এ বছর দুর্গাপুজোর তারিখ নিয়ে মতান্তর দেখা দিয়েছে। ভারত সরকারের ‘পজিশনাল অ্যাস্ট্রনমি সেন্টার’ থেকে প্রকাশিত ‘ইন্ডিয়ান অ্যাস্ট্রনমিক্যাল এফিমারিস’ ও ‘রাষ্ট্রীয় পঞ্চাঙ্গ’ নামক পঞ্জিকা অনুযায়ী সপ্তমীর তারিখ ২০ অক্টোবর, অষ্টমী ২১, নবমী ২২ এবং দশমী ২৩ অক্টোবর। পশ্চিমবঙ্গে প্রকাশিত বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকাও দুর্গাপুজোর জন্য এই তারিখগুলোই ফেলেছেন। ভারত সরকারের পঞ্জিকা এবং বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা উভয়েই দৃক্সিদ্ধ ও নির্ভুল তথ্য-সংবলিত। কিন্তু গুপ্ত প্রেস ও পি এম বাক্চি উভয়েই প্রাচীনপন্থী। এঁরা পুজোর সপ্তমী ও অষ্টমীর তারিখ দেখাচ্ছেন যথাক্রমে ২০ এবং ২১ অক্টোবর, কিন্তু নবমী ও দশমীর তারিখ দেখিয়েছেন একই দিনে ২২ অক্টোবর। দুর্গাপুজোর তারিখে এ রকম পার্থক্য কেন হবে?
হিন্দুদের অধিকাংশ পুজোপার্বণের তারিখ স্থির হয় চান্দ্রমাসের তিথি অনুযায়ী। এক অমাবস্যা থেকে ঠিক পরের অমাবস্যা পর্যন্ত সময়কে এক চান্দ্রমাস বলা হয়। চান্দ্রমাসের নাম কী ভাবে দেওয়া হয়? আমরা জানি, ১২টি সৌরমাস, যেমন— বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ় ইত্যাদি। এখন বৈশাখ সৌরমাসের মধ্যে সাধারণত কোনও না কোনও দিনে অমাবস্যা পড়বে, সেই অমাবস্যা থেকে যে চান্দ্রমাস শুরু হবে, তার নাম হবে চান্দ্র বৈশাখ। এই রকম করে ১২টি চান্দ্রমাস সাধারণত পাওয়া যায়। এই চান্দ্রমাসের গড় মান হল ২৯.৫৩ দিন। একে একটা পুরো সংখ্যা ৩০ ধরা হয়, আর এই চান্দ্রমাসকে যদি ৩০টি অংশে ভাগ করা যায়, তা হলে এরই এক-একটা অংশ হল তিথি। তার মানে, তিথিকে বলা যেতে পারে চান্দ্রদিন। অমাবস্যাকে আদি তিথি হিসেবে ধরা হয়, যখন চন্দ্র ও সূর্যের একত্র অবস্থান হয়। তার পরেই শুরু হয় শুক্লপক্ষের প্রতিপদ। চন্দ্র, সূর্যের সাপেক্ষে ১২ ডিগ্রি কৌণিক দূরত্ব অতিক্রম করলেই প্রতিপদের শেষ এবং শুক্ল দ্বিতীয়া তিথির আরম্ভ। এই রকম করে একটি চান্দ্রমাসে ৩০টি তিথি, ১৫টি শুক্লপক্ষীয় আর ১৫টি কৃষ্ণপক্ষীয়। তিথি কোনও তারিখের যে-কোনও সময়ে শুরু হতে পারে, দিনে অথবা রাতে। সাধারণত হিন্দু পঞ্জিকার যে-কোনও তারিখে সূর্যোদয়ের সময় যে তিথি চলছে, সেটাই সেই সৌরদিনের তিথি বলা গণ্য হবে। তিথির মান ২০ ঘণ্টা থেকে প্রায় ২৭ ঘণ্টা পর্যন্ত হতে পারে, তার কারণ হল চন্দ্রের জটিল গতি— চন্দ্র পৃথিবীকে কেন্দ্র করে এক উপবৃত্তাকার কক্ষপথে ঘুরে চলেছে, কিন্তু সেই কক্ষপথে তার গতি সব জায়গায় সমান নয়। তাই তিথির মানের এত তফাত।
ঋষিদের নির্দেশ অনুসারে, দুর্গাপুজোর সপ্তমীর তারিখ হবে চান্দ্র আশ্বিনের শুক্লপক্ষের সপ্তমী তিথিতে, অষ্টমী, নবমী ও দশমীও সেই অনুসারে। ভারত সরকারের রাষ্ট্রীয় পঞ্জিকায় চান্দ্র আশ্বিন মাসের শুক্ল সপ্তমী তিথি আছে ২০ অক্টোবর দুপুর ২ ঘণ্টা ২৩ মিনিট পর্যন্ত, অষ্টমী তিথি ২১ অক্টোবর দুপুর ১ ঘণ্টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত, নবমী তিথি ২২ অক্টোবর সকাল ১১ ঘণ্টা ৫৯ মিনিট পর্যন্ত, আর দশমী তিথি ২৩ অক্টোবর সকাল ৯ ঘণ্টা ৫২ মিনিট পর্যন্ত। জ্যোতির্বিজ্ঞানের তথ্য অনুযায়ী এ বছর ওঁদের দুর্গাপুজোর তারিখ এই ভাবেই পড়েছে, বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত শুদ্ধ পঞ্জিকা, ওঁরা এবং ভারতের সকল শুদ্ধ পঞ্জিকা ভারত সরকারের রাষ্ট্রীয় পঞ্জিকার তথ্যই প্রকাশ করেন। তাই ওঁরাও এই একই তারিখ দেখিয়েছেন।
গুপ্ত প্রেস ও পি এম বাক্চি পঞ্জিকার গণনায়, চান্দ্র আশ্বিনের শুক্ল নবমী তিথি আছে ২২ অক্টোবর সকাল ৭ ঘণ্টা ৩ মিনিট পর্যন্ত। তাই এই তারিখেই নবমীপুজো। কিন্তু দশমী তিথি থাকছে ২২ অক্টোবর শেষরাত্রি ৫ ঘণ্টা ১২ মিনিট পর্যন্ত। তাই ওঁরা দশমী পুজো স্থির করেছেন ২২ অক্টোবর। অর্থাৎ, ২২ অক্টোবরেই ওঁদের মতে নবমী এবং দশমী পুজো ।
দু’রকম পঞ্জিকার গণনাপদ্ধতি কার কী রকম। অদৃক্সিদ্ধ পঞ্জিকার গণনার ভিত্তি ‘সূর্য-সিদ্ধান্ত’। এটি রচিত হয় আনুমানিক ৪০০ খ্রিস্টাব্দে। তখন দূরবিনের আবিষ্কার হয়নি, অয়নচলন আবিষ্কৃত হয়নি, তাই এই গ্রন্থের সূত্রাবলি দিয়ে চন্দ্র, সূর্য ও গ্রহের অবস্থান গণনা করলে তা বর্তমানে আকাশের প্রকৃত গ্রহ অবস্থানের সঙ্গে মিলছে না, প্রতি বছর পার্থক্য বেড়ে চলেছে। আর পজিশনাল অ্যাস্ট্রনমি সেন্টারে সূর্য, চন্দ্র ও গ্রহগুলোর দৈনন্দিন অবস্থান জ্যোতির্বিজ্ঞানের সূত্র অনুযায়ী ইলেকট্রনিক কম্পিউটারের সাহায্যে গণনা করা হয়। বিশ্বের বহু মানমন্দির থেকে দূরবিনে মহাকাশ পর্যবেক্ষণ করে জ্যোতিষ্কদের অবস্থান মিলিয়ে দেখা হয়। কোনও গ্রহের ক্ষেত্রে গণিত অবস্থানের সঙ্গে নিরীক্ষিত অবস্থানের কোনও পার্থক্য দেখা গেলে কেন পার্থক্য হল, তা নিয়ে গবেষণা শুরু হয়ে যায়, প্রয়োজনে প্রচলিত গণনার সূত্রাবলির সংস্কার করা হয়। এর জন্যে রয়েছে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা: ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রনমিক্যাল ইউনিয়ন। এদের সদর দফতর প্যারিসে। এই সংস্থার কাছে বিশ্বের যে-কোনও মানমন্দির থেকে এ ব্যাপারে কোনও ত্রুটি লক্ষ করা গেলেই সেটি জানিয়ে দেওয়া হয়, তখন প্রচলিত সূত্রাবলির কোথায় কতটুকু সংস্কার করতে হবে, তার নির্দেশ দিয়ে থাকে এই ইউনিয়ন। তাই ভারত সরকারের পঞ্জিকা বা দৃক্সিদ্ধ পঞ্জিকার গণনাই সর্বাধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান-ভিত্তিক।
এমপি বিড়লা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ-এ বিজ্ঞানী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy