Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪
প্রবন্ধ ২

বছর ফুরোল, ‘অচ্ছে দিন’ এখনও অধরা

তাঁর নির্বাচনী প্রচারে অর্থনীতি বিষয়ে এক আশ্চর্য ধোঁয়াশা তৈরি করেছিলেন নরেন্দ্র মোদী। এক বছর পরে জমা-খরচের হিসেব মেলাতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, প্রাপ্তির ঘর এখনও প্রায় শূন্যই।এক বছর কেটে গেল। দেশের ১২৫ কোটি মানুষের প্রত্যেকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পনেরো লক্ষ টাকা করে জমা পড়েনি। অদূর ভবিষ্যতে পড়বে, তেমন সম্ভাবনাও ক্ষীণ। অরুণ জেটলি জানিয়ে দিয়েছেন, কালো টাকার প্রশ্নটা ছেলেখেলার নয়। কাজেই, অমন হুটোপাটি করলেই চলবে না। অমিত শাহ অল্প কথার মানুষ।

একটি স্লোগানের জন্ম। এক আর্থিক সভায় ভাষণ পেশ করছেন নরেন্দ্র মোদী। ছবি: রয়টার্স।

একটি স্লোগানের জন্ম। এক আর্থিক সভায় ভাষণ পেশ করছেন নরেন্দ্র মোদী। ছবি: রয়টার্স।

অমিতাভ গুপ্ত
শেষ আপডেট: ২৬ মে ২০১৫ ০০:৩৫
Share: Save:

এক বছর কেটে গেল। দেশের ১২৫ কোটি মানুষের প্রত্যেকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পনেরো লক্ষ টাকা করে জমা পড়েনি। অদূর ভবিষ্যতে পড়বে, তেমন সম্ভাবনাও ক্ষীণ। অরুণ জেটলি জানিয়ে দিয়েছেন, কালো টাকার প্রশ্নটা ছেলেখেলার নয়। কাজেই, অমন হুটোপাটি করলেই চলবে না। অমিত শাহ অল্প কথার মানুষ। বলেছেন, কালো টাকা দেশে ফিরিয়ে দেশবাসীর অ্যাকাউন্টে ভরে দেওয়ার কথাটা আসলে ‘জুমলা’। বাংলায়, কথার কথা। নির্বাচনী ভাষণে সভা গরম করতে ও রকম একটু বলতে হয়। সব কথা অত সিরিয়াসলি নিতে নেই।

পনেরো লক্ষ টাকা পাওয়ার আশায় কত জন বসে ছিলেন, বলা মুশকিল। কিন্তু, নরেন্দ্রভাই দিল্লির মসনদ আলো করে বসলে ‘অচ্ছে দিন’ আসবেই, এই বিশ্বাস ছিল অনেকেরই মনে। প্রশ্ন হল, ‘অচ্ছে দিন’ বলতে ঠিক কী বোঝায়? মুকেশ অম্বানীর ‘অচ্ছে দিন’, আর আমার-আপনার ও রামা কৈবর্তের ‘অচ্ছে দিন’ যে এক রকম হবে না, সে কথা বলে দিতে হয় না। নরেন্দ্র মোদী ঠিক কার ‘অচ্ছে দিন’-এর আগমনবার্তা ঘোষণা করতেন? তিনি সুচতুর রাজনীতিক। ভেঙে বলেননি, ‘অচ্ছে দিন’-এর মোড়কের মধ্যে কী কী থাকবে। ফলে, গোটা ব্যাপারটাই এক আশ্চর্য ধোঁয়াশা ছিল। বিশ্বাসে মোড়া ধোঁয়াশা।

স্লোগান আছে, লগ্নি নেই

কিছু দিন আগে একটা লেখায় (‘শুধু কেউ কেউ একটু বেশি সমান’, ১৩-৫) বলেছিলাম, মোদীর জমি অর্ডিন্যান্স আসলে মুষ্টিমেয় কিছু শিল্পপতির জন্য অবিমিশ্র সুসংবাদ। কিন্তু, সম্পদের সিঁড়ির একেবারে শীর্ষে থাকা মানুষরা ভোটের বাজারে অপ্রাসঙ্গিক। ‘অচ্ছে দিন’-এর প্রতিশ্রুতি তাঁদের জন্য ছিল না। যাঁদের জন্য ছিল, তাঁদের দুটো শ্রেণিতে ভেঙে ফেলা যায়। প্রথম, নিতান্ত দরিদ্র মানুষ, সরকারের প্রত্যক্ষ সহায়তা ছাড়া যাঁদের দিন চলে না। দ্বিতীয়, মধ্যবিত্ত ও নব্যমধ্যবিত্ত শ্রেণি, যাঁরা সরকারের দেওয়া চাল-গমের ওপর নির্ভরশীল নন, বাজারে নতুন সুযোগের মুখ চেয়ে থাকেন।

এই দুই শ্রেণির মানুষের কাছে ‘অচ্ছে দিন’-এর অর্থ আলাদা হওয়াই স্বাভাবিক। প্রথম দলের কাছে অচ্ছে দিনের মানে রেশন দোকানে আর একটু সস্তায় চাল, একশো দিনের প্রকল্পে আরও কয়েক দিন বেশি কাজের সুযোগ, মজুরির টাকা ঠিক সময়ে পাওয়া, ছেলেমেয়েদের আরও একটু পড়ার সুযোগ, স্কুলে একটু ভাল মানের মিড ডে মিল, হাসপাতালে একটু মানবিক পরিষেবা। আরও বেশি চাইতে বললে তাঁরা হয়তো কারিগরি শিক্ষার সুযোগ, কৃষিতে নিরাপত্তা, গ্রামীণ পরিকাঠামোর উন্নতির কথা বলবেন। দ্বিতীয় দলের কাছে ‘অচ্ছে দিন’ মানে অর্থনীতির দ্রুত বৃদ্ধি, শিল্পে বিনিয়োগ, নতুন চাকরির সুযোগ। নরেন্দ্র মোদীর নির্বাচনী ভাষণে সবার জন্য চাকরির প্রতিশ্রুতি এই শ্রেণির মানুষরা এখনও ভোলেননি।

যাঁরা বাজারের কাছে সুদিন প্রার্থনা করেছিলেন, নরেন্দ্র মোদীর প্রথম বছরটা তাঁদের হতাশ করেছে। এ বছর থেকেই আর্থিক বৃদ্ধির হার হিসেব করার জন্য নতুন বেস ইয়ার ব্যবহৃত হচ্ছে। হিসেবের সেই মারপ্যাঁচে দেখা গেল, ২০১৪-১৫ সালে ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে সাড়ে সাত শতাংশ। বাজেটের মুখে অরুণ জেটলিরা বেশ বুক ফুলিয়ে ঘুরলেনও বটে। গত বছরের পাঁচ শতাংশ বৃদ্ধির পাশে মোদীর প্রথম বছরের হিসেব চমৎকারই বটে। কিন্তু, রামচন্দ্রঃ। দেখা গেল, নতুন হিসেবে অঙ্ক কষলে মনমোহন সিংহের শেষ বছরের বৃদ্ধির হারও দাঁড়াচ্ছে ৬.৯ শতাংশ।

স্মার্ট সিটি, ডিজিটাল ইন্ডিয়া, ভারত মালার মতো শিল্পমুখী প্রকল্প প্রচুর। শিল্পপতিদের মুখেও মোদীর অগাধ প্রশংসা। কিন্তু, বিদেশি লগ্নির খাতায় ২০১৩-১৪’য় জমা পড়েছিল ২০৮০ কোটি ডলার, ২০১৪-১৫’য় পড়েছে ২৮৮০ কোটি। ভারতীয় বিনিয়োগকারীরাও তেমন হাত খোলেননি। যে আটটি শিল্পকে দেশের কোর সেক্টর বা কেন্দ্রিক ক্ষেত্র বলা হয়, তার সম্মিলিত বৃদ্ধির হার, মার্চ মাসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ঋণাত্মক। মানে, গত বছর এই ক্ষেত্রগুলিতে মোট যত উৎপাদন হয়েছিল, এ বছর তার তুলনায় উৎপাদন কমেছে।

এ দিকে, যাঁরা ভেবেছিলেন, মোদী এলেই ভারতীয় অর্থনীতির ভাঙা পথের রাঙা ধূলায় আর্থিক সংস্কারের রথ দৌড়োবে, তাঁরাও হতাশ। একটাও বড় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বিলগ্নিকরণ হয়নি গোটা বছরে। রাজ্যসভায় জমি বিল পাশ করানোর জন্য ঝালমুড়ি কূটনীতির আশ্রয় নিতে হচ্ছে। শ্রম আইন সংস্কারও নামমাত্র হয়েছে। রিটেলে বিদেশি বিনিয়োগের প্রশ্নেও সরকার টলমল করছে। সব মিলিয়ে, গত এক বছরে যে বিনিয়োগ আসেনি, আজ-কাল-পরশুর মধ্যেই তার ঢল নামবে, প্রবলতম মোদী-ভক্তও তেমন দাবি করার আগে এক বার থমকাবেন। সোজা কথা, যাঁরা বাজারের মুখ চেয়ে ছিলেন, তাঁরা অচ্ছে দিন-এর দেখা পাননি এ বছর। মেক ইন ইন্ডিয়ার স্লোগান পাওয়া গেছে, ওই পর্যন্তই।

গরিবরা কোথায়?

আর যাঁরা সরকারের কাছে সুদিন আশা করেছিলেন? নরেন্দ্র মোদীর ভাষণ অথবা অরুণ জেটলির বাজেট বক্তৃতা শুনে, অথবা অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যনের অর্থনৈতিক সমীক্ষা পড়ে তাঁদের মনে হতেই পারে, আহা! এই তো সুদিন সমাগত। মোদী তাঁর ভাষণে বলেছেন, একশো দিনের কাজের প্রকল্প তাঁর হৃদয়ের বড় কাছাকাছি থাকে। জেটলি জানিয়েছেন, প্রকল্পের বরাদ্দ তিনি বিন্দুমাত্র কমাননি। গত বাজেটের টাকার অঙ্ক অপরিবর্তিত রাখার অর্থ যে প্রকৃত প্রস্তাবে বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া, কারণ এক বছরে মূল্যস্ফীতির ফলে টাকার দাম কমেছে অন্তত সাড়ে পাঁচ শতাংশ, সেটা বোঝা সহজ। এটা বোঝা মুশকিল যে, প্রকল্পটিকে মেরে ফেলার অন্য ব্যবস্থা হয়েছে— মজুরির টাকা পাঠাতে ভয়ানক গড়িমসি করছে কেন্দ্র।

সুব্রহ্মণ্যন তাঁর আর্থিক সমীক্ষায় লিখেছেন, গরিবকে টাকা দিতে তাঁদের আপত্তি নেই মোটেই, কিন্তু ভর্তুকির টাকা বেহাত হয়ে যাওয়া ঠেকাতেই হবে। এই কথাটি বলার জন্য ওয়াশিংটন ডিসি থেকে তাঁর মতো সংস্কারপন্থী অর্থনীতিবিদকে মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা করে নিয়ে আসতে হল কেন, তা বোঝা মুশকিল। অমর্ত্য সেন তো বটেই, তাঁর অনুসারী ঝোলাওয়ালারাও সুব্রহ্মণ্যনের ঢের আগে, তাঁর চেয়ে ঢের কড়া ভাষায় এই বেহাত হওয়া ঠেকানোর প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। বস্তুত, গরিবের প্রতি সামান্য সহমর্মিতা আছে এমন যে কেউই বলবেন, ভর্তুকির টাকা চুরি যাওয়া যেমন অসহনীয়, তেমনই অপেক্ষাকৃত বড়লোকদের ভর্তুকি দেওয়াও প্রবল অন্যায়।

মোদীর রাজত্বে সুব্রহ্মণ্যনদের কেন প্রয়োজন, তার উত্তর অবশ্য সমীক্ষাতেই আছে। যেমন ধরুন, গণপরিসরে সরকারি বিনিয়োগের প্রসঙ্গটি চলে গেল শুধু রেলের পরিকাঠামোয় বিনিয়োগের কথাতেই। অর্থনীতির বিকাশে রেলের গুরুত্ব নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই। কিন্তু, শুধু রেলের লাইনে আম আদমির দিন চলবে না। নরেন্দ্র মোদীরা যে সরে আসছেন ইউপিএ জমানার অধিকারভিত্তিক কল্যাণনীতির থেকে, সেটা নির্বাচনের আগে থেকেই স্পষ্ট ছিল। কিন্তু, সরে কোথায় গেলেন, কল্যাণ অর্থনীতির কথা তাঁরা অতঃপর কোন পথে ভাববেন, তার কোনও হদিশ এক বছরে পাওয়া গেল না। মনে হল, এই জমানা যাকে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর জ্ঞান করছে, সেই জনধন-আধার-মোবাইলের হাতে ছেড়ে দেওয়া হবে উন্নয়নের ভার। নীতি হিসেবে এটা নতুন কিছু নয়। ইউপিএ আমলেই প্রত্যক্ষ নগদ হস্তান্তরের ব্যবস্থা হয়েছিল। ফারাক হল, এখন ধরে নেওয়া হয়েছে, মানুষের হাতে ভর্তুকির নগদ টাকাটুকু পৌঁছে দিলেই যথেষ্ট। সামাজিক পরিকাঠামোয় আর সরকারের বিনিয়োগের দরকার নেই।

সরকারি ভাবনার প্রমাণ খুঁজলে হাতের কাছেই অরুণ জেটলির বাজেট রয়েছে। জেটলি শিক্ষা খাতে মোট ৬৮,৯৬৮ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন। গত বাজেটে বরাদ্দ ছিল ৬৮,৬২৮ কোটি টাকা। টাকার অঙ্কেই বৃদ্ধির পরিমাণ ০.৪৯ শতাংশ। স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ হয়েছে ৩৩,১৫২ কোটি টাকা। গত বছর এই খাতে বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ৩৫,১৬৩ কোটি টাকা। মানে, সরাসরি বরাদ্দ কমেছে। বাজেটে খাদ্যের অধিকার আইনের উল্লেখ নেই কোথাও। নারী ও শিশুকল্যাণের খাতে বাজেট বরাদ্দ কমেছে ৪৪ শতাংশ।

গরিব মানুষ যে পরিষেবার জন্য প্রত্যক্ষ ভাবে সরকারের মুখাপেক্ষী, সেখানে সরকারি বিনিয়োগ ক্রমে কমছে, আরও কমবে বলেই আশঙ্কা। তর্কের খাতিরে না হয় ধরেই নেওয়া যাক, সেই টাকা সরকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারী কল্যাণ ইত্যাদির খাতে পৌঁছে দেবে গরিব মানুষের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে। কিন্তু হাসপাতাল বা স্কুলের পরিকাঠামোয় ঘাটতি থাকলে সে টাকায় পরিষেবা পাওয়া যাবে তো?

প্রশ্নটা করতে হয়, তাই করা। উত্তর আমরা জানি। কল্যাণ খাতে সরকারি বিনিয়োগ থমকে গেলে, অথবা কমতে থাকলে শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো পরিষেবা ক্রমে দরিদ্র মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাবে। এ দিকে, উন্নয়নের সুফল গরিবের কাছে চুঁইয়ে আসার জন্যও গরিব মানুষের কিছু সক্ষমতা প্রয়োজন। খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সেই সক্ষমতার একেবারে প্রাথমিক শর্ত। গরিবের পক্ষে এ এক বিচিত্র শাঁখের করাত। এক দিকে সরকার আম আদমিকে ট্রিকল-ডাউনের মতো বাতিল তত্ত্বের হাতে সঁপে দিচ্ছে, আর অন্য দিকে তার সক্ষমতা অর্জনের ন্যূনতম শর্তগুলোও পূরণ করছে না। এই পথে ‘অচ্ছে দিন’ আসবে, বিশ্বাস করতে বুক কাঁপবে অনেকেরই।

নির্বাচনী ভাষণে মোদী অর্থনীতিকে ধোঁয়াশায় ঢেকে রেখেছিলেন। তাঁর শাসনের এক বছরে সেই অনিশ্চয়তা গভীরতর হয়েছে। তিনি বিনিয়োগকারীদের সংস্কারের গল্প শুনিয়েছেন, সাংসদদের বলেছেন জনসভায় সরকারের কৃষকদরদি অবস্থান ব্যাখ্যা করতে। শেষ পর্যন্ত তাঁর অর্থনীতি কোথায় পৌঁছোবে, এক বছরে তার আঁচটুকুও পাওয়া যায়নি।

তিনি নিজে জানেন তো? নাকি, অর্থনীতির পুরো প্রসঙ্গটাই ‘জুমলা’?

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE