ইজরায়েল নয়। উদ্যান পালন দফতরের আঙুর বাগিচায় বিন্দু সেচ। তালড্যাংরা, বাঁকুড়া। ছবি: উমাকান্ত ধর।
যুদ্ধটা জিতেই গেল ইজরায়েল। যাতে মানুষ মারা পড়ে, তেমন যুদ্ধ নয়। পড়শি দেশগুলোর সঙ্গে ইহুদিদের সে যুদ্ধ আরও একশো বছর চলতে পারে। ইজরায়েল জিতেছে জল বাঁচানোর যুদ্ধে। অতি সামান্য জলে প্রচুর ফলন করে দেখিয়ে দিয়েছে। বিন্দু সেচ (ড্রিপ ইরিগেশন) প্রযুক্তি, যার উদ্ভাবন ও প্রয়োগে ইজরায়েল বিশ্বে পথিকৃৎ, এ বছর পড়ল ৫০ বছরে। চিন, ভারত, রাশিয়া, যে সব দেশে বড় বড় নদীর অভাব নেই, তারাই এখন চাষ শিখতে আসে এই মরুভূমির দেশে। তিন বছর অন্তর রাজধানী টেল আভিভ-এ কৃষিপ্রযুক্তির যে প্রদর্শনী (অ্যাগ্রিটেক) হয়, এ বছর এপ্রিলের শেষে (ওখানে এখনও বসন্ত) তা জমজমাট হয়ে উঠেছিল আফ্রিকা, এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকার নানা দেশের ভিড়ে। ভারতের মহারাষ্ট্র, গুজরাত, কর্নাটক থেকে চাষিরা এসেছিলেন। কনফারেন্স সেন্টারে ঘন রঙের কোট-টাইয়ের ভিড়ে গাঁধী-টুপি, পিরান-ধুতির দল যেন ছোট ছোট চলন্ত সাদা দ্বীপ।
তা দেখে ভারী তৃপ্ত ন্যাটি বরাক। আধুনিক বিন্দু সেচ প্রযুক্তি গোটা বিশ্বে বিক্রি করে তাঁর সংস্থা, ‘নেটাফিম’। এলোমেলো সাদা চুলে হাত বুলিয়ে বরাক বললেন, ‘প্রথমটা বিন্দু সেচ কাজে লাগাতেন ধনী দেশের ধনী চাষিরা। ওয়াইনের জন্য আঙুর, পেস্তা, গ্রিন হাউসে দামি সবজি, ফলের জন্য। এখন কিন্তু তা বেশি কাজে লাগছে তৃতীয় বিশ্বে, আলু, ভুট্টা, ধান, গম, কাসাভার চাষে।’ ভারতে বিন্দু সেচ বেশি হয় তুলো আর আখ চাষের ক্ষেত্রে। মহারাষ্ট্রের একটি গবেষণা বলছে, সাবেকি সেচের চাইতে বিন্দু সেচে আখের ফলন বাড়ে ২৩ শতাংশ, জল বাঁচে ৪৪ শতাংশ, বিদ্যুৎ বাঁচে প্রতি হেক্টরে ১০৫৯ কিলোওয়াট।
খেত জুড়ে জল দিলে (ফ্লাড ইরিগেশন) যত জল লাগে, বিন্দু সেচ পদ্ধতিতে লাগে তার এক-তৃতীয়াংশ, বা তারও কম। খেতের উপর জলের পাইপের ‘জাল’ এমন ভাবে বিছিয়ে দেওয়া হয়, যাতে পাইপের গায়ের ফুটোয় লাগানো মুখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ে ঠিক গাছের উপর। যতটুকু জল প্রয়োজন, ঠিক ততটুকুই পড়ে, আর তা যায় একেবারে শিকড়ে। জলের সঙ্গে মিলিয়ে দিলে সারও সে ভাবেই শিকড়ে পৌঁছে যায়। জল, সার, তেল-বিদ্যুতের খরচ, মজুরি বাঁচে, উৎপাদনও বাড়ে। যে জমিতে জলের অভাবে সেচ হয় না, বিন্দু সেচ দিলে সেই জমিও দোফসলি, তেফসলি জমি হয়ে উঠতে পারে। এ রাজ্যে অন্তত চারটে জেলা, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর এবং বীরভূমে চাষের ছবি বদলে যেতে পারে, বলছেন ক্ষুদ্র সেচ দফতরের কর্তারা।
কিন্তু কেবল এক টুকরো প্রযুক্তিকে তুলে এনে এ দেশে বসিয়ে দিলে কাজের কাজ হবে কি? ইজরায়েলের চাষবাস দেখে সেই প্রশ্নটাই বার বার খোঁচা দেয়। এ দেশে যে আবেগে মানুষ পুজো-পরবে নির্জলা উপোস করে, তেমনই নিবেদিত হয়ে ওঁরা জল বাঁচান। পঞ্চাশের দশকে এক ইহুদি নেতা কুড়ুল দিয়ে টয়লেটের ‘ফ্লাশ’ ভেঙে দিয়েছিলেন, পশ্চিমী কেতায় বিলাসী অপব্যয় ঠেকাতে। ‘যেমন দরকার তেমন, যতটুকু দরকার, ততটুকু’, এই হল ওঁদের জীবনদর্শন। যার মূল কথা, ‘মাইক্রো-ম্যানেজমেন্ট’। ষাটের দশকে ইজরায়েলের এক বাণিজ্যমন্ত্রী নাকি এক একটি কারখানার জন্য ডলারের এক এক রকম বিনিময়মূল্য চালু করেছিলেন।
চাষের ক্ষেত্রে ‘মাইক্রো’ পদ্ধতি স্পষ্টতই এসেছে ইহুদি চাষিদের জীবনযাত্রা থেকে। সেখানে চাষ চালায় প্রধানত ‘কিবুৎজ’। এ হল রুশ কমিউনের মতো। যেখানে জমি, বাড়ি, গাড়ি কোনও কিছুর মালিকানা ব্যক্তির নয়, সব কিবুৎজের। চাষি পরিবারের কেউ অন্য সূত্রে রোজগার করলে সবটা জমা পড়ে কিবুৎজে। যেমন ন্যাটি বারাকের স্ত্রী সাইকোলজিস্ট। তাঁর প্র্যাকটিস-প্রাপ্ত টাকার সবটাই যায় কিবুৎজে। সেখান থেকে যাকে যতটুকু দরকার, ততটুকু টাকা দেওয়া হয়। যিনি কিবুৎজের মার্কেটিং ম্যানেজার, আর যিনি কিবুৎজের রাস্তা ঝাঁট দেন, সবাই নিজের প্রয়োজন অনুসারে সমান হারে টাকা পান।
যেমন মানুষ, তেমনই গাছও। জমিতে বালি বেশি না কাদা, জলে খনিজ বেশি না কম, আবহওয়া গরম না ঠান্ডা, তা দেখে ঠিক হয় প্রতি বিন্দু সেচে ঘণ্টায় ক’ফোঁটা জল পড়বে। পাইপে কত দূরত্বে ছিদ্র, তা ঠিক হবে কোন ফসল তা দেখে। ফসল ওঠার পরেও কী ভাবে সংরক্ষণ করলে সব চাইতে কম অপচয় হয়, কোন বাজারে বিক্রি করলে সব চাইতে বেশি দাম মেলে, তার খোঁজ চলে। কত কম থেকে কত বেশি পাওয়া সম্ভব, প্রতি দিন তার সাধনা চলছে। যার সাধন প্রযুক্তি। এক ফোঁটা জলের জায়গায় দু’ফোঁটা কিছুতেই দেবে না ইজরায়েল। কিন্তু দু’ফোঁটার কাজ কী করে আধফোঁটায় করা যায়, তা বার করতে অকাতরে টাকা খরচ করবে রিসার্চে। গোটা টেল আভিভের সমস্ত ব্যবহৃত জল, মায় পয়ঃপ্রণালীর জলও পরিস্রুত করে ফের ব্যবহার করা হয়। তার ৮০ শতাংশ পান চাষিরা।
১৯৯৯ থেকে ২০০৯, এই এক দশকে ইজরায়েলে চাষিরা জলের ব্যবহার ১২ শতাংশ কমিয়েছেন, ফলন বাড়িয়েছেন ২৬ শতাংশ। সেই সঙ্গে ‘লেবার’-এর প্রয়োজনও কমেছে। চাষির সংখ্যা সাড়ে ২৩ হাজার থেকে কমে এখন ১৭ হাজার। জনসংখ্যার মাত্র ২ শতাংশ চাষ করে, তাতেই গোটা দেশের খাবারের চাহিদার ৯৫ শতাংশ মিটে যায়, আবার ফল, সবজি, রফতানিও হয় ইউরোপের নানা দেশে।
এ যে গল্পের গরু নয়, মালুম হল সত্যি গরু দেখে। টেল আভিভ থেকে মিনিট চল্লিশের দূরত্বে এক ডেয়ারি ফার্মে দুগ্ধবতী গাভী, বাছুর নিয়ে দু’হাজার প্রাণী। দেখাশোনা করেন ২০ জন। দিনে এক একটা গরু দুধ দেয় ৭২ কিলোগ্রাম অবধি, গড়ে ৪১ কিলোগ্রাম। গরু-পিছু দুধ উৎপাদনে বিশ্বে সেরা ইজরায়েল। দুধ (মেশিনে) দোওয়ার পর তা পাইপে যাওয়ার আগে একটি যন্ত্র বিশ্লেষণ করে বলে দেয়, কতটা ল্যাকটোজ, ফ্যাট, প্রোটিন, ইউরিয়া আছে তাতে। সংক্রমণের ফলে দুধে রক্ত এলে আপনিই বন্ধ হয়ে যাবে দোওয়ার যন্ত্র। বারোশো গাভীর প্রতিটির সামনের ডান পায়ে লাগানো ‘মনিটর’ থেকে অন্তত ১০০টি ডেটা নিরন্তর বলে দিচ্ছে, কোন গরু কেমন আছে, কার কী চিকিৎসা, পরিচর্যা দরকার। কাছে গিয়ে দাঁড়ালেই আহ্লাদি ভঙ্গিতে ভিজে নাক বাড়িয়ে দেয় সাদা-কালো ইজরায়েলি হলস্টেইন। নাকে হাত রেখে মনে হয়, কেন ভারতে এমন হয় না?
সমস্যাটা ঠিক প্রযুক্তির নয়। কৃষি গবেষণা, প্রযুক্তিতে ভারত কম যায় না, তার প্রমাণ সবুজ বিপ্লব। তফাত মনে হয় এখানেই যে, ও দেশে ল্যাবরেটরির কাজ থেকে চাষির ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা জমা না পড়া পর্যন্ত ‘চাষ’ নামক কাজটি চলতে থাকে। আর এখানে বিজ্ঞানী চাকরি করেন, ফড়ে ব্যবসা করেন, চাষ করেন কেবল চাষি। চাষির ক্ষতি হলেও ব্যবসায়ীর লাভ, আর বিজ্ঞানীরা ফসলের বাজারদর জানেনই না। চাষ করে লাভ হল কি না, সে প্রশ্নে ও দেশে সবাই তটস্থ। এ দেশে লাভ-ক্ষতি চাষির ভাগ্যের ব্যাপার।
চাষিও তা-ই বিশ্বাস করেন। তাই লাভ অনিশ্চিত জেনেও আড়াই-তিন বিঘে জমি চাষ করেন তিনি, তবু সমবায় তৈরি করে অনেকের জমি একসঙ্গে চাষ করে খরচ কমিয়ে লাভ বাড়ানোর চেষ্টা করেন না। আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির কোনওটাই ছোট চাষির জন্য নয়, জেনেও জোট বাঁধতে পারেন না। স্বনির্ভর হওয়ার চাইতে সরকার-নির্ভর হওয়া তাঁদের নিরাপদ মনে হয়।
সরকারও তাই চায়। এ দেশে চাষি আর বাজারের মাঝখানে সরকার। কম সুদে ঋণ, ভর্তুকিতে (কিংবা বিনামূল্যে) জল, বিদ্যুৎ, সার। শেষ অবধি ন্যূনতম মূল্যে খরিদ। ও দেশে চাষির সামনে বাজার, পিছনে সরকার। ইজরায়েলের চাষি জল, বিদ্যুৎ সব কেনেন বাজারদরে। ভর্তুকির কোনও ধারণাই চালু নেই। কৃষিমন্ত্রী ইয়ায়ের শমির বললেন, ‘প্রাইভেট সেক্টর যাতে সারা বিশ্বে বাজার ধরতে পারে, তার জন্য সহায়তা করে সরকার।’ এ দেশে সরকার প্রতিযোগিতা থেকে আড়াল করে চাষিকে, ও দেশে প্রতিযোগিতায় জেতাতে চাষিকে পিছন থেকে ঠেলে সরকার। এমনকী ক্রেতার স্বার্থেও চাষিকে দাম কমাতে বলে না ইজরায়েল। ইজরায়েলে উৎপন্ন ফসলের দাম সে দেশের চাইতে জার্মানিতে বেশ খানিকটা কম কেন, ক’দিন আগে তা নিয়ে খানিক বিক্ষোভও হয়ে গিয়েছে টেল আভিভে। দাম অবশ্য কমেনি।
কৃষি না শিল্প, আমাদের এই নিয়ে বিতর্ক। ইজরায়েলে প্রশ্নটাই অর্থহীন। লাভজনক কৃষি আসলে শিল্পই। দুটোর উৎপাদন, বিপণন হতে হবে এক নীতিতে। এ কথাটা হজম না করে কেবল মেশিন, প্রযুক্তি আনলে জল হয়তো একটু বাঁচবে, চাষি বাঁচবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy