মানী ব্যক্তির অমর্যাদা করিলে নিজেরই সম্মানহানি হয়, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভুলিয়াছেন। তিনি ছাত্রছাত্রীদের সম্মুখে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের ‘জবাব’ তলব করিলেন। এমনকী রাজনৈতিক বিরোধীদের দ্বারা উপাচার্য প্রভাবিত হইতেছেন, এমনও ইঙ্গিত করিলেন। ইহা যেমন অশোভন, তেমনই অন্যায়। বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা। তাহার শীর্ষ কর্তৃত্ব উপাচার্যই। সর্বসমক্ষে তাঁহার কাজের মূল্যায়ন করিবার, জবাবদিহি চাহিবার ক্ষমতা মুখ্যমন্ত্রীর নাই। যদি মুখ্যমন্ত্রী তথা প্রশাসনের কিছু জানিবার থাকে, তাহার নির্দিষ্ট পদ্ধতি রহিয়াছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কর্তব্যে অবহেলা ঘটিলে পদক্ষেপ করিবারও উপায় আছে। প্রকাশ্যে তাহার উত্তর দাবি করা কখনওই তাহার উপায় নহে। কিন্তু ইহাও নিতান্ত বিধির আলোচনা। শোভনতার বিচার বলে, প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষককেও তাঁহার ছাত্রদের সম্মুখে অপমান করা একান্ত গর্হিত কাজ। প্রশাসনিক বৈঠকে রুদ্ধ দ্বারের পশ্চাতে প্রশাসনের কর্তারা অধস্তনদের জবাবদিহি চাহিতে পারেন। কিন্তু সর্বসমক্ষে, বিশেষত অধস্তনদের সম্মুখে কোনও দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে অভিযোগের জবাব দিতে বলিলে তাহাতেই তাঁহার মর্যাদা লঙ্ঘন হয়। উত্তর গ্রহণযোগ্য কি না, সে প্রশ্নের আর মূল্য থাকে না। এ কথাগুলি কোনও প্রাপ্তমনস্ক মানুষের না বুঝিবার কথা নয়। বিশেষত যাঁহারা প্রশাসনে এবং জনজীবনে দীর্ঘ দিন রহিয়াছেন, তাঁহাদের নিকট এই মূল্যবোধ প্রত্যাশিত।
দুঃখের বিষয়, এ রাজ্যের মন্ত্রী-আমলারা নিয়মবিধি এবং শোভনতার সীমা অতিক্রম করিতে অভ্যস্ত হইয়া পড়িয়াছেন। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী একাধিক বার নানা প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্তাদের অসম্মান করিয়াছেন। তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে বিলম্ব হওয়ায় বাঙুর ইনস্টিটিউট অব নিউরোলজির অধিকর্তা চিকিৎসককে তিনি সাসপেন্ড করিয়াছিলেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদত্যাগ করিবার সংবাদ মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং ছাত্রদের নিকট ঘোষণা করিয়াছিলেন। প্রতিটিই স্বাধিকারের সীমা লঙ্ঘনের দৃষ্টান্ত। মুখ্যমন্ত্রীর অনুগামীরাও বিভিন্ন উপলক্ষে কলেজ বা স্কুলে শিক্ষকদের মর্যাদাহানি করিতে দ্বিধা করেন নাই। মুখে তাঁহাদের নিষেধ করিলেও, উপাচার্যের অসম্মান করিবার মতো কাজ বার বার করিয়া বিপরীত নজির স্থাপন করিতেছেন মুখ্যমন্ত্রী। শ্রদ্ধেয় ব্যক্তির অসম্মানের রীতি এক বার শুরু হইলে তাহার অবসান ঘটানো কঠিন। তাহার কারণ, অপদস্থ করিবার এমন সহজ অথচ কার্যকর উপায় আর নাই।
দায়বদ্ধতা ও তৎপরতা নিশ্চিত করিবার উপায় অপমান নহে। সক্রিয়তা, স্বচ্ছতা চাহিলে গোটা কার্যব্যবস্থাটিকেই সক্রিয় করিতে হইবে। গোটা ব্যবস্থাটি উজ্জীবিত হইলে তাহা সামাল দিতে মন্ত্রীদের প্রয়োজন হইবে না। মুখ্যমন্ত্রীকেও সকল বিষয়ে প্রকাশ্যে হস্তক্ষেপ করিতে হইবে না। সুনির্বাচিত ব্যক্তিদের দায়িত্ব দেওয়া, এবং তাহাদের সহায়তা করা প্রয়োজন। শীর্ষ কর্তাদের প্রকাশ্য তিরস্কার করিয়া কী লাভ? তাহাতে দেখনদারি অধিক। মুখ্যমন্ত্রী অতি কঠোর, কাহারও ফাঁকি দিবার উপায় নাই— জনসমক্ষে তাহা প্রতিষ্ঠা করিতে উপাচার্যকে সম্মান বিসর্জন দিতে হইবে কেন? অসংযত এবং অশোভন আচরণ যথার্থ উত্তম প্রশাসকের পরিচয় নহে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy