কখনও তিন দিন, কখনও সাত, কখনও তিন সপ্তাহ। আবার কখনও-বা মাত্র পৌনে এক ঘণ্টা। রাজ্যে সরকার গঠনে অনিশ্চয়তা দেখা দিলে রাজ্যপালরা কতটা সময় দিবেন, তাহা এতটাই পরিবর্তনশীল এবং নমনীয়। বিষয়টি যে কত গুরুতর, তাহা আবার প্রমাণিত হইল জম্মু ও কাশ্মীরের ঘটনায়। বিজেপি-পিডিপি জোট ভাঙিয়া যাইবার পাঁচ মাস পর বিজেপি ছাড়া রাজ্যের তিনটি প্রধান দল সরকার গড়িবার দাবি তুলিলে মাত্র পৌনে এক ঘণ্টার মধ্যে রাজ্যপাল সত্যপাল মালিক বিধানসভা ভাঙিয়া দিলেন। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জানা গেল যে নির্বাচন কমিশন আগামী বৎসরই লোকসভা নির্বাচনের সহিত সে রাজ্যে বিধানসভা ভোট সারিয়া ফেলিতে চাহে। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠিয়াছে রাজ্যপালের পদক্ষেপটির নৈতিকতা লইয়া। বিজেপির হাত হইতে রাজ্যের শাসনক্ষমতা ফসকাইয়া বাহির হইয়া যাইতে দেখিয়াই কেন্দ্রের এই ত্বরিত সিদ্ধান্ত— বিরোধীদের অভিযোগটি রাজ্যপাল কাটিবেন কোন যুক্তিতে? যে যুক্তি তিনি দিয়াছেন— বিধানসভার পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হইতে দেখিয়াই নাকি এই সিদ্ধান্ত, তাহার সপক্ষে যুক্তি সাজাইবেন কী ভাবে? ঠিকই, বিধানসভায় স্থিতির অভাব ঘটিলে রাজ্যপাল বিধানসভা ভাঙিয়া দিতে পারেন, দেশের সংবিধান তাঁহাকে সেই ক্ষমতা দিয়াছে। কিন্তু আইনমতে ঠিক হওয়াটাই কি যথেষ্ট? নৈতিকতা তো কেবল আইন নয়, তাহার ঊর্ধ্বে আর একটি বৃহত্তর নিরপেক্ষতার নীতিরও প্রশ্ন থাকে। বিরোধীরা সরকার গঠনের দাবি পেশ করা মাত্র কী ভাবে রাজ্যপাল জানিলেন যে ‘স্থিতিশীলতার অভাব’ ঘটিতে চলিয়াছে? তাঁহার কি উচিত ছিল না বিধানসভার অন্দরে ‘ফ্লোর টেস্ট’-এর জন্য অপেক্ষা করা? মালিক উত্তর দিয়াছেন, বিধায়ক কেনার খবর পাইয়াই তাঁহার এই সিদ্ধান্ত। পূর্বদৃষ্টান্ত কিন্তু বলিতেছে, বিধায়ক কেনার সংবাদেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রতীক্ষাকালের মাপ ছোট করা হয় নাই। সাম্প্রতিক কালের কর্নাটক-কাণ্ড প্রসঙ্গত মনে পড়িবে। অপেক্ষায় কেন্দ্রীয় শাসকের স্বার্থ বিপন্ন হইলে রাজ্যপালরা অপেক্ষা করেন না, আর অপেক্ষায় কেন্দ্রীয় শাসকের স্বার্থ সিদ্ধির সম্ভাবনা দেখিলে রাজ্যপালরা অপেক্ষা করেন— এমন ভাবা কি ভুল হইবে?
মোট কথা, শাসক জোট ভাঙিয়া যাইবার পর গত পাঁচ মাস যদি রাজ্যে স্থিতি থাকিতে পারে, পৌনে এক ঘণ্টার মধ্যে তাহা বিপন্ন হইয়া পড়িবার যুক্তিটি অগ্রহণযোগ্য। জম্মু ও কাশ্মীরের স্বার্থের বদলে কেন্দ্রীয় সরকারের স্বার্থ— বাস্তবিক, বিজেপির সঙ্কীর্ণ দলীয় হিসাব অনুযায়ীই রাজ্যপাল কাজ করিতেছেন, এই অনুমান ভুল হইবার সম্ভাবনা শূন্য। বিষয়টি স্পষ্টতর হইয়াছে বিজেপি নেতা রাম মাধবের কথায়। পিডিপি, এনসি ও কংগ্রেসের হাত মিলাইবার মধ্যে তিনি পাকিস্তানি চক্রান্ত দেখিয়াছেন। অথচ পিডিপির সহিত মেরুসদৃশ দূরত্ব সত্ত্বেও পিডিপি-বিজেপি জোটই এত দিন এ রাজ্যে শাসন চালাইয়াছে। সমীকরণটি জলের অপেক্ষাও সরল ও তরল। বিজেপির সহিত হাত না মিলাইলেই তাহা ‘পাকিস্তানি’ বা ‘অ্যান্টি-ন্যাশনাল’ কারবার।
ভারতীয় সংবিধানে অবশ্যই এ বিষয়ে কিছু অস্পষ্টতা থাকিয়া গিয়াছে, যাহার সুযোগ লইয়াই কেন্দ্রীয় শাসক দল নিজেদের দলীয় স্বার্থ তুষ্ট ও পুষ্ট করিবার প্রয়াস করে। কর্নাটক বিধানসভা নির্বাচনের পরও কথাটি উঠিয়াছিল। ঠিক কোন পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধিরূপী রাজ্যপাল কোন পদক্ষেপটি করিতে পারেন, তাহা আরও স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট থাকিলে সঙ্কীর্ণ রাজনীতির সুযোগও কমিত, যুক্তরাষ্ট্রীয়তার পথটিও সুগম হইত। কিন্তু সংবিধানের ফাঁক পূর্ণ করিবার জন্য রাজনৈতিক স্বার্থাতীত সুবিবেচনা দরকার। বর্তমান ভারতে উহা অপ্রাপ্য, অচিন্ত্যনীয়। সুতরাং, এই পথে বার বার হাঁটিতে হইবে বলিয়া আশঙ্কা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy