মানুষের কেনার ক্ষমতা না থাকলে উৎপাদন বাড়িয়ে লাভ নেই।
গল্প-বলিয়েরাই আসলে জগৎ শাসন করে, বলেছিলেন প্লেটো। তাঁর ‘দ্য রিপাবলিক’-এ প্লেটো আদর্শ রাষ্ট্রের অভিভাবককে পরামর্শ দিয়েছিলেন, আমাদের প্রথম কাজ হবে গল্প উৎপাদনকে নিয়ন্ত্রণ করা— যে গল্পগুলি আমরা উপযুক্ত মনে করব, সেগুলিকে রেখে বাকিগুলি বর্জন করতে হবে। বাচ্চার মা এবং পরিচারিকাদের এমন ভাবে বোঝাতে হবে, যাতে আমাদের বাছাই করে দেওয়া গল্পগুলিই তাঁরা বাচ্চাদের বলেন। গত কয়েক বছরে ভারতের রাষ্ট্রীয় অভিভাবকদের এমনই বাছাই করা নানাবিধ গল্পের তালিকায় সাম্প্রতিকতম সংযোজন— ‘খয়রাতি পাপ, ঋণ নিয়ে বাঁচো’।
অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন শেষে তাঁর দর্শনটি খোলসা করলেন। বললেন, আমরা ‘ডোল আউট’-এ বিশ্বাস করি না। ভারতবাসী জানল, অর্থাভাবে ধুঁকতে থাকা অর্ধমৃত মানুষকেও যদি সরকার সরাসরি বেঁচে থাকার রসদ জোগায়— খাদ্য বা অর্থ দিয়ে— তাকে বলে ‘ডোল আউট’, যা নাকি অর্থনীতির স্বাস্থ্যের পক্ষে বেজায় খারাপ। আর, কয়েকশো কোটি টাকা ব্যাঙ্ক ঋণ নিয়ে কেউ যদি হাওয়াই দ্বীপে গিয়ে প্রাসাদ বানিয়ে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেয়, তাকে বলে ‘স্টিমুলাস’। অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে তাই চাই ঋণের জোগান, সরকারি সম্পদ বিক্রি, সস্তা শ্রম ইত্যাদি। তাঁর ঘোষিত আর্থিক প্যাকেজে এগুলিই ছিল। অর্থনীতির পাঠ্যবইয়ে এদের বলে ‘জোগানের দিকের নীতি’— উৎপাদন-ব্যয় কমিয়ে জোগান বাড়ানোর নীতি। প্রশ্ন উঠতে পারে, এই সব তো আগেও করা যেত, পরেও করা যাবে— এই অভূতপূর্ব কোভিড-১৯ বিপর্যয়ের সঙ্গে এর সম্পর্ক কোথায়? এ প্রশ্নের উত্তর নেই।
কিন্তু, মানুষের কেনার ক্ষমতা না থাকলে উৎপাদন বাড়িয়ে লাভ নেই। আর, লাভ না দেখলে উৎপাদকরা জিনিস বানাবেন না। সমস্যাটি এমন হলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর নীতি নিতে হবে, যাকে বলে ‘চাহিদার দিকের নীতি’। কিন্তু অর্থমন্ত্রীর পক্ষপাত ওই জোগানের দিকের নীতির প্রতিই, তার পরিণতি যাই হোক না কেন। এ এক রকম ধর্মান্ধতার মতোই, কারণ অন্যটির মানে যে ‘ডোল আউট’— যাকে বলে খয়রাতি। মহা পাপ!
‘ডোল আউট’ কথাটি দূর অতীতে এক শ্রেণির সংবাদমাধ্যমের সম্পাদকীয় মন্তব্যে পাওয়া যেত, আর পাওয়া যেত বাণিজ্য জগতের কেষ্টবিষ্টুদের কথায়। সরকার গরিবদের জন্যে কোনও খরচের ঘোষণা করলেই বাণিজ্যমহল থেকে মন্তব্য আসত— অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে সরকারের উচিত ব্যবসায় সুযোগসুবিধা বাড়ানো, তা না করে সরকার অবান্তর দানখয়রাতি করছে! কোনও কোনও ‘বিশেষজ্ঞ’ আরও একটু এগিয়ে বলতেন, অর্থনীতি চাঙ্গা হলে তো তাতে গরিবেরও উন্নতি হবে। খয়রাতি করে গরিবের উন্নতি করতে গিয়ে সরকার দেউলিয়া হয়ে যাবে যে!
কিন্তু, এই ‘ট্রিকল ডাউন’ বা চুঁইয়ে পড়া সমৃদ্ধির যুক্তিতে ঘোরতর অবিশ্বাসীদের সংখ্যাই ছিল বেশি, যাঁরা আমাদেরই দাদা-কাকা-মেসো, আপিসকাছারিতে কাজ করতেন আর সন্ধ্যায় পাড়ার লাইব্রেরিতে বসে একটু সমাজ-অর্থনীতি বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করতেন। বস্তুত তথাকথিত খয়রাতির গ্রহীতা এঁরাও কম-বেশি ছিলেন, কারণ অনেকেই সাপ্তাহিক রেশন তুলতে দোকানে লাইন দিতেন। কিন্তু তার থেকেও বড় কথা, রাষ্ট্রের কর্তব্য বিষয়ে তাঁদের যে রাজনৈতিক শিক্ষাটুকু ছিল, তা গরিবের সমস্যাকে আলাদা করে দেখতে শেখায়নি, আর এই ‘সলিডারিটি’র পিছনে ছিল নাগরিক অধিকারের এক সামগ্রিকতার বোধ। ‘ডোল আউট’ কথাটা যে তীব্র অসম্মানের, আর নাগরিককে অসম্মান করার অধিকার রাষ্ট্রকে যে কেউ দেয়নি, সেটা বোঝার মতো শিক্ষা এবং বোধও তাঁদের অনেকের ছিল। তাই সে কালে রাজনীতির কারবারিরাও ‘আমি ডোল আউট-এ বিশ্বাসী নই’, বুক ঠুকে এমন কথা বলতে পারতেন না। বরং গরিবদের জন্যে প্রতিশ্রুতির ঘোষণায় তাঁরা ছিলেন অকৃপণ।
এখন খয়রাতি নিয়ে সকলেরই প্রবল উদ্বেগ। সেই দাদা-কাকা-মেসোদের জায়গায় এখন যাঁদের দেখি— একটু ফুলে-ফেঁপে ওঠা মধ্যবিত্ত— খয়রাতি এঁদের অনেকেরই দু’চক্ষের বিষ। ‘কষ্টার্জিত’ রোজগারের অর্থ সরকার কর চাপিয়ে কেড়ে নিচ্ছে, তা-ও এঁরা সহ্য করেন— কিন্তু, সেই অর্থ করদাতাদের সেবায় ব্যয় না করে সরকার যদি ‘ওদের’ জন্য খরচ করে, কী ভাবে সহ্য হয়? ফলে এঁদের অনেকে ইদানীং অমর্ত্য সেন, কৌশিক বসু কিংবা অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়দের ঘোরতর সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করেছেন, কারণ এঁরা যে সবাই গরিবের কাছে দ্রুত সব রকম সাহায্য পৌঁছে দেওয়ার কথা বলেছেন, এমনকি নগদ অর্থও। সে দিন এক ব্যাঙ্ককর্মী খুব বিরক্ত হয়ে বলছিলেন, ‘আমরা কি জানি না গরিবদের হাতে এ ভাবে টাকা দিলে কী হয়? তারা কি আর সঞ্চয় করবে? হাবিজাবি কিনে খরচ করে ফেলবে, আর জিনিসপত্রের দাম বাড়বে, ও দিকে বাজেট ঘাটতি বেড়ে সরকারের দেউলিয়া অবস্থা হবে।’ এই যুক্তি অনেকের কাছেই গ্রহণযোগ্য মনে হতে পারে। যুক্তিটি শুধু ভুল নয়, বিপজ্জনকও বটে।
কেন ভুল, কেন বিপজ্জনক, সেটা বুঝতে অর্থনীতি বিষয়ে কিছুটা অক্ষরজ্ঞানের প্রয়োজন আছে। প্রথমত, পণ্যের চাহিদা বাড়লে সে বস্তুটির যে শুধুই দাম বাড়ে তা কিন্তু নয়, তার উৎপাদনও বাড়ে, বড় জোর একটু সময়ের ব্যবধানে। দ্বিতীয়ত, যদি চাহিদা কম থাকার কারণেই উৎপাদন কম হয়, তবে চাহিদা বাড়ানোর নীতিই নিতে হবে, তবেই উৎপাদন বাড়বে। কোভিড-১৯’এর আবির্ভাবের আগে থেকেই অর্থনীতির বৃদ্ধির হার কমে আসছিল, এবং তা যে দুর্বল চাহিদার জন্য, সেই মতটাই ছিল জোরালো। জাতীয় নমুনা সমীক্ষার পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ২০১১-১২ এবং ২০১৭-১৮-র মধ্যে গড়পড়তা ভারতীয় পরিবারের মাথাপিছু প্রকৃত ভোগব্যয় কমেছে, যা ৪৫ বছরে এই প্রথম। ঘাটতিশূন্য বাজেট করতে গিয়ে সরকার যদি ব্যয় না বাড়ায়, তা হলে জাতীয় উৎপাদন তথা আয়বৃদ্ধি কম হবে, ফলে কর বাবদ আয়ও কম হবে, আর পরিকল্পনামাফিক শূন্য ঘাটতিও অধরা থেকে যাবে।
সবাইকে অর্থনীতি পড়তেই হবে, কেউ এমন মাথার দিব্যি দেয়নি। কিন্তু মুশকিল হল, ওই ব্যাঙ্ককর্মী মনে করছেন যে তিনি এই বিষয়টি দিব্যি জানেন, এবং এতটাই জানেন যে ওই ‘আমেরিকায় বসে কথা বলা’ অর্থনীতিবিদদের কথা তিনি মানতে পারছেন না। দিল্লির নর্থ ব্লকের অর্থনীতি-বোধও ওই ব্যাঙ্ককর্মীর মতোই নয় কি? না হলে, এই বিপর্যয়ের সময়ে কেউ বাজেট ঘাটতি নিয়ে দুশ্চিন্তা করে? স্বাভাবিক সময়ে ক্রেডিট রেটিং এজেন্সির জুজুর ভয় আছে— ঘাটতি সীমা ছাড়ালে রেটিং কমবে। কিন্তু দেশের অর্থনীতি যখন অতল খাদের মুখে, তখন কোন জুজুটি বেশি ভয়ের, সেই বিচারবুদ্ধি হারালে চলবে কেন?
গরিবদের হাতে সরাসরি টাকা দিলে যে তা অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার বদলে ডোবাবে, এই ধারণাটি এখন অর্থমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশার মানুষজনের মুখে যত ঘন ঘন শুনি, তাতে বিচলিত হতেই হয়। অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, রঘুরাম রাজন, কৌশিক বসুরা যা বলছেন, তাতে অর্থশাস্ত্রের কোনও ছাত্র আপত্তি করবেন না— কারণ, তিনি ‘ম্যাক্রো-ইকনমিক্স’-এর এই গোড়ার তত্ত্বটি জানেন। তত্ত্বটি হল, সরকার গরিবের হাতে অর্থ তুলে দিলে তাকে অপব্যয় বলা তো যায়ই না, চাহিদার অভাবের কারণে অর্থনীতির গতিভঙ্গ হলে তাকে টেনে তোলার এটিই প্রধান উপায়। গত শতকের ত্রিশের দশকের গোড়ায় পশ্চিমের মহামন্দা থেকে এই নির্যাসটুকু উঠে আসে, যা তুলে আনার প্রধান কৃতিত্ব জন মেনার্ড কেন্স-এর। তারও অনেক আগে কার্ল মার্ক্স একে বলেছিলেন ‘রিয়েলাইজ়েশন’-এর সঙ্কট— উৎপাদন হলেও যদি পণ্য বিক্রি না হয়, তবে মুনাফা ‘রিয়েলাইজ়ড’ হবে না।
পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় এমন সঙ্কটের প্রবণতা থাকবেই। আর, তা থেকে মুক্তির উপায় যে সরকারি ব্যয় বিপুল পরিমাণে বাড়িয়ে হতে পারে, তা কেন্সই বললেন প্রথম। তা করতে গিয়ে বাজেটে ঘাটতি হলে, হোক। বস্তুত, কিছু পরিমাণ ঘাটতি অর্থনীতির পক্ষে মন্দ নয়। অর্থনীতির চাকা ঘোরানো যেখানে লক্ষ্য, সেখানে বাজেট ঘাটতি কমিয়ে রাখায় কোনও মহৎ উদ্দেশ্য সাধিত হতে পারে না। অতএব, তথাকথিত খয়রাতি যে নাগরিকের জীবনের সংবিধানস্বীকৃত মৌলিক অধিকার রক্ষার জন্যে করতে হবে শুধু তা-ই নয়, অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতেও এই মুহূর্তে সেটা প্রয়োজন।
অর্থনীতি বিভাগ, ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ়, কলকাতা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy