—ফাইল চিত্র।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক অনুরাধা রায়ের ‘ক্ষমতা যখন প্রবল আকার’ (১৯-৮) শীর্ষক প্রবন্ধে শুরুতে এবং শেষে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের মুণ্ডপাত এবং সেই সূত্রে আলোচ্য বিষয়টির অবতারণা করা হয়েছে। যাদবপুরের কয়েক জন অভিযুক্ত ছাত্র, প্রাক্তন ছাত্রের ঘৃণ্য অপরাধকে মেলানো হয়েছে ফ্যাসিবাদ এবং “রাষ্ট্রীয় স্তরে স্বৈরাচারী আধিপত্যবাদের নখদাঁত যখন চার দিকে ত্রাসের সঞ্চার করছে”— এই প্রেক্ষাপটের সঙ্গে। যেন যখন বামপন্থী সরকার ছিল এখানে, বা কেন্দ্রে ছিল বামপন্থীদের বন্ধু সরকার, তখন র্যাগিং নামক ‘আর এক স্বৈরাচারী আধিপত্যবাদের উৎকট প্রকাশ’ ছিল না। না, সত্য তা নয়, বরং তা কিছু বেশিই ছিল। আসলে, যুক্তি দিয়ে আমরা যা চাই, তাই প্রমাণ করতে পারি। ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়া আর কী!
২০০৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)-এর নির্দেশাবলি, সময়ে সময়ে আদালতের রায়ের কথা জানা উচিত সব সচেতন শিক্ষকের, প্রশাসকের। প্রবন্ধকার ‘স্টকহোম সিনড্রোম’-এরও উল্লেখ করেছেন। অবাক লাগে যখন পড়ি, ওঁর মতো ‘কেউ কেউ জানতেনই না কতটা কী ঘটে চলছে’। অন্ধ হলে যে প্রলয় বন্ধ থাকে না, আর বিপ্লবও আসে না, এই কথাটি আমরা জানি।
এ-ও জানি, প্রযুক্তি দিয়ে বাড়াতে হবে জীবনের মান, নিরাপত্তা। কম্পিউটার, ল্যাপটপের মতো, সিসি টিভি ছাড়া ভাবা যায় না আজকের জীবনের মান, নিরাপত্তা। তবে লেখকের সঙ্গে একমত, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের গর্ব। সুশীল সমাজ কখনও মনে করে না, ‘যেন যাদবপুর একটি পিশাচ সদৃশ ও সমাজ বহির্ভূত প্রাণী; এবং র্যাগিং যেন যাদবপুর ছাড়া কোথাও হয় না’। আইআইটি খড়্গপুরে একটি সাম্প্রতিক ঘটনাও সমান মর্মান্তিক। দেশ জুড়ে এই ব্যাধির শিকার বহু ছাত্রছাত্রী। চাই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। অনুশাসন, কাউন্সেলিং, সজাগ দায়িত্বশীল শিক্ষক, প্রশাসক। এগিয়ে আসতে হবে সাধারণ ছাত্রসমাজকে। লেখক যেন কিছুটা ব্যঙ্গের সুরেই বলেছেন, “সিসি ক্যামেরা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় তথা মানব সভ্যতাকে মুড়ে দাও। সিসি টিভির প্রতিফলনই যখন যথেষ্ট, নিজেদের সামনে আয়না ধরার দরকার কী?” দরকার আছে সিসি টিভির, দরকার আয়নারও। মুক্তচিন্তায় শুধু যাদবপুরের নয়, সব বিশ্ববিদ্যালয়েরই অধিকার। যুক্তিজালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এক নির্মম ব্যাধিকে বিকৃতিকে অপ্রাসঙ্গিক রাজনৈতিক গতের তরজায় নামিয়ে না আনাই ভাল। তাতে রাজনৈতিক দলগুলি যা করছে, তা-ই পুষ্টি পায়। যা দেখেশুনে আমরা বড় ক্লান্ত।
অলোক রায়, কলকাতা-৮
লঘুতার স্বস্তি
‘ক্ষমতা যখন প্রবল আকার’ প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। মুক্তমন এবং মুক্তচিন্তার সূতিকাগারে সিনিয়র দাদাদের ধর্ষকাম মনোবৃত্তির সঙ্গী হতে না পারা এক জন মেধাবী শিক্ষার্থী স্থান পেয়েছে মৃতদের তালিকায়। আমরা যারা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, কিংবা এ-ওয়ান তকমা পাওয়া অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে গর্বের ফানুস ওড়াই, এক নিরপরাধ ছাত্রের মৃত্যু তাতে পিন ফুটিয়ে মাটিতে নামিয়ে এনেছে।
প্রতিটি মানুষের মনেই কর্তৃত্ব করার বাসনা আছে— এই বলে আমরা যদি সমালোচনা করতে ভুলে যাই, কিংবা ‘ও একটু-আধটু বড়রা করবেই’ বলে পাশ কাটাই, তা হলে শিক্ষাক্ষেত্রে চলতে থাকা এই পৈশাচিক নির্যাতনের অবসান কোনও দিনই ঘটবে না। যদি বড়দের কৌতুক-রঙ্গ এক জনকে পৃথিবী থেকেই সরিয়ে দেয়, তা হলে সেই ছাত্রদের শিক্ষায় থেকে যায় ত্রুটির পাহাড়। শুধু সচেতনতা বৃদ্ধি করে কি এই অপচেষ্টায় ব্রতী শিক্ষার্থীদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে পারা যাবে? ভয় হয়, সুবোধ ঘোষের ‘চতুর্থ পানিপথের যুদ্ধ’ গল্পের নায়ক স্টিফান হোরোর কথা ভেবে। ‘সবক’ শেখাতে আসা সিনিয়র ছাত্রদের বিপক্ষে যদি কেউ স্টিফান হোরো হয়ে ওঠে, তা হলে কিন্তু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা মুশকিল হয়ে পড়বে।
মিলান কুন্দেরার একটি উপন্যাসের নাম দি আনবেয়ারেবল লাইটনেস অব বিয়িং— অস্তিত্বের অসহনীয় লঘুতা। আমাদের এখানে অস্তিত্বের লঘুতা অসহনীয় নয়, তার কারণ লঘুতার এক পরম আকর্ষণ আছে। লঘুতা স্বস্তি দেয়। তাই তো লঘুতার নামে এই অত্যাচারকে আমরাও সমর্থন করে বসি। ছাত্র হিসাবে কোথায় থামতে হবে, এই ভেদ-অভেদের সীমার বোধ যদি নিছক আবেগের প্রাবল্যে লুপ্ত হয়ে যায়, তা হলে বলতে হয়, আমাদের সৃষ্টি-কৃষ্টির মনন সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। অবাক লাগে, মানুষের তরল আনন্দ, আবেগের প্রমাদ সহজেই তাকে কত নিচু পথে টেনে নামায়।
সামাজিক মূল্যবোধ তথা সততা, কর্তব্য, নিষ্ঠা, ধৈর্য, উদারতা, শিষ্টাচার, সৌজন্যবোধ, পারস্পরিক মমত্ববোধ ইত্যাদি নৈতিক গুণাবলি নষ্ট হয়ে যাওয়াকে বলে অবক্ষয়। অত্যাচারী ছাত্রদের পারিবারিক শিক্ষাতেও তাই থেকেছে বিস্তর ফাঁক-ফোকর। নৈতিকতা ও মানবিকতার বোধ গঠনে পরিবারগুলি ব্যর্থ হলে সমাজ পঙ্গু হয়ে পড়বেই।
রাজা বাগচী, গুপ্তিপাড়া, হুগলি
ফিরুক আলোয়
অনুরাধা রায়ের প্রবন্ধটি পড়ে জানতে পারলাম, সমাজে কী ভাবে আধিপত্য কায়েম হয়। কিন্তু আমরা এমন আধিপত্য চাইব না, যেখানে সমাজের ক্ষতি হয়। অর্থনীতিতে একটি ধারণা আছে যে, আমরা এমন ব্যবস্থা গড়ে তুলব না যেখানে সমাজের এক জন ব্যক্তিরও ক্ষতি হয়। যদি দেখা যায় এমন এক নতুন ব্যবস্থা গড়ে উঠল, যাতে সমাজের সবাই আগের মতো আছে, কিন্তু এক জন ব্যক্তির ক্ষতি হয়ে গেল, তা হলে বুঝতে হবে এই ব্যবস্থাটি কাম্য নয়। আগের ব্যবস্থাটি ভাল ছিল। অর্থনীতির পরিভাষায় একে বলা হয় ‘প্যারেটো অপটিম্যালিটি’। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা, শিক্ষাকর্মী, ছাত্র-ছাত্রী সকলকে মিলে এমন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে যাতে বর্তমান ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে। বর্তমান ঘটনা অবশ্যই মর্মান্তিক। দোষীদের শাস্তি হোক। তার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ পরিকাঠামো সুদৃঢ় ভাবে গড়ে উঠুক। এই ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আলোকিত প্রদীপের নীচে একটা অন্ধকার দিক উন্মোচিত করেছে। এই অন্ধকার দিকটিও যেন প্রদীপের আলোর দিকে আসে। এর জন্য সমস্ত বিভেদ ভুলে সবার আগে ছাত্রসমাজকেই এগিয়ে আসতে হবে। কারণ, তারাই বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল স্তম্ভ। সিসি ক্যামেরা থাক। কিন্তু এটাই সব নয়। শেষে প্রবন্ধকারের ভাষায় আমাদেরও দাবি, “শুধু সচেতনতা নয় চাই স্বচেতনতা।”
সুদেব কুমার ঘোষ, মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
শৃঙ্খলা চাই
অনুরাধা রায়ের অকপট স্বীকারোক্তি, “আমার মতো কেউ কেউ হয়তো জানতেনই না কতটা কী ঘটে চলেছে।” এই কথার মধ্যেই লুকিয়ে আছে র্যাগিং নামক ব্যাধির অন্তর্নিহিত বীজ। প্রশাসনিক অজ্ঞতা বা গাফিলতিই এর প্রধান কারণ। রোগের চিকিৎসার চেয়েও আগাম প্রতিরোধই সেরা পথ, তাই ‘শৃঙ্খলা মানেই শৃঙ্খলিত’ এই ভাবনা প্রথমেই দূর করতে হবে ছাত্র-ছাত্রীদের মন থেকে। প্রথম বর্ষের আবাসিক ছাত্র-ছাত্রীদের এমন ভাবে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে, সেখানে প্রশাসনিক ব্যক্তি ছাড়া আর অন্য কেউ বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করতে না পারেন। এর জন্য নজরদারি যেমন প্রয়োজন, তেমনই প্রয়োজন ছাত্র ও শিক্ষকদের নিয়ে ‘অ্যান্টি-র্যাগিং’ কমিটি গঠন করা। ছাত্র-ছাত্রীদেরও মনে রাখা প্রয়োজন, প্রত্যেকের সঙ্গে সু-আচরণের মনোভাব অন্তর থেকে না জন্মালে, সে কখনওই প্রকৃত শিক্ষিত হতে পারে না। এই ‘স্বচেতনা’ প্রত্যেকের মধ্যেই জাগ্রত হলে, নিজ ক্ষমতার অপব্যবহারের দিক নিয়ে সকলেই সচেতন হবে, এটুকু আশা করা যায়।
অশোক দাশ, রিষড়া, হুগলি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy