যে প্রাবল্য নিয়ে পদ্মাবত-এর বিরোধিতা শুরু হল নানা মহল থেকে, তা বেশ বিরল। ছবি: সংগৃহীত।
গন্তব্যটা ঠিক কী, কোথায় পৌঁছব আমরা এই পথে হাঁটতে থাকলে, নিজেরাও সম্ভবত জানি না আজ। শিল্প, সাহিত্য, সৃষ্টিশীলতার গলাটা এই ভাবে টিপে ধরা যায়? ভারতীয় সভ্যতার সুপ্রাচীন ইতিহাস কি এই একবগ্গা সংস্কৃতির সাক্ষ্য আদৌ বহন করে?
রক্ষণশীলতা ভারতীয় সমাজে বরাবরই ছিল, আজও রয়েছে। কিন্তু তার সমান্তরালেই তো চিরকাল প্রবহমান থেকেছে ভারতভূমির অসীম, উদার, উদাত্ত হৃদয়। সুদীর্ঘ পথ পাশাপাশি চলতে চলতে কোনও কোনও বাঁকে রক্ষণশীলতা আর উদারতার ভেদরেখাটা আবছাও হয়ে গিয়েছে। সেই ভারতে দাঁড়িয়ে এই একবিংশ শতাব্দীতে আমরা একটি ছবির মুক্তি নিয়ে যে অনন্ত এবং অসহ্য টানাপড়েন দেখছি, তাতে বিস্ময়ে অভিভূত হওয়া ছাড়া গতি থাকে না!
‘পদ্মাবতী’ রাজপুত সমাজের কাছে অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় চরিত্র, অতএব তাঁকে নিয়ে তৈরি ছবি কিছুতেই মুক্তি পেতে দেওয়া হবে না। নাম বদলে, দৃশ্য ছেঁটে, সংলাপ সরিয়ে, অসহনীয় সমঝোতা সূত্র মেনে নিয়ে সেন্সর বোর্ডের কাছ থেকে ছবি মুক্তির অনুমতি হয়ত শেষ পর্যন্ত মিলবে। কিন্তু তার পরেও সামাজিক বাধা আসবে, অশান্তির আগুন জ্বালিয়ে দেওয়ার শাসানি আসবে, গণ-আত্মাহুতির হুমকি শোনানো হবে আর রাজনীতি সে সব তর্জন-গর্জনের তল্পিবাহক হয়ে উঠবে।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
গণতন্ত্র, বাক স্বাধীনতা, নাগরিক অধিকারের কথা ছেড়েই দিচ্ছি। আদৌ সভ্য ও স্বাধীন সমাজে বাস করছি কি? প্রশ্নচিহ্নটা এখন সেখানেই।
অসীম বিবিধতা, অপার বৈচিত্র, অপরিমেয় সহনশীলতার জন্যই ভারতীয় সভ্যতা প্রখ্যাত গোটা বিশ্বে। সুবিশাল ভূভাগের ভিন্ন ভিন্ন প্রান্ত পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন রূপের সাক্ষী, ভিন্ন জীবনধারার সাক্ষী, ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন খাদ্যাভ্যাস, ভিন্ন সামাজিক রীতিনীতির সাক্ষী। অন্ধ ও অবান্তর ভাবাবেগ সেই বিবিধতাকে ক্রমশ গ্রাস করে নিতে চাইছে আজ।
আরও পড়ুন: ‘পদ্মাবত’ মুক্তি বন্ধ না হলে আত্মহত্যার হুমকি দিলেন রাজপুত মহিলারা
আরও পড়ুন: ভন্সালীর ছবি-মুক্তি রুখতে তাণ্ডব জারি করণী সেনার
পদ্মাবতীর আখ্যান নিঃসন্দেহে রাজপুত গরিমার আখ্যান। চলচ্চিত্রেও গৌরবজনক আলোকেই তুলে ধরা হয়েছে পদ্মাবতীকে। কিন্তু বিভিন্ন রাজপুত সংগঠন এখনও ছবির মুক্তি রুখতে চূড়ান্ত তত্পরতা দেখাচ্ছে। পদ্মাবতীর আখ্যান টডের বর্ণনায় যে ভাবে লিপিবদ্ধ বা রাজস্থানে মুখে মুখে ফেরে যে ধরনের আখ্যান, চলচ্চিত্রের সঙ্গে তার কিয়ৎ অমিল রয়েছে বলেই ধরে নেওয়া হবে এই ছবি রাজপুতদের জন্য অগৌরবজনক, এমনটা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক।
মহাকাব্য রামায়ণও দেশের নানা প্রান্তে পৌঁছে নানা রূপ নিয়েছে। কোথাও রামের চরিত্রকে ‘নেতিবাচক’ আলোকে দেখানো হয়েছে, কোথাও সীতা হয়ে উঠেছেন মহাকাব্যের মূল চরিত্র। কেন এই পরিবর্তন, তা নিয়ে বিতর্কের প্রয়োজন পড়েনি, পরিবর্তিত আখ্যান নিষিদ্ধ করার দাবিও তুলতে হয়নি।
শিল্প-সাহিত্যের অবাধ চর্চার পথে বাধা না হয়ে ওঠাই সভ্য সমাজের রীতি। সে রীতি আমরা সব সময় মেনে চলেছি, এমনটাও নয়। এর আগেও বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে শিল্পীর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের ঘটনা এ দেশে ঘটেছে। কিন্তু এ বার যে প্রাবল্য নিয়ে পদ্মাবত-এর বিরোধিতা শুরু হল নানা মহল থেকে, তা বেশ বিরল।
শিল্পীর স্বাধীনতায়, শিল্পের স্বাধীনতায় এ ভাবে হস্তক্ষেপ হতে থাকলে, ভবিষ্যত্ খুব আশাব্যঞ্জক নাও হতে পারে আমাদের জন্য। ভারতীয় ঐতিহ্যের কথা, শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি ভারতীয় সমাজের পৃষ্ঠপোষণার কথা মাথায় রেখেই বলছি, এই বিতর্কে এ বার ইতি টানা হোক। পদ্মাবত-এর নিঃশর্ত মুক্তি এবং নির্বিঘ্ন প্রদর্শনও হোক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy