বিপর্যয় অকস্মাৎ আসিবেই, তাহার মোকাবিলার প্রস্তুতি থাকিতে হইবে। বিপর্যয় মোকাবিলার প্রশিক্ষণ ও পরিকল্পনার জন্য রাজ্য সরকারের পৃথক দফতর নির্মাণ হইয়াছে। নাগরিকদের প্রত্যাশা, পুর-পরিষেবা এবং জেলা প্রশাসনের ভারপ্রাপ্ত আধিকারিকেরা, দমকল পুলিশের কর্মীরা দুর্ঘটনা-মোকাবিলায় সমর্থ হইবেন এবং তৎপর থাকিবেন। আক্ষেপের বিষয়, রাজ্যে পর পর দুইটি বড় দুর্ঘটনায় প্রমাণিত হইল, তাহা দুরাশা। একটি বেলুড়ের গ্যাস-দুর্ঘটনা, অপরটি মুর্শিদাবাদের বাস-দুর্ঘটনা। বেলুড়ে একটি কারখানা হইতে দূষিত গ্যাস বাহির হইয়া গোটা এলাকাকে বিপন্ন করিল। সরকারি কর্মীরা যে ভাবে বিষয়টির মোকাবিলা করিলেন, তাহাতে ধন্যবাদ তাঁহাদের না জানাইয়া ভাগ্যকে জানাইলে ঠিক হয়। ভোপালের গ্যাস দুর্ঘটনার মতো বড় কোনও ঘটনা যে ঘটে নাই, তাহা রাজ্যবাসীর সৌভাগ্য। ওই গ্যাস যে আরও মারাত্মক প্রকৃতির নহে, কিংবা আরও অধিক পরিমাণে বাহির হয় নাই, স্থানীয় মানুষ কেবল সেই কারণে প্রাণে বাঁচিয়াছেন। সিলিন্ডার ফাটিয়া ক্লোরিন-জাতীয় গ্যাস বাহির হইলে কী প্রকারে তাহা নিয়ন্ত্রণ করিতে হয়, তাহা আধিকারিকেরা জানিতেন না। তাঁহারা প্রথমে জল দিয়াছেন, পরে ভুল বুঝিয়া সাবান-জল দিয়াছেন। তাহারও পরে অতি বিপজ্জনক পদ্ধতিতে সিলিন্ডারটিকে তুলিয়া নিয়া গঙ্গায় ফেলিয়াছেন। তাহাতে গঙ্গার জল তো দূষিত হইয়াছে বটেই, জলজ প্রাণীরও কত ক্ষতি হইয়াছে, সে বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করিয়াছেন পরিবেশ কর্তারা। দূষিত গ্যাস নির্গত হইলে কী করিতে হইবে, সে বিষয়ে কি আধিকারিকদের কিছুই জানাইবার কোনও চেষ্টা কখনও হয় নাই? না হইয়া থাকিলে তাহা কাহার গাফিলতি, তা চিহ্নিত করিবার সময় আসিয়াছে।
গত মাসে মুর্শিদাবাদের মালদহগামী বাসটি দৌলতাবাদে সেতু হইতে জলে পড়িবার পর যাহা ঘটিল, তাহা আরও বিস্ময়কর। নদীতে নিমজ্জিত বাসটি উদ্ধারের কাজ শুরুই বিস্তর বিলম্বে। মুর্শিদাবাদ জেলায় ডুবুরি মিলে নাই, ক্রেন জোগাড় করিতে সময় লাগিয়াছে তিন ঘণ্টারও অধিক। যে কয় জন প্রাণে বাঁচিয়াছেন, তাহা প্রধানত ওই এলাকার মৎস্যজীবীদের সহায়তায়। এই ছবিটি অতি পরিচিত। স্থানীয় নাগরিকেরাই উদ্ধারকার্য চালাইয়া বিপন্নদের উদ্ধার করিবার দায়িত্বের সিংহভাগ পালন করিয়া থাকেন। ইহা প্রশংসাযোগ্য, সন্দেহ নাই। কিন্তু যাঁহারা দায়িত্বপ্রাপ্ত, তাঁহারা দায় পালন না করিলে তাহাদের কী ব্যবস্থা নেওয়া হইবে? মুর্শিদাবাদেই এই ধরনের দুর্ঘটনা ঘটিয়াছে ইতিপূর্বে। জলঙ্গীতে বাস জলে পড়িয়াছিল ১৯৯৮ সালে, বহরমপুরে ১৯৯৯ সালে। বেলডাঙায় গত মাসেই পুকুরে বাস পড়িয়াছিল। অথচ মুর্শিদাবাদ জেলায় প্রশাসনের নিজস্ব ডুবুরি নাই, মোটরবোট নাই, ক্রেন কোথা হইতে দ্রুত মিলিবে তাহার নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নাই।
প্রশাসনের শীর্ষ কর্তারা ঘটনাস্থলে দ্রুত পৌঁছাইয়াছিলেন কি না, তাহাই প্রশাসনিক তৎপরতার পরিমাপ হইতে পারে না। বিপর্যয়-মোকাবিলার জন্য প্রশিক্ষিত কর্মী ও পরিকাঠামো তৈরি হইয়াছে কি না, প্রধান প্রশ্ন তাহাই। বস্তুত, সেই ব্যবস্থাগুলি প্রস্তুত থাকিলে শীর্ষকর্তাদের দৌড়াদৌড়ির কোনও প্রয়োজন থাকে না, কোনও প্রশ্নই ওঠে না। বিপর্যয় মোকাবিলার পৃথক দফতর আছে, প্রতিটি জেলার নিজস্ব বিপর্যয় মোকাবিলা পরিকল্পনাও রহিয়াছে। সেই পরিকল্পনা অনুসারে কাজ হইয়াছে কি না, তাহার পর্যালোচনারও প্রয়োজন আছে। সেই সঙ্গে, কাহার গাফিলতির জন্য বিপর্যয় ঘটিতে পারিল, তাহারও তদন্ত প্রয়োজন। বেলুড়ে বাতিল লোহার কারখানাটি অবৈধ ভাবে বিপজ্জনক গ্যাস সিলিন্ডার লইয়া কাজ করিতেছিল। তাহাকে আটকাইবার কী ব্যবস্থা হইয়াছিল? পরিদর্শনের দায়িত্বপ্রাপ্ত সকল আধিকারিকের নিকট উত্তর দাবি করা প্রয়োজন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy