ভারতীয় রাজনীতিতে অটলবিহারী বাজপেয়ীর কোন উত্তরাধিকারটি সর্বাপেক্ষা প্রতিষ্ঠিত হইল, সেই প্রশ্নের উত্তর তাঁহার নরমপন্থী, সহিষ্ণু ভাবমূর্তির পক্ষে ইতিবাচক হইবে না। তাঁহার সেই উত্তরাধিকারটির নাম নরেন্দ্র মোদী। গুজরাত দাঙ্গার প্রত্যক্ষ না হউক, নৈতিক দায় লইয়া ক্ষমতা হইতে নরেন্দ্র মোদীকে সরিতে বাধ্য করা অটলবিহারী বাজপেয়ীর পক্ষে বিধেয় ছিল। সম্ভবও ছিল। তিনি তাহা করেন নাই। রাজধর্ম ইত্যাদি গালভরা কথা শুনাইয়া তিনি ক্ষান্ত হইয়াছিলেন। কেন, সেই কারণ সন্ধান করিলে বিজেপির অভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রসঙ্গ উঠিবে। লালকৃষ্ণ আডবাণী তাঁহার তৎকালীন মানসপুত্রের রক্ষাকর্তা হইয়া দাঁড়াইয়াছিলেন কি না, সঙ্ঘ পরিবারের রায়কে অতিক্রম করিবার সাধ্য বাজপেয়ীর ছিল কি না, আজ এত বছর পরে এই প্রশ্নগুলির উত্তর জল্পনাসাপেক্ষ। কিন্তু, একটি কথা সংশয়াতীত— দল বা সঙ্ঘ পরিবার যদি তাঁহাকে নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে কঠোর হইতে না-ও দিয়া থাকে, প্রতিবাদে প্রধানমন্ত্রীর পদটি ছাড়িয়া দিতে তাঁহার কোনও বাধা ছিল না। বাজপেয়ী ছাড়েন নাই। কেন, সেই অনুসন্ধান অপ্রয়োজনীয়। তাঁহার নিকট ‘রাজধর্ম’ কথাটি নিছক একটি শব্দের গণ্ডি অতিক্রম করিয়া যদি একটি নৈতিক অবস্থান— আপস-অসম্ভব অবস্থান— হইয়া উঠিতে পারিত, হয়তো তাঁহার সিদ্ধান্তও অন্য রকম হইত। হয়তো ভারতীয় রাজনীতির গতিপথও ভিন্ন হইত। হয়তো নরেন্দ্র মোদীর নামটি ভারতের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ইতিহাসের পাদটীকা হইয়াই থাকিয়া যাইত। তাহার পরিবর্তে, সেই নরেন্দ্র মোদীই অটলবিহারী বাজপেয়ীর উত্তরাধিকার হইয়া থাকিলেন।
মৃত্যুর বহু পূর্ব হইতেই বাজপেয়ী রাজনীতির পরিসরে ছিলেন না। কিন্তু, গত কয়েক বৎসরে তাঁহার নাম বারে বারে ফিরিয়া আসিয়াছে। বিজেপি শাসনের বিকল্প রূপ হিসাবে। আলোচিত হইয়াছে, কী ভাবে উগ্র হিন্দুত্ববাদ আসিয়া বাজপেয়ীর মধ্যপন্থার— মতান্তরে নরম হিন্দুত্বের— রাজনীতিকে সম্পূর্ণ মুছিয়া দিল। কিন্তু, ইহা কি সত্যই পর্বান্তর? না কি, উগ্রতাকে প্রতিহত করিবার জন্য যে নৈতিক অবস্থান এবং রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়িয়া তোলা উচিত ছিল, বাজপেয়ী তাহাতে ব্যর্থ হইয়াছিলেন? তাঁহার আমলে বিজেপি নামক দলটি সামাজিক বৈধতা অর্জন করিয়াছিল। তিনি ৩১টি সঙ্গী লইয়া জোট চালাইয়াছিলেন, ফলে গণতন্ত্রের অনুশীলনও তাঁহাকে করিতে হইয়াছিল। কিন্তু, ভারতের চারিত্রিক বুনোটে যে ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল, তাহার প্রতি দায়বদ্ধতা তিনি তৈরি করিতে পারিয়াছিলেন বলিলে অনৃতভাষণ হইবে। সেই ফাঁক গলিয়াই নরেন্দ্র মোদীরা ভারতীয় রাজনীতির মূল মঞ্চটির দখল লইয়াছেন। দৃঢ় নৈতিক অবস্থানের অভাব তাঁহাদের যাত্রাপথটিকে সুগম করিয়াছে।
ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রশ্নহীন অগ্রাধিকার না দিলে এই পরিণতিই হয়। অবিভক্ত বাংলা তাহার নিদর্শন পাইয়াছিল ফজ়লুল হকের মধ্যে। হককে তাঁহার চরম শত্রুও মুসলিম সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কান্ডারি বলিবেন না। কিন্তু তিনিই, কংগ্রেসের সহিত জোট-সম্ভাবনা বানচাল হইয়া যাইবার পর, মুসলিম লিগের সঙ্গী হইয়াছিলেন। পরিণতি ভাল হয় নাই— তাঁহার পক্ষেও নহে, বাংলার পক্ষেও নহে। বাজপেয়ীর গতিপথটিও এক অর্থে তদ্রূপ। যদি ধরিয়াও লওয়া যায় যে তাঁহার মধ্যে উগ্র হিন্দুত্ব ছিল না, তিনি সত্যই একটি নেহরু-পন্থী উদার অবস্থানে বিশ্বাসী ছিলেন— তবুও তিনি সেই উদারবাদকে প্রশ্নাতীত অগ্রাধিকার দেন নাই। বারে বারেই আপস করিয়াছেন। ফলে, সাম্প্রদায়িকতার ঢেউয়ের সম্মুখে তাঁহার উদারতা বালির বাঁধও হইয়া উঠিতে পারে নাই। নরেন্দ্র মোদীর ঢেউ আসিয়া অটলবিহারী বাজপেয়ীকে ভাসাইয়া লইয়া যাইবে, ইহাই ইতিহাসের ললাটলিখন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy