Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪
তাঁর কাছে রাজনীতি করা ও নিজের আত্মিক বিকাশের মধ্যে তফাত নেই

গাঁধীজি কেন প্রাসঙ্গিক

তার পর ধরুন অহিংসার কথা। আজ যে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ‘সার্জিকাল স্ট্রাইক’ দিবস পালন করতে বলা হচ্ছে, সেই মিলিটারি উন্মাদনার কথা বাদ দিলেও আমাদের জাতীয়, প্রাদেশিক বা স্থানীয় রাজনীতিতে হিংসার অস্তিত্ব কি অস্বীকার করা যায়? শুনিই তো, লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছে উন্নয়ন! কোন দল আর অহিংসার রাজনীতির দাবিদার হতে পারে এই ভারতে?

কেবলই ছবি? রাজনৈতিক মিছিলে আন্দোলনকারীরা মহাত্মা গাঁধীর ছবি বহন করছেন, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০০৭। ছবি: গেটি ইমেজেস।

কেবলই ছবি? রাজনৈতিক মিছিলে আন্দোলনকারীরা মহাত্মা গাঁধীর ছবি বহন করছেন, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০০৭। ছবি: গেটি ইমেজেস।

দীপেশ চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০২ অক্টোবর ২০১৮ ০০:১১
Share: Save:

গাঁধীজির সার্ধশতবর্ষ আজ। প্রতি বছরই ভাবি, এমন এক জন মানুষ যাঁর চিন্তাকে ভারতীয় রাজনীতি, শিল্পায়ন নীতি, ভোগবাদ প্রত্যহ খারিজ করে চলেছে, তাঁকে আমরা কেন স্মরণ করি? একটু সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে গাঁধীজির মতো ‘ব্যর্থ’ মানুষ আর ভারতীয় ইতিহাসে কে আছেন? যে ক্ষেত্রে তাঁর সারা জীবনের কাজ, ভারতীয় রাজনীতি তাঁর দেখানো পথে চলেনি। আধুনিক শিল্পসভ্যতায় তাঁর বিশ্বাস ছিল না। অথচ, তাঁর জীবৎকালেই তাঁর হাতে-গড়া দল কংগ্রেস ভারতকে শিল্পায়িত দেশ হিসেবে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়। কংগ্রেসের বহু নেতা তাঁর গ্রামভিত্তিক দেশের স্বপ্নকে অবাস্তব বলে ভেবেছেন।

তার পর ধরুন অহিংসার কথা। আজ যে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ‘সার্জিকাল স্ট্রাইক’ দিবস পালন করতে বলা হচ্ছে, সেই মিলিটারি উন্মাদনার কথা বাদ দিলেও আমাদের জাতীয়, প্রাদেশিক বা স্থানীয় রাজনীতিতে হিংসার অস্তিত্ব কি অস্বীকার করা যায়? শুনিই তো, লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছে উন্নয়ন! কোন দল আর অহিংসার রাজনীতির দাবিদার হতে পারে এই ভারতে?

তার পর ধরুন জাতপাতের রাজনীতির কথা। ভারতীয় রাজনীতিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেখানেও আজ অম্বেডকরের যুক্তি ও রাজনীতির কাছে গাঁধীজিকে পরাভূত মনে হয়। ‘হরিজন’ শব্দটি আর ‘হরিজন’দেরও পছন্দ নয়। পৃথিবী জুড়ে তার জায়গা কেড়ে নিয়েছে ‘দলিত’ কথাটি। আরও অনেক সমালোচনামূলক প্রশ্ন শুনি: গাঁধীজি কি নারীবাদী ছিলেন, না কি প্রকারান্তরে পুরুষতন্ত্রেরই সমর্থক? তাঁর কি ‘বৈজ্ঞানিক মনোভাব’ ছিল, না ‘ধর্মীয় কুসংস্কার’-এর ধারকবাহক ছিলেন গাঁধীজি (রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ১৯৩৪ সালের বিহার ভূমিকম্প নিয়ে তর্কের কথা স্মরণ করুন)? সেই আদি প্রশ্ন: তিনি কি সত্যিই ‘মহাত্মা’, না কি আজকের এক বরিষ্ঠ নেতার ভাষায়, এক জন ‘চতুর বানিয়া’ মাত্র?

যাঁকে ঘিরে এত প্রশ্ন, এত সন্দেহ, তাঁকে প্রতি বছর স্মরণ করা কেন? বলতেই পারেন, রাষ্ট্রমাত্রই নিজের একটি শ্রদ্ধেয় অতীত প্রণয়ন করতে চায়। তাই প্রখ্যাত কিছু মানুষের ছবি টাকা-পয়সায় ও প্রথাগত রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমের বর্ষপঞ্জিকার অন্তর্ভুক্ত করে রাখে। গাঁধীজির জন্মদিন পালন কি একটি অন্তঃসারশূন্য রাষ্ট্রিক প্রথামাত্র? কিন্তু রাষ্ট্রিক প্রথার বাইরেও যে গাঁধীজি বেঁচে থাকেন। ভারতে এখনও অনেক ব্যক্তি-মানুষ আছেন, যাঁদের মনেপ্রাণে ‘গাঁধী মহারাজের শিষ্য’ বলে বর্ণনা করা যায়। ভারতের বাইরেও গাঁধীজির নাম মানুষের স্মৃতিতে এখনও উজ্জ্বল। এখনও সেই মুণ্ডিত মস্তক, শীর্ণদেহী, চশমাধারী, হাতে-লাঠি, চাদরে ঘেরা, দৃঢ়চেতা মানুষটিকে সাধারণের স্মরণে আছে বলেই না ‘অ্যাপল’ কম্পিউটার কোম্পানি দেশ-বিদেশে তাঁদের বিজ্ঞাপনে মানুষটির অবয়বের একটি রেখচিত্রমাত্র ব্যবহার করতে পারে! বিশ্বে সাধারণ মানুষের কাছে রবীন্দ্রনাথের নাম নানা কারণে ফিকে হয়ে এসেছে, কিন্তু গাঁধীজির নয়। অবশ্যই ঐতিহাসিক ভাবে মানতেই হয় যে নেলসন ম্যান্ডেলা বা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের মতো নেতাদের গাঁধীপ্রীতি গাঁধীজির নামের প্রসার বাড়িয়েছে। কারণ যা-ই হোক, সব মিলিয়ে পৃথিবীতে গাঁধীজির স্থান মানুষের মনে আজও অম্লান, তাঁর নিজের দেশে তিনি যতই বিতর্কিত হোন না কেন!

আজও কেন এই ‘ব্যর্থ’ মানুষটি আমাদের মনে থেকে যান তাঁর বিশ্বজনীন আবেদন নিয়ে? এই প্রশ্নের যথাযথ উত্তর নিশ্চয়ই জটিল। এখানে গাঁধীজিকে পড়া ও পড়ানোর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে একটি সংক্ষিপ্ত উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করি।

আজ প্রায় পঁচিশ বছর আমি একটি মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই। পঁচিশ বছর ধরেই এখানে ছাত্রছাত্রীদের গাঁধীজির রচনা পড়ানো হয়। কোনও ভারত-সম্পর্কিত পাঠ্যক্রমের অংশ হিসেবে নয়, গাঁধীজিকে পড়ানো হয় এমন সব পাঠ্যক্রমে যেখানে সমস্ত ছাত্রের সাধারণ শিক্ষার একটি ভিত্তি প্রস্তুত করার চেষ্টা করা হয়। ফলে গাঁধীজির রচনার স্থান হয় প্লেটোর ‘অ্যাপলজি’ বা লকের ‘হিউম্যান আন্ডারস্ট্যান্ডিং’ বা ‘মার্ক্স-এঙ্গেলস’-এর ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’ বা জন স্টুয়ার্ট মিলের ‘অন লিবার্টি’-র পাশেই। মার্কিন মানববিদ্যার পাঠ্যক্রমে আর কোনও উপমহাদেশীয় মানুষ এমন জায়গা করে নিয়েছেন বলে আমার জানা নেই।

গাঁধীজির যে বইটি এ রকম সাধারণ পাঠ্যক্রমে পড়ানো হয়, তাই নিয়েই একটু বলি। বইটি ‘হিন্দ-স্বরাজ’। ১৯০৯ সালের নভেম্বর মাসে ইংল্যান্ড থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা সমুদ্রযাত্রার সময় মাত্র দশ দিনের মধ্যে গুজরাতি ভাষায় বইটি লেখেন গাঁধীজি। ১৯১০ সালে বইটির স্বকৃত ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেন। ফলে বইটি আজ একশো বছরেরও পুরনো। পাঠকের স্মরণে থাকতে পারে, এই বই পড়েই মহামতি গোখলে গাঁধীজিকে উপদেশ দিয়েছিলেন, ‘‘কয়েক বছর ভারতবর্ষে থেকে দেশটাকে জানো, তার পর এই বইটি ধ্বংস করে ফেলো!’’ এই বই প্রকাশের সময় থেকেই বইটির অনেক সমালোচনা ছিল। কিন্তু এই বইটির মূল বক্তব্যে আজীবন বিশ্বাসী ছিলেন গাঁধীজি। রবীন্দ্রনাথের যেমন ছিল ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধটি, গাঁধীজিরও তেমনই ছিল ‘হিন্দ-স্বরাজ’। এ যেন মানুষটির সামাজিক-রাজনৈতিক-ব্যক্তিগত দর্শনের এক ম্যানিফেস্টো! জীবনের শেষে এসেও গাঁধীজি বলতেন, বইটির দু’একটি শব্দ ব্যতীত আর কিছুই তিনি পরিবর্তনের যোগ্য মনে করেন না। বন্ধু হেনরি পোলককে এক বার বলেছিলেন, এই বইয়ের বক্তব্যগুলো যেন তাঁকে ভূতের মতো চেপে বসেছিল, যেন এই বই না লিখলেই নয়। লিখেওছিলেন ঝড়ের বেগে, মাত্র দশ দিনে, কোনও এক প্রয়োজনবোধের ঘোরের ধাক্কায়।

আমরা কেন আজও এই পুরনো বইটি মার্কিন দেশে পাঠরত ছাত্রছাত্রীদের জন্য অবশ্যপাঠ্য বলে মনে করি? ‘হিন্দ-স্বরাজ’ গাঁধীজির আরও নানা চিন্তার মতোই একটি ‘অবাস্তব’ চিন্তার সংগ্রহ। সমগ্র বই জুড়ে গাঁধীজি বলছেন মানুষের আত্মিক ও সার্বিক অহিংসার সাধনা তার লোভ সংবরণের মধ্যে। আধুনিক শিল্পসভ্যতার মধ্যে বাস করে ও তারই অংশ হয়ে এই সাধনা কখনওই সার্থক হতে পারে না। শিল্প-সভ্যতা বলতে শুধু যন্ত্র-লোহালক্কড়-কারখানা-রেলগাড়ি-মোটরগাড়ি নয়, সেই সঙ্গে গাঁধীজি টেনে নিয়ে এসেছেন আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যা, আইন, এমনকি পার্লামেন্টারি রাজনীতিও। তিনি বলছেন এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানই লোভকে মদত দেয়। লোভই হিংসার উৎস। নকশালি আমলে দেখতাম বিপ্লবীরা লেনিনের ভাষা উদ্ধৃত করে পার্লামেন্টকে ‘শুয়োরের খোঁয়াড়’ বলছেন। গাঁধীজি ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টকে তুলনা করেছিলেন ‘বন্ধ্যা নারী’ ‘বেশ্যা’র সঙ্গে!

পাশ্চাত্যের ইতিহাসে অ্যাডাম স্মিথ থেকে শুরু করে হালফিলের অনেক তাত্ত্বিক আছেন, যাঁরা মনুষ্যসভ্যতায় ‘স্বার্থপরতা’ ও ‘স্বার্থসন্ধান’-এর ভূমিকার তারিফই করে গিয়েছেন। বর্তমানে এক ধরনের রাজনৈতিক দর্শন এ-ও বলে যে, সমাজ বস্তুটি একটি ‘ম্যানেজ’ করার জিনিস। যদি আইনের আটঘাট ভাল করে বাঁধা যায় ও তার যথাযথ প্রয়োগ করা যায়, তা হলে চোর-ছেঁচড়-গুন্ডাও দেশ ভাল ভাবে চালাতে পারবে, কারণ তাদের চুরি করার কোনও উপায়ই থাকবে না! গাঁধী কিন্তু এ সব কথার ধারেকাছে নেই। তাঁর কাছে রাজনীতি করা ও ব্যক্তি-মানুষের আত্মিক বিকাশের মধ্যে কোনও তফাত নেই। তিনি মনে করতেন জনপরিসরের মধ্যে থেকেও নিজের ‘মোক্ষ’-এর আদর্শে কাজ করা যায়। বলা বাহুল্য, গাঁধীজির ‘হিন্দ-স্বরাজ’ পড়ে আমার ছাত্ররা যে সব গাঁধীবাদী হয়ে যায়, তা মোটেই নয়। কিন্তু গাঁধীজির ভাবনার আলোচনায় তারা উৎসাহী হয়ে ওঠে। বস্তুত আমার কাছে বইটির যে গুজরাতি সংস্করণটি আছে, তা এই ক্লাসে পড়ানোর পর এক ছাত্রের কাছ থেকে উপহার হিসেবে পাই। গাঁধীজি ও গুজরাতে তার আগ্রহ জন্মেছিল।

ভাবি, এই বই পড়ে আমার ছাত্রছাত্রীরা, মার্কিন সমাজের ধনতান্ত্রিক ও পয়সা-পূজারি সমাজেই যাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ বসবাসের ও সাফল্যের স্বপ্ন দেখে, তারা কী পায়? সহজ করে বলতে পারি, তারা পায় এমন এক জন মানুষের সাক্ষাৎ যিনি আমাদের শেখান কী ভাবে বাস্তব কাজকর্মে নীতির সঙ্গে আপস যাতে ন্যূনতম মাত্রার বেশি না হয়, সে দিকে তীক্ষ্ণ ও সতর্ক দৃষ্টি রেখে বাঁচতে হবে। কথাটা আর একটু বুঝিয়ে বলি। আমরা অনেকেই যৌবনে আদর্শবাদী হই। তার পর সারা জীবনের প্রচেষ্টা হয় আদর্শটাকেই নমনীয় করে বাস্তবমুখী করে তোলা। যাঁরা তা করেন না, তাঁদের আমরা অবাস্তব মানুষ বলে কৃপার দৃষ্টিতে দেখি। গাঁধীজি ছিলেন এই রকম এক ঘোর ‘অবাস্তব’ মানুষ, যিনি ভাবতেন ‘বাস্তব’কে ততটুকুই জমি ছাড়ব, যেটুকু না ছাড়লে নয়। সংগ্রাম হবে, বাস্তবটাকেই আদর্শের কাছাকাছি নিয়ে আসার।

কতটা ‘অবাস্তবতা’র পক্ষে যে সংগ্রামী ছিলেন গাঁধীজি, তার একটা উদাহরণ দিই। তাঁর জীবৎকালেই তাঁর চিন্তার সমালোচকেরা তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘আচ্ছা এই যে আপনার যন্ত্র বিরোধিতা, শরীরটাও তো এক প্রকারের যন্ত্র, তার বিরোধিতা করেন না কেন?’’ গাঁধীজি এতটুকু দ্বিধা না করে বলেছিলেন, ‘‘যন্ত্র নয়, যন্ত্রের প্রতি যে লোভ, তার বিরোধিতা করি।’’ মেনে নিয়েছিলেন যে কিছু যন্ত্র, শরীরের মতোই অবশ্যম্ভাবী। তারা থাকবেও। কিন্তু এই ‘অবাস্তব’ কথাটিও গভীর প্রতীতির সঙ্গে বলেছিলেন। তাঁর ভাষাতেই বলি, ‘‘দ্য বডি ইটসেল্ফ অ্যাজ় আই টোল্ড ইউ, ইজ় দ্য পিয়োরেস্ট পিস অব মেকানিজ়ম; বাট ইফ ইট ইজ় আ হিন্ডরান্স টু দ্য হায়েস্ট ফ্লাইটস অব দ্য সোল, ইট শুড বি রিজেক্টেড।’’ যন্ত্রের দাস হওয়া, এমনকি শরীর-যন্ত্রেরও, গাঁধীজির পক্ষে সম্ভব ছিল না।

এই যে গাঁধীজির পন্থা, যে নীতির সঙ্গে আপসটাই হবে ন্যূনতম, তথাকথিত বাস্তবের সঙ্গে নয়, এই পন্থার একটি প্রাসঙ্গিকতা থেকেই যায়। শুধু মার্কিন জীবনে নয়, ভারতীয় জীবনেও। ১৯৪৫ সালে নেহরু ও গাঁধীজির মধ্যে ভারতবর্ষে শহর ও গ্রামের উন্নতি নিয়ে কিছু চিঠিপত্র চলে। ১৯৪৫ সালেও নেহরু লিখছেন তাঁর বাপুকে যে, ‘হিন্দ-স্বরাজ’ একটি ‘সম্পূর্ণ অবাস্তব’ গ্রন্থ। শিল্প, ভারী শিল্প ও শহর ছাড়া ভারতের দ্রুত উন্নতি কী ভাবে সম্ভব? জবাবে গাঁধীজি লিখছেন ‘হিন্দ-স্বরাজ’-এর দর্শন থেকে তিনি কোনও দিনই বিচ্যুত হবেন না, এমনকি সম্পূর্ণ একাকী হয়ে গেলেও নয়। কিন্তু তার পরই একটি মোক্ষম কথা লিখেছেন গাঁধীজি— যে শহরে কোটি কোটি মানুষকে এনে ফেলা হবে, সেই শহরে কি মানুষের পক্ষে হিংস্রতা এড়ানো সম্ভব?

কথাটি আজ বিশেষ ভাবে অনুধাবনযোগ্য। যদি গোড়া থেকেই আমাদের নেতারা নীতিগত ভাবে এই ‘অবাস্তব’ নীতিতে বিশ্বাস করতেন যে, একটি শহরবাসীও বস্তিতে, নোংরায়, আবর্জনায়, অস্বাস্থ্যে ও অশিক্ষায় বাঁচবে না ও শুধুমাত্র এই শর্তেই শহর তৈরি হবে ভারতে— তা হলে কি আজ ভারতের শহরের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার যা সমস্যা, তা এই মাত্রা পেত? আজ প্রতিটি ভারতীয় শহর জনসংখ্যার চাপে, বৈভবের বৈষম্যের চাপে, বায়ুদূষণের কারণে জর্জরিত। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, এই সব নিয়ে শহুরে মানুষের প্রাণপণ প্রতিযোগিতা। অথচ শহরের রক্ষণাবেক্ষণ, পরিকাঠামো— ব্রিজভাঙা বাঙালিকে আর এ কথা মনে করিয়ে দিতে হবে না, কিছুরই যথাযথ পরিমাণে জোগান নেই। পাঠক হয়তো বলবেন, মানুষের উপায় কী? বাগড়ি মার্কেট পুড়ে যাক, আবার ওই রকম জতুগৃহে বসেই তো ব্যবসা চালাতে হবে? এক অর্থে সত্য, এটাই আজকের ‘বাস্তব’। কিন্তু গাঁধীজি হয়তো আমাদের নেতৃবৃন্দের দিকে তাকিয়ে বলবেন, ‘‘তোমরা নীতিগত ভাবে ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’-এ বিশ্বাস করো না। তোমরা ভেবেছ, যেনতেনপ্রকারেণ উন্নয়নটি হয়ে যাক। তা হলেই অবশেষে সবার মঙ্গল।’’ কিন্তু এই ‘অবশেষ’-এ পৌঁছনোর পথেই তো সাধারণ মানুষের যত বিপত্তি। গাঁধীজি হলে বলতেন, আগে স্থির করো অহিংস সমাজ গড়াটাই উপায় ও লক্ষ্য, তার পর উন্নয়ন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান এই সমস্ত ‘বিকাশ’-এর কথা অন্য ভাবে ভাবো। এখানেই গাঁধীজি, আজকাল যাকে উন্নয়নের ‘বিকল্প ভাবনা’ বলা হয়, সেই ভাবনার পথের পথিক। আমাদের বিচারে তাঁকে ‘অবাস্তব’ মনে হতে পারে, কিন্তু যখন প্রত্যহ দেখি সাধারণ মানুষের স্বার্থ-সুবিধা জলাঞ্জলি দিয়ে উন্নয়নের রথযাত্রা, তখন তাঁর উচ্চারিত প্রশ্ন থেকেই যায়, আমরা কি আমাদের আদর্শকেই প্রতিনিয়ত বাস্তবের সঙ্গে খাপ খাওয়াচ্ছি? হয়তো বা আমাদের আদর্শটাই অমন দৃঢ় কিছু ছিল না?

আজকের ভারতের দিকে তাকিয়ে অবশ্য ‘হিন্দ-স্বরাজ’ বইটির আর একটি প্রাসঙ্গিকতার কথাও মনে পড়ে। এই বইটিতে বিশ শতকের গোড়ার দিকে যে
ভারতীয় নেতা বা রাজনৈতিক চিন্তাবিদদের বিরোধিতা করে গাঁধীজি লিখেছেন, তাঁরা সবাই ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামে হিংসার পূজারি। যে লন্ডনে গাঁধীজি এঁদের সাক্ষাৎ পান, সেখানে হিংসার রাজনীতির দিশারি ছিলেন বিনায়ক দামোদর সাভারকর, পরবর্তী কালে যিনি ‘হিন্দুত্ব’-এর রাজনীতির জনক হয়ে দেখা দেবেন। আজ ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে মনে হয় গাঁধী বনাম সাভারকর তর্কটাই যেন নতুন চেহারা নিয়ে ফিরে এসেছে। আশা করি আজকের ছাত্রছাত্রীরা মনোযোগ দিয়ে সাভারকরও পড়বে, গাঁধীজিকেও পড়বে। দু’জনকেই মনোযোগ দিয়ে পড়ে তারা নিজেদের অবস্থান স্থির করে নেবে। গাঁধীজির জন্মদিন আজ এক নতুন রাজনৈতিক তাৎপর্য নিয়ে ফিরে এসেছে।

শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের শিক্ষক

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE