Advertisement
E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: বিষবৃক্ষের লালন

ভারতীয় ভূখণ্ডের ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা কিংবা পঞ্জাব সীমানা বরাবর পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্বাস্তু সমস্যাকে কোনও ভাবেই দক্ষিণ আমেরিকা অথবা উত্তর আফ্রিকার উদ্বাস্তু সমস্যার সঙ্গে এক করলে চলবে না।

শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০২৫ ০৭:১৭
Share
Save

মোহিত রায়ের ‘অস্তিত্ব রক্ষার দায়ে’ (২৬-২) প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। উদ্বাস্তু সমস্যা যে কোনও দেশের পক্ষেই খুব গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে যে দেশগুলোয় আন্তর্জাতিক সীমারেখা নির্ধারণের পর এক বস্ত্রে সম্বলহীন অবস্থায় রাতারাতি অধিবাসীরা প্রাণভয়ে ফেরার হয়ে যান। আমাদের ভারতীয় ভূখণ্ডের ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা কিংবা পঞ্জাব সীমানা বরাবর পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্বাস্তু সমস্যাকে কোনও ভাবেই দক্ষিণ আমেরিকা অথবা উত্তর আফ্রিকার উদ্বাস্তু সমস্যার সঙ্গে এক করলে চলবে না। এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে মনে রাখতে হবে, দেশভাগ জনিত কারণে গোটা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে এবং পঞ্জাব ও উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে যে সমস্ত সঙ্কট অথবা অসুবিধা দেখা গিয়েছে, তা মূলত সাম্প্রদায়িক। এই দ্বিজাতিতত্ত্বের বিষবৃক্ষটিকে আমরা সমূলে উৎপাটন না করে সযত্নে লালনপালন করে একেবারে মহীরুহে পরিণত করে ফেলেছি। সহাবস্থানের মাধ্যমে আমাদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা গড়ে উঠতে পারত, সে কথা আমরা বেমালুম বিস্মৃত হয়ে একে অন্যের শত্রুতে পরিণত হয়েছি।

যে মানুষটি সর্বস্ব হারিয়ে অজানা পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন, কস্মিন্‌কালেও যাঁর মধ্যে ছিল না জাতপাতের দ্বন্দ্ব, তাঁরও মনে বিষ ঢোকাচ্ছে রাজনৈতিক কারবারিদের কুচক্র। ভিটেমাটি ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা উদ্বাস্তু পরিবারের অন্তরের ব্যথার কথা কি জানেন রাজনৈতিক নেতারা? হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আমরা যতটা সরব, আমরা কি এক বারও ততটা সরব তাঁর পতনের প্রকৃত কারণ সম্পর্কে? যে রাজনৈতিক গোষ্ঠী পূর্ণ জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হল, তার জনসমর্থন ছয় মাসের মধ্যে কর্পূরের মতো উবেই বা গেল কেন? এটাই কি গণতন্ত্র? এ প্রশ্নের কী জবাব দেবে ইউনূস সরকার?

ভারতীয় ভূখণ্ডের অংশ হিসাবে স্বাধীনতা আন্দোলনের একটা পর্যায়ে বাংলাদেশের ভূমিকা রয়েছে, তাকে অস্বীকার করা অসম্ভব। তবুও পূর্ব পাকিস্তান পর্বে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধন ভুলে রাজনৈতিক কারবারিদের হীন স্বার্থের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছি আমরা। বৈরিতার মুখোমুখি হয়ে এত দিনের অন্তরের বন্ধনকে সুদৃঢ় করতে পারিনি। ক্ষমতার পরিবর্তন হলেও সামগ্রিক পরিস্থিতি কিন্তু নিয়ন্ত্রণে আসেনি। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ হয়তো কখনও এগিয়ে এসে রাজনীতি আর ধর্মকে আলাদা করবেন, এই আশাটুকু বেঁচে থাকুক।

রাজা বাগচী, গুপ্তিপাড়া, হুগলি

ভিটের মায়া

মোহিত রায়ের ‘অস্তিত্ব রক্ষার দায়ে’ পাঠান্তে দু’টি অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করতে চাই। প্রথমত, ভিটেমাটির টান এক অদ্ভুত টান। আমার এক বাল্যবন্ধুর দাদা শৈশবে মা-বাবার হাত ধরে এ দেশে এসেছিলেন উদ্বাস্তু পরিচয়ে। পরিণত বয়সে ‘দেশের বাড়ি’ পাবনার গ্রামে গিয়ে তাঁদের বাড়ির মাটি বয়ে নিয়ে এসেছিলেন। আজও আবেগের আবেশ ও যোগ্য মর্যাদার সঙ্গে ওঁদের পরিবারে সেই মাটি রক্ষিত।

দ্বিতীয়ত, আমার বাবা চাকরি থেকে অবসরের পরে পাসপোর্ট-ভিসা করে ঢাকার রাজফুলবেড়িয়া গ্রামে মা-কে সঙ্গে নিয়ে পাড়ি দিয়েছিলেন ফেলে আসা ভিটেমাটির টানে। ভাঙা বুকে দেশ ছাড়ার চার দশক পরে। সেই সময়ে প্রাচীর-ঘেরা সেই বাড়িতে এক টেক্সটাইল কারখানা। নিজের বাড়ি চিনতে পেরে বাবা সহসা যেন শিশু, চিৎকার করে বারে বারে বলছিলেন, “এই দেখো আমাদের বাড়ি।” প্রসঙ্গত, আমার মা-বাবার বিয়ে দেশভাগের পরে এ দেশে হয়েছিল, ফলে মা তাঁর ‘দেশের শ্বশুরালয়’ দেখার কোনও সুযোগ পাননি। বাবার মুখে তাঁর দেশের গল্প বহু বার শুনেছি আমি। আমার পুত্র একই কাহিনি শুনেছে আমার থেকে। সে একাই রওনা হয়েছিল ওর পূর্বপুরুষের ভিটেমাটির টানে। ২০২৩-এর জানুয়ারির এক দুপুরে পৌঁছেও যায় রাজফুলবেড়িয়ায়। কিন্তু জানতাম, তৃতীয় প্রজন্মের পক্ষে ভিটেদর্শনের অভিযানে সফল হওয়া সম্ভব নয়। হয়ওনি।

উদ্বাস্তুদের মধ্যে যাঁরা এই বাংলায় ঠাঁই করে নিতে পারেননি, বাধ্য হয়ে যেতে হয়েছে ভারতের অন্য কোনও প্রদেশে, তাঁরা আরও হতভাগ্য। শিক্ষা, সংস্কৃতি, ভাষা ও যাপনে আজ তাঁরা কতটুকু বাঙালি? লেখকের সঙ্গে দ্বিমতের কোনও জায়গা আছে?

ও-পারে, পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশ ভূখণ্ডের নাম যখন যা-ই হোক, সংখ্যালঘু পরিচয়ের হিন্দুদের উপরে অনাচারের নানা ইতিহাস রয়েছে। কিন্তু কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার— সবাই কেমন যেন নির্বিকার। ৭৮ বছর ধরে একই পরম্পরা চলছে। আওয়াজ তোলার সব দায় কি সমাজমাধ্যমের? এ দেশের উদ্বাস্তু বাঙালি হিন্দুদের উদ্বেগ কি গুরুত্বপূর্ণ নয়?

বিপ্লব গুহরায়, পাবনা কলোনি, নদিয়া

হারিয়ে ফেলছি

ভিটেছাড়া মানুষের উৎকণ্ঠা নিয়ে ‘অস্তিত্ব রক্ষার দায়ে’ শীর্ষক প্রবন্ধ‌টি পড়লাম। নিজের ভিটেমাটি থেকে উদ্বাস্তু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন বাসভূমিতে মানুষের ভাষা-সংস্কৃতিও লুপ্ত হতে শুরু করে। কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ক্ষেত্রে হোক বা সিন্ধু, পার্সি, বাঙালিদের ক্ষেত্রে— সবেতেই একই কথা প্রযোজ্য। প্রত্যেক মানুষই চায় তার ভাষা, সংস্কৃতিকে সযত্নে আঁকড়ে বেঁচে থাকতে। কিন্তু নতুন বাসস্থানের সংখ্যাগুরুর গ্রাসে কখন যে নিজের ভাষা মিলিয়ে যেতে শুরু করে তা সে নিজেও জানে না। আক্ষেপ থাকলেও করার কিছুই থাকে না। ১৯৯০ সালে এক বস্ত্রে উদ্বাস্তু হওয়া কাশ্মীরি পণ্ডিতদের পঁয়ত্রিশ বছর পরেও স্বগৃহে ফিরতে না পারা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা বিলোপের পরও, কেন্দ্রে বিজেপি সরকার আসীন থাকা সত্ত্বেও তাঁরা ফিরতে পারেননি।

পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জেলা, অঞ্চল থেকে যাঁরা উদ্বাস্তু হয়ে পশ্চিমবঙ্গে এসে বসবাস করছেন তাঁরা কলকাতার বাংলা ভাষার পাশে নিজের অঞ্চলের ভাষাটি কি বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছেন? শুধু যে ভাষা হারিয়ে গিয়েছে, তা কিন্তু নয়। হারিয়ে গিয়েছে নানা লোকজ রীতি, আচার, সংস্কৃতি। তবে শুধু উদ্বাস্তু হলেই নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতি আগ্রাসনের মুখে পড়ে না। একটি অঞ্চলে যখন অন্য রাজ্যের বাসিন্দাদের আধিক্য বেড়ে যায়, তখনও সেখানে আপন ভাষা, সংস্কৃতি বিপন্ন হয়ে পড়ে। এখন আমি যে পাড়ায় থাকি সেখানেও ঘর থেকে বেরোলেই হিন্দি, গুজরাতি ভাষা কানে আসে। আগে পাড়ায় কত বাংলা গানের জলসা হত, নাটক হত। দুর্গাপুজোয় সবার প্রাণবন্ত অংশগ্রহণ ছিল। রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত জয়ন্তী হত, বিজয়া সম্মেলনী হত। আজ সব হারিয়ে গেছে অন্য সংস্কৃতির আগ্রাসনে। এ বড়ই বেদনার। প্রত্যেক নাগরিকের নিজ নিজ এলাকায় নিজ নিজ ভাষা, সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখার অধিকার আছে। সেই অধিকার রক্ষার কোনও দায়ই কি নেই রাজ্য কিংবা কেন্দ্রীয় সরকারের?

অতীশচন্দ্র ভাওয়াল, কোন্নগর, হুগলি

ভাগ্যহীন

মোহিত রায়ের ‘অস্তিত্ব রক্ষার দায়ে’ প্রবন্ধ প্রসঙ্গে কিঞ্চিৎ খেদোক্তি। ইংরেজরা সাইপ্রাস, প্যালেস্টাইন, আয়ারল্যান্ডের মতো ভারতকে ভাগ করে দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের সেনানীদের উপর প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল। হলও তা-ই। তৎকালীন নেতারা দেশভাগের প্রস্তাব মেনে নিলেন। আমরা আমাদের মায়ের দেহটাকে দু’টুকরো করে দিলাম।

ফলে যে ভারত পাকিস্তান বাংলাদেশের সামগ্রিক প্রাকৃতিক সম্পদ, বিশাল মানবসম্পদের বলে জগৎসভায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার কথা ছিল, ধর্মনিরপেক্ষ শাশ্বত শান্তির নীড় রচনার কথা ছিল, তার হতভাগ্য কোটি জনতা এখন পরস্পরের মধ্যে লড়াই করে দিন কাটাচ্ছে। আর সব ক্ষেত্রেই ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে।

তৈয়েব মণ্ডল, গাজিপুর, হুগলি

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Immigrants Refugees

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}