Advertisement
E-Paper

ট্রাম্পের ইউরোপ-দর্শন

শুল্কের আঘাতে টলমল দশা আমেরিকার মিত্র দেশগুলোর, শেয়ার বাজারের নিম্নগতি সামলানো যাচ্ছে না, ইরানের উপর ঘনাচ্ছে যুদ্ধের মেঘ, ইজ়রায়েল যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করে অবিরাম গাজ়ার উপর বোমাবর্ষণ করে চলেছে।

প্রণয় শর্মা

শেষ আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০২৫ ০৬:৪৫
Share
Save

ইউরোপের আটটি বৃহত্তম দেশ এবং ডেনমার্কে সম্প্রতি একটি সমীক্ষা হয়েছিল। যাঁরা উত্তর দিয়েছেন, তাঁদের অর্ধেকেই মনে করছেন যে ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউরোপের শত্রু। ৬৩ শতাংশ মনে করছেন, ট্রাম্পের নির্বাচনী জয়ের জন্য বিশ্ব নিরাপত্তা হারিয়েছে। ইউরোপে এই ট্রাম্প-বিরোধী মনোভাবের উচ্ছ্বাস সম্ভবত সারা বিশ্বের সাম্প্রতিক মনোভাবের প্রতিফলন। অনিশ্চয়তা ছেয়ে গিয়েছে গোটা বিশ্বে। শুল্কের আঘাতে টলমল দশা আমেরিকার মিত্র দেশগুলোর, শেয়ার বাজারের নিম্নগতি সামলানো যাচ্ছে না, ইরানের উপর ঘনাচ্ছে যুদ্ধের মেঘ, ইজ়রায়েল যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করে অবিরাম গাজ়ার উপর বোমাবর্ষণ করে চলেছে।

এ সব কিছুই আমেরিকার বিশ্ব-নেতৃত্বের অবস্থানটি নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। এই প্রেক্ষিতে ট্রাম্প যখন দাবি করেন যে তিনি রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ বন্ধ করবেন, তখন তাঁর প্রকৃত অভিপ্রায় নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। ১৯৪৫ সাল থেকে আমেরিকা-ইউরোপের সম্পর্ক যে নিবিড় সহযোগিতার উপরে দাঁড়িয়ে, তার ভবিষ্যৎ নিয়েও সংশয় দেখা দেয়। ইউরোপের নেতাদের সঙ্গে কোনও পরামর্শ না করেই, একতরফা ভাবে ইউক্রেন যুদ্ধের অবসানের শর্ত আলোচনা করছেন ট্রাম্প। ইউরোপীয় নেতারা মনে করছেন, এটা কার্যত রাশিয়ার কাছে বিকিয়ে যাওয়া, যা পুতিনকে আরও উৎসাহিত করবে ভবিষ্যতে অন্যান্য দেশকে আক্রমণ করতে।

ট্রাম্প আরও বলেছেন যে, ভবিষ্যতে ইউরোপকে নিজের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিজেকেই করতে হবে, আমেরিকার উপর ভরসা করা আর চলবে না। নেটো-র (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অরগানাইজ়েশন) কর্তৃত্ব আমেরিকার হাত থেকে এখন আসবে ইউরোপের অধীনে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা এবং সোভিয়েট ইউনিয়নের মধ্যে শীতল যুদ্ধ যখন প্রকট হচ্ছে, সেই সময়ে (১৯৪৯) আমেরিকাই ‘নেটো’ তৈরি করতে এগিয়ে এসেছিল, যাতে ইউরোপের দেশগুলির মধ্যে কমিউনিস্ট ভাবাদর্শ ছড়িয়ে না পড়ে। ইউরোপের দেশগুলি সে সময়ে উপনিবেশ হারিয়ে, বিশ্বযুদ্ধের বিপুল খরচে বিপর্যস্ত। আর্থিক সহায়তার আশায় তারা আমেরিকার কমিউনিজ়ম-বিরোধী জোটে যোগ দিতে দ্বিধা করেনি। বারোটা দেশ দিয়ে শুরু করে এখন নেটোর সদস্য সংখ্যা বত্রিশ, এটি এখন বিশ্বের বৃহত্তম সামরিক জোট।

নব্বই দশকের গোড়ায় শীতল যুদ্ধ যখন স্তিমিত হয়ে আসছে, তখন সোভিয়েট ইউনিয়নকে আশ্বাস দেওয়া হয় যে ভবিষ্যতে নেটো মস্কোর দিকে এক ইঞ্চিও এগোবে না। তার পর থেকে এখনও অবধি সাত বার মস্কোর দিকে এগিয়েছে নেটোর বাহিনী। প্রতিবারই নেটোর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাশিয়ার কোনও প্রাক্তন মিত্র-দেশ। ইউক্রেনও প্রলুব্ধ হয়েছিল স্বতন্ত্র অবস্থান থেকে সরে এসে নেটোয় যোগ দিতে, এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অংশ হতে।

প্রত্যাশিত ভাবেই রাশিয়া তাতে ক্ষিপ্ত হয়েছে। ২০১৪ সালে যখন আমেরিকা এবং ইউরোপের নেতারা ইউক্রেনের নেতৃত্বের উপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে, তখন রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করে ক্রাইমিয়াকে রাশিয়ার অঙ্গীভূত করে। এর পর থেকে নেটো ইউক্রেনকে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র জোগান এবং সামরিক প্রশিক্ষণ দিতে থাকে। উদ্দেশ্য, ভবিষ্যতে রাশিয়ার আক্রমণ প্রতিহত করা। এরই পরিণাম ইউক্রেন যুদ্ধ।

ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন যে তিনি এই যুদ্ধ শেষ করতে চান। সেই সঙ্গে, সরাসরি মস্কোর সঙ্গে সংঘাতে না গিয়ে রাশিয়ার পড়শি দেশগুলিকে শক্তি জুগিয়ে রাশিয়াকে কমজোরি করার দীর্ঘ নীতিকেও খারিজ করতে চান। যেন রাশিয়াকে আমেরিকা আর নিজের সমকক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে করছে না। অনেকে মনে করছেন, নিরাপত্তার নিরিখে আমেরিকার তরফ থেকে ইউরোপের অন্যান্য দেশের থেকে আলাদা করে রাশিয়াকে দেখার দরকার নেই। রাশিয়া-সহ গোটা ইউরোপের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় স্থিতি আনাই জরুরি। এ নিয়েও অবশ্য সংশয়ী ইউরোপের দেশগুলি। কোনও শুভ উদ্দেশ্যে ট্রাম্প কিছু করছেন বলে তাঁরা বিশ্বাস করেন না।

প্রশ্ন উঠছে, শুল্ক নিয়ে ট্রাম্পের কঠোর অবস্থান ছিল আসলে একটা কূটনৈতিক চাল কি না। এ ভাবে চাপ তৈরি করে ক্রমে দরদস্তুরে যেতে চাইছেন তিনি। এখনও অবধি অবশ্য ট্রাম্পের চাল কেবল বিশ্বের বাণিজ্যব্যবস্থা ওলটপালট করে অনিশ্চয়তাই এনেছে। ট্রাম্পের হুমকির ফলে বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ নিজেদের সামরিক বাজেট বাড়িয়েছে। ট্রাম্প অবশ্য চান, তা আরও বাড়ুক যাতে ইউরোপীয়রা নিজেদের নিরাপত্তা নিজেরাই সামলাতে পারেন। তাতে আমেরিকার অর্থনীতিরও লাভ, অত্যাধুনিক অস্ত্র ইউরোপকে কিনতে হবে আমেরিকার অস্ত্র উৎপাদকের কাছ থেকেই। অন্য দিকে, ইউরোপ সামরিক বাজেট বাড়ালে উন্নয়নের থেকে অর্থ সরাতে বাধ্য হবে। তাতে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়বে, কারণ ইউরোপের অধিকাংশ নেতার সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই।

আমেরিকা-ইউরোপের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে আরও অনেক বিষয়ে, যেমন জলবায়ু পরিবর্তন, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, পরিবেশ, চিনের সঙ্গে সম্পর্ক। তবে ট্রাম্প যতই হম্বিতম্বি করুন, তিনি নেটো জোট ভেঙে দেবেন বা ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্কের ধারাবাহিকতা ছিন্ন করবেন, এমন সম্ভাবনা খুবই কম। তবে সম্পর্কের ভবিষ্যৎ অনেকটাই নির্ভর করছে ইউক্রেন যুদ্ধের গতির উপর। রাশিয়া-আমেরিকা সম্পর্ক কোথায় দাঁড়াবে, সেটাও।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

america Europe US Tariff War

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}