২০১৪-এ ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর তথ্যানুসারে, সারা দেশে মেয়েদের ওপর ঘটে-যাওয়া অপরাধের ১১ শতাংশ ঘটেছে পশ্চিমবঙ্গে। এর মধ্যে যৌন নির্যাতনও আছে। এ রাজ্যে ২০১৪ সালে লিপিবদ্ধ যৌন অপরাধের ঘটনার সংখ্যা ৯৩৩৫, আর অপরাধের মাত্রা হল ২০.৮ শতাংশ। এর বাইরেও অসংখ্য মেয়ে আছেন, যাঁরা থানা-পুলিশ পর্যন্ত পৌঁছতেই পারেন না। ঘরের মধ্যে এবং পথে মেয়েরা অবিরত যে যৌন হেনস্থার মুখোমুখি হন, তাও সচরাচর ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর গোচরে আসে না।
কেন এই দুরবস্থা মেয়েদের? কান পাতলে নানা ‘কারণ’-এর কথা শোনা যায়। মেয়েরা বড় বেশি পথেঘাটে দৃশ্যমান হচ্ছেন! মেয়েরা দশটা-পাঁচটার বাইরেও চাকরিতে মনোযোগী হচ্ছেন! স্বাধীন ভাবে চলাফেরা করছেন, ফুর্তি করছেন! কিন্তু এতে কার কী ক্ষতি? ঘরের বাইরে জীবনে মেয়েদের ভাগীদারিতে অসুবিধে কোথায়? অসুবিধে আছে। অসুবিধে আমাদের মনে, অসুবিধে ক্ষমতার ভাগাভাগিতে। রাজপথে, গলিপথে, আমজনতার যানবাহনে মেয়েদের আবার কীসের দখলদারি? অফিসটাইমে লোকাল ট্রেনে বা বাসে মেয়েদের ওঠার কী দরকার? যদি-বা ওঠে, তা হলে বুকের কাছে ঢাল হিসেবে ফাইল, খাতা অথবা ব্যাগ আঁকড়ে ধরে থাকা মেয়েদের সেই যে জড়সড় মূর্তি, সে গেল কোথায়? অফিসকাছারি, সিনেমা-থিয়েটার, আমোদপ্রমোদেই বা মেয়েরা কেন? পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের পীঠস্থান ভারতবর্ষ এবং তদীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে সরকার, বিরোধী দলগুলি, সাধারণ মানুষ, অনেকেই এমন চিন্তা করেন! তাঁরা কম-বেশি মেয়েদের ‘অতি বাড়’-এ অখুশি। ক্ষুব্ধও। সে ক্ষোভের প্রকাশ হয় মাতৃভূমির ওপর হামলায়! মজার অছিলায় যৌন অত্যাচারে!
একটা কথা স্বীকার করা দরকার যে, যৌন অত্যাচার বন্ধের জন্য কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপও দেখা যাচ্ছে। আইনি পরিভাষায় এখন ‘ইভ টিজিং’ শব্দটি অন্তত লিখিত ভাবে বন্ধ হয়েছে। পথেঘাটে মেয়েদের ‘বাঁচানো’র জন্য সরকার নানারকম পরিকল্পনা করছে। মেয়েদের জন্য সাহায্য-ফোন চালু হয়েছে। ‘ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার’-এর ব্যবস্থা হচ্ছে। ফৌজদারি আইন সংশোধনী (২০১৩) অনুযায়ী, কোনও পুরুষ কোনও মহিলার আপত্তি সত্ত্বেও যদি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ, পিছু নেওয়া ইত্যাদি করে, তাকে যৌন হেনস্থা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, শাস্তিও বরাদ্দ আছে। রাষ্ট্রপুঞ্জ মেয়েদের ওপর যৌন হেনস্থা বন্ধের জন্য ছেলেদের এগিয়ে আসতে বলছে। ‘হি ফর শি’ এখন জগৎবিখ্যাত প্রচারান্দোলন।
হাওয়ায় অন্য একটি যুক্তিও ভাসছে। গত কয়েক দশকে মেয়েদের তরতরিয়ে সম্মুখপানে এগিয়ে যাওয়ার ফলেই নাকি ছেলেরা খুউব অনিশ্চতায় ভুগছেন! আর সেই জন্যই তাঁরা এমন লাগামছাড়া অত্যাচারে মেতেছেন! আর তাঁদের হিংসামুক্ত করার জন্য, তাঁদের অহমকে তোল্লাই দেওয়ার জন্যই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নেতৃত্বে রাস্তার মোড়ে মোড়ে শহরতুতো বোনেরা তাদের অটোচালক ভাইদের অটো থামিয়ে রাখি পরালেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও রক্ষাবন্ধনে সারা দেশের বোনেদের ‘রক্ষা’ করার জন্য যুবকদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানালেন। মেয়েরা ‘রক্ষা’ চান কি না, সে পরামর্শ মেয়েদের সঙ্গে কেউ করলেন না!
অন্য দিকে, ছেলেদেরও কেউ একটু বুঝিয়ে বললেন না, অনুদরতাকে আহ্লাদ দিলে কোনও যথার্থ পরিবর্তন হয় না। সত্যিকারের পরিবর্তনের জন্য রোজ গণতন্ত্রের পাঠ নেওয়া প্রয়োজন। দুঃখের কথা হল, আমরা গণতন্ত্র বলতে খালি ভোটের উৎসব বুঝি। আমাদের মধ্যে প্রকৃত গণতন্ত্রের বোধ ক্রমশ লুপ্ত হচ্ছে, সহিষ্ণুতার ক্ষয় হচ্ছে। ক্ষমতার ভাষা, ক্ষমতার দেহভঙ্গি পাশের বাড়ির মেয়েকেও পদানত করতে চাইছে। এমতাবস্থায় ‘রক্ষাবন্ধন’ করে ছেলেদের পাল্টানোর চেষ্টা দেখে হাসি পায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy