে গিয়েছে বলে— এই কথাটার কোনও গুরুত্ব নেই?’’
‘‘নে, একটু জল খা!’’ শিশিরের দিকে হাতের বোতলটা এগিয়ে দেন শিবুদা। মুচকি হাসেন, ‘‘যা ওয়েদার, মাথায় লু লাগলে আর দোষ কী?’’
‘‘ইয়ার্কি মেরে জিততে পারবেন না।’’ শিশিরও অদম্য, ‘‘আমি যা বললাম, যুক্তি দিয়ে কাটতে পারবেন?’’
এত ক্ষণে তপেশ ঢোকে গোপালের দোকানে। ‘‘গোপালদা, একটা এসি লাগাও এ বার’’ বলে চেয়ার টেনে বসে। দরদর করে ঘামছে। টেবিলে পড়ে থাকা আনন্দবাজারটাকে তুলে হাওয়া করে নিজেকে। তার পর বলে, ‘‘কী ভাগ্যিস ভোটে দাঁড়াইনি। এই রোদে আদাড়েবাদাড়ে ঘুরতে হত সারা দিন!’’
‘‘ভোটে দাঁড়াসনি ঠিক আছে, ভোট দিবি তো?’’ প্রশ্ন করে সূর্য।
‘‘ভাবছি।’’ তপেশ উত্তর দেয়। ‘‘কিন্তু, আমার একটা ভোটে কী এসে যায় বল দেখি। এই রোদে তেতেপুড়ে ভোট দিয়ে এলেই কি মোদী হারবে?’’
‘‘এই প্রশ্নটা, বুঝলি, বহু লোকের মনে।’’ শিবুদা তপেশের কথার খেই ধরে নেন। ‘‘বিহেভিয়রাল ইকনমিকস-এ এর একটা পোশাকি নামও আছে— ড্রপ-ইন-দ্য-বাকেট এফেক্ট। এমনিতে মানুষের নিজের ক্ষমতার ওপর অসীম বিশ্বাস। আর পাঁচ জন যেটা পারে না, সেটা আমি নির্ঘাত পারব— এই বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়েই নিত্যদিন হরেক ব্যবসা ফেল মারছে, ছেলেপুলেরা বাইকে অ্যাক্সিডেন্ট করছে। কিন্তু, ভোটের প্রশ্ন এলেই এই আত্মবিশ্বাস উবে যায়। তখনই মনে হয়, আমার একার ভোটে কী আর হবে!’’
‘‘সেটা কি স্বাভাবিক নয়?’’ প্রশ্ন করে তপেশ। ‘‘ভেবে দেখুন, আত্মবিশ্বাস সেখানে, যেখানে পারা বা না-পারা নির্ভর করছে আমার নিজের ওপর। অন্যদের থেকে আমার দক্ষতা বেশি, বা অন্যদের চেয়ে আমি কাজটা আলাদা ভাবে করতে পারব, এই রকম একটা বিশ্বাস থেকে। আর, ভোটে তো আপনি জানেনই, ফলাফলে আপনার ভূমিকা ঠিক ততটুকুই, আপনার লোকসভা কেন্দ্রের বাকি পনেরো লক্ষ ভোটারের যতখানি। নিজের ওপর বিশ্বাসের প্রশ্নটা আসছে কোথা থেকে?’’
গোপাল এসে চায়ের কাপ নামায়। শিবুদা খানিক ক্ষণ তাকিয়ে থাকেন তপেশের দিকে, তার পর বলেন, ‘‘বহুত খুব। একদম ঠিক জায়গায় ধরেছিস। কিন্তু, তোর সঙ্গে বাকি কথা পরে হবে। আগে শিশিরের প্রশ্নটার উত্তর দিই। হ্যাঁ রে শিশির, এই যে একটু আগে বক্তৃতা করলি, তা গোটা দেশের কত ভাগ লোক নোটায় ভোট দিয়ে নিজেদের অসন্তুষ্টি জানায়, সে আন্দাজ আছে?’’
শিশির চুপ করে থাকে। শিবুদা বলেন, ‘‘মেরেকেটে এক থেকে তিন শতাংশ। বুঝলি? এই যে তপেশ এক্ষুনি সংখ্যার কথা বলছিল না, ভোট জিনিসটায় আসলে সংখ্যাই সব। পনেরো লক্ষ ভোটারের নির্বাচনী কেন্দ্রে হাজার ত্রিশেক লোক নোটা দিল কি না, সেটা আসলে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। যেটা থেকে যায়, সেটা রাজনৈতিক বিবেচনার অভাব। সব দলের প্রার্থীকেই, অথবা সব দলকেই, তুই অপছন্দ করতে পারিস, কিন্তু সমান অপছন্দ করিস কি? ধর, একটা দল মুসলমানদের দেশছাড়া করতে চায়, অন্য একটা দল সিন্ডিকেট বানিয়ে টাকা তোলে, আর একটা দল ক্ষমতায় থাকলে মূলত চুরিচামারি করে— তোর কাছে সব ক’টাই আপত্তিকর হতে পারে, কিন্তু সমান আপত্তিকর কি? আমার কাছে তো নয়। যে দলটা ভারতের এত দিনের চরিত্রটাকেই বদলে দিচ্ছে, তার মতো অপছন্দ আমি কোনও দলকে করি না। করতে পারি না। তুইও সম্ভবত একমত হবি, তাই না?’’
‘‘সে তো বুঝলাম, কিন্তু যাকে তুলনায়-কম-অপছন্দ করব, তাকে ভোট দিতেই হবে, সেই মাথার দিব্যি কে দিল?’’ শিশির প্রশ্ন করে। সূর্য আর তপেশ অবাক। গোপালের দোকানে বসে শিবুদার সঙ্গে তপেশ ঢের তর্ক করেছে, সূর্যও করেছে মাঝেমধ্যেই, কিন্তু শিশিরকে এ ভাবে খেপে উঠতে দেখেনি আগে।
শিবুদা নিরুত্তাপ। বললেন, ‘‘মাথার দিব্যি যে দিয়েছে, তার নাম গণতন্ত্র। সহজ কথাটা বুঝিস না কেন, জানি না— তুই, বা তোর মতো আরও অনেকে নোটায় ভোট দিলেও, কোনও একটা কেন্দ্রে, এমনকি গোটা দেশের সব কেন্দ্রেই নোটায় সবচেয়ে বেশি ভোট পড়লেও কিছু যায় আসে না, প্রার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভোট যে পাবে, জিতবে সেই। তার মানে, তোর ভোটটা নোটায় পড়লেও জয়ী আর দ্বিতীয় প্রার্থীর মধ্যে ভোটের অনুপাতে তার কোনও প্রভাব পড়ছে না। তুলনায়-কম-অপছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিলে কিন্তু সেই প্রভাব পড়ে। পড়তে বাধ্য। পনেরো লাখে একটা ভোট, অনুপাতে শূন্যের খুব কাছাকাছি, শূন্য কিন্তু নয়। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের সিটে এ রকম কিছু ভোট খেলা ঘুরিয়ে দিতে পারে, সেটা মাথায় রাখ। পারিস আর না-ই পারিস, চেষ্টাটা তো করবি।’’
একটানা কথা বলে শিবুদা থামলেন। একটা সিগারেট ধরালেন। বাকি তিন জনও চুপ। ভোট মানে যে শুধু নিজের পছন্দের প্রার্থীকে জিতিয়ে আনা নয়, সবচেয়ে মারাত্মক দলটাকে ক্ষমতায় আসা থেকে আটকানোও বটে, এ কথাটা খেয়াল থাকে না সব সময়।
‘‘নোটা কোথায় সবচেয়ে বেশি পড়ে, জানিস?’’ নীরবতা ভাঙলেন শিবুদা। ‘‘গরিমা গোয়েল বলে একটা মেয়ে, বাচ্চা মেয়ে, দুর্দান্ত একটা পেপার লিখেছিল ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি-তে। বোধ হয় গত বছরই পড়েছিলাম লেখাটা। স্ট্যাটিসটিক্স বলছে, শহরের চেয়ে নোটায় ভোট বেশি পড়ে গ্রামে, আর সবচেয়ে বেশি পড়ে তফসিলি জনজাতির জন্য সংরক্ষিত সিটে। কেন বল দিকি? আমার কী অনুমান জানিস? তফসিলি জনজাতির হাতে ক্ষমতা চলে যাচ্ছে, সেই রাগে উচ্চবর্ণের লোকরা দেদার নোটায় ভোট দিয়েছে। অনুমানটা গরিমাও করেছে, তবে একটু রেখেঢেকে। মোদ্দা কথা হল, যেটাকে তুই রাজনীতির প্রতি বিরক্তি প্রকাশের অস্ত্র ভাবছিলি, তার পরতে পরতে রাজনীতি। এবং, সম্ভবত তোর পছন্দের রাজনীতি নয়। তা হলে সেটায় জড়িয়ে পড়বি কেন?’’
শিবুদার সঙ্গে হরেক তর্ক হয়, মাঝেমধ্যে দু’চারটে চিমটি কাটতেও ছাড়ে না তপেশরা। কিন্তু, এই একটা জায়গায় শ্রদ্ধা না করে পারা যায় না— অরাজনীতির আনাচেকানাচে যে বিপজ্জনক রাজনীতিগুলো ছড়িয়ে থাকে, ঠিক চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন ভদ্রলোক। মগজটাকে ধরে ঝাঁকিয়ে দেন। শিশিরের মুখ দেখে মনে হল, ঝাঁকা খেয়েছে তার মাথাও।
‘‘সে না হল হল, শিবুদা, কিন্তু এই গরমে ভোট দিতে যেতে ইচ্ছে না করে যদি?’’ গোপালের দিয়ে যাওয়া আর এক কাপ চায়ে চুমুক দিয়ে প্রশ্ন করে সূর্য।
‘‘দেখ, বাড়িতে পুলিশ পাঠিয়ে বুথে নিয়ে যাওয়া যাবে না, সেটা ঠিক।’’ অনেক ক্ষণ গম্ভীর থাকার পর শিবুদাও মুচকি হাসলেন। চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। তার পর বললেন, ‘‘ভোট দিতে না যাওয়া আর নোটায় ভোট দেওয়া মূলগত ভাবে এক— দুটোতেই তুই প্রার্থী বাছাই করার অধিকারটা ছেড়ে দিচ্ছিস। ফারাক হল, নোটায় ভোট দিতে হলে তোকে বুথ অবধি যেতে হবে। ভোট দিতে না গেলে সেই ঝামেলা নেই। দিব্যি মাংস-ভাত খেয়ে ঘুম দিবি ভোটের দুপুরে। বহু লোক দেয়ও। সমস্যা আসলে নোটাওয়ালাদের নিয়ে যতটা, ভোট দিতে না যাওয়া লোকদের নিয়ে তার চেয়ে ঢের বেশি। কারণ, সংখ্যা। নোটা দেয় এক-দুই শতাংশ ভোটার, আর ভোট দিতে যায় না গড়ে ত্রিশ শতাংশের বেশি।
‘‘কথা হল, তারা যায় না কেন? একটা কারণ তো সেই ড্রপ-ইন-দ্য-বাকেট— যেটার উত্তর আগেই দিয়েছি। কিন্তু, সেটাই তো একমাত্র কারণ নয়। আমেরিকান ইউনিভার্সিটিগুলোর মস্ত গুণ, ওরা এই সব নিয়ে গবেষণার জন্যও প্রচুর টাকা দেয়। অন্তত, দিত। ২০১৫ সালে হার্ভার্ড আর ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভেনিয়ার গবেষকরা দেখালেন, কাউকে ফোন করে ভোট দিতে যাওয়ার কথা মনে করিয়ে দেওয়ার বদলে যদি জানতে চাওয়া হয় যে তিনি কোন বুথে, কখন, কী ভাবে ভোট দিতে যাওয়ার কথা ভাবছেন, তা হলে অনেক বেশি মানুষ সত্যিই ভোট দিতে যান। এ হল ‘নাজ’ বা একটু ঠেলা-দেওয়ার উদাহরণ, রিচার্ড থেলার নোবেল পেলেন যার জন্য। এর বছর দশেক আগের আর একটা এক্সপেরিমেন্টে দেখা গিয়েছিল, পড়শিরা যদি ভোট দেন, তা হলে যাঁরা ভোট না দেওয়ার কথা ভাবছিলেন, তাঁদের অনেকে শেষ অবধি বুথে পৌঁছে যান। সহজ কথা, মগজ আর শরীরের আলস্য কাটিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা গেলে ভোট বেশি পড়বে।’’
‘‘অর্থাৎ, নরেন্দ্র মোদীকে ধরাশায়ী করতে চাইলে রাহুল গাঁধীর কর্তব্য, জনে জনে ফোন করে তাঁদের ভোট দিতে যাওয়ার প্ল্যান-প্রোগ্রাম জেনে নেওয়া?’’ মিচকে প্রশ্ন তপেশের।
‘‘তুইও করতে পারিস। দেশের জন্য না-হয় কয়েকটা ফোনই করলি।’’ উত্তর দিলেন শিবুদা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy