মনোযোগী। কলকাতায় নেতাজি ভবনে। ২০০৩
পা র্লামেন্টের সদস্য হিসেবে নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি কালামের নিমন্ত্রণে রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়েছি। বড় ব্যাংকোয়েট নয়, মোটের উপর ছোটখাটো লাঞ্চ। বুফে টেবিল থেকে খাবার নিয়ে বসতে হবে। সামান্য আলাপচারিতা, ফলের রস পান ইত্যাদির পর খেতে যাবার ডাক পড়ল। খাবার ঘরে টেবিলের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে কার সঙ্গে যেন কথা বলছি, এক জন প্লেট নিয়ে এসে আমার কাছে ধরলেন। অন্যমনস্ক ভাবে হাত বাড়ালাম। কী কাণ্ড! অপ্রস্তুত হয়ে চেয়ে দেখি রাষ্ট্রপতি আমার দিকে খাবার প্লেট এগিয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন! বিশেষ পদাধিকারী হলে নানা প্রোটোকল মেনে চলাই রীতি। আমরা তাতেই অভ্যস্ত। একসঙ্গে খেতে বসলেও আগে রাষ্ট্রপতিকে পরিবেশন করতে হয়, পরে অন্য অতিথি।
আবদুল কালাম সাহেবের সঙ্গে আমার যখন প্রথম দেখা হয়েছিল, তখনও উনি রাষ্ট্রপতি হননি, বিখ্যাত বিজ্ঞানী। আমরা সবে পোখরানে নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণ করেছি। দিল্লি বিমানবন্দরে এগজিকিউটিভ লাউঞ্জে ঢুকে দেখি পাকা চুল পরিপাটি আঁচড়ানো বিজ্ঞানী বসে আছেন। রোজ কাগজে ছবি দেখি, পরিচিত মুখ। আমি কাছে গিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে বললাম, আগামী সপ্তাহে লোকসভায় নিউক্লিয়ার বিতর্ক আছে। আমাকে অংশগ্রহণ করতে হবে। আমি কী বলব, বলুন তো! তখন এক দিকে সাধারণ ভারতীয়রা বেশ গর্ব বোধ করছেন। অন্য দিকে কোনও কোনও দেশ, যেমন জাপান, যারা আণবিক বোমার শিকার, তারা ঘোর সমালোচনা করছে। আর আমেরিকা তো বরাবরই মনে করে ওদের নিউক্লিয়ার শক্তি থাকতে পারে, অন্য দেশের কোনও অধিকার নেই। কালাম আমাকে বললেন, একটা কথা বক্তৃতা করার সময় মনে রাখবেন। যে শক্তিশালী তাকে সকলে সমীহ করে, যে দুর্বল তাকে কেউ পাত্তা দেয় না। এই কথা মনে রেখে তার পর আপনার যা মত তা নিশ্চয় বলবেন।
রাষ্ট্রপতি হবার পর তিনি আমাদের পার্লামেন্টের সদস্যদের ছোট ছোট দলে ভাগ করে ডেকে পাঠাতেন ও নানা রকম উপদেশ দিতেন। এ সব হত ব্রেকফাস্ট মিটিং। প্রথম বার বুঝতে পারিনি, ব্রেকফাস্ট খেয়ে ওঁর কাছে বিদায় চাইলাম। উনি বললেন, ‘নো নো, ইউ কান্ট গো, জরুরি কথা আছে।’ এর পর আমাদের পাশের ঘরে ডেকে নিলেন। অনেকটা ক্লাসরুমের মতো ব্যবস্থা। সামনে স্ক্রিনে নানা রকম ছবি আর গ্রাফ। আমরা বসলাম। সে দিন পশ্চিমবঙ্গ আর বোধহয় ওডিশাকে ডেকেছেন। আমাদের সময়ে পশ্চিমবঙ্গের সদস্য বলতে আমার কমিউনিস্ট বন্ধুরা দলে ভারী। তাঁরা সদলবলে উপস্থিত। উনি নানা রকম গ্রাফ দেখিয়ে বোঝাতে শুরু করলেন কেন পশ্চিমবঙ্গ উন্নয়নে পিছিয়ে পড়ছে। কঠোর সমালোচনা নয়। স্নেহশীল অভিভাবকের মতো উপদেশ। রাজ্যের তদানীন্তন শাসক দলের কিঞ্চিৎ অস্বস্তি। সোমনাথবাবু (চট্টোপাধ্যায়) হাত তুলে উঠলেন, দু’একটা ব্যাখ্যাও দিলেন। মনোযোগী রাষ্ট্রপতি শুনলেন, তার পর কী ভাবে উন্নয়নে আরও গতি আনা যায়, বলতে লাগলেন।
সাধারণত যখন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করতে যাই তখন কিছুক্ষণ ওয়েটিং রুমে বসি, চা-স্ন্যাক্স আসে, একটু সময় কাটে, তার পর ডাক পড়ে। কালাম সাহেবের আমলে সোজা তাঁর বসবার ঘরে ডাক পড়ত। এক কোণে টেবিলে কম্পিউটার সামনে ঝুঁকে পড়ে কাজ করে চলেছেন তিনি। যখন কোনও বিশেষ বিষয়ে কথা বলতে গিয়েছি তখন দেখেছি আগে থেকে তিনি সেই বিষয়ে পড়াশুনো করে তৈরি। চেয়ার টেনে সেই টেবিলেই বসে তাঁর মতামত শুনতে হত।
এক বার এক কূটনীতিক তাঁর অভিজ্ঞতার কথা আমাকে বলেছিলেন। যখন পার্লামেন্টের বিদেশ মন্ত্রক কমিটির চেয়ারপার্সন ছিলাম তখন অনেক ডিপ্লোম্যাট নতুন কোনও দেশে রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হলে কার্যভার গ্রহণ করার আগে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসতেন। এক ধরনের প্রোটোকল এবং সৌজন্য সাক্ষাৎ। এই বিশেষ কূটনীতিককে আমরা পাকিস্তানে আমাদের হাই কমিশনার হিসেবে পাঠাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এমন সময় পার্লামেন্টে জঙ্গি হানার ফলে দুই দেশে মুখ-দেখাদেখি বন্ধ। বেশ কিছু দিন হয়ে গেলেও জট যখন কিছুতেই খুলল না, আমরা তাঁকে অন্য একটি ইউরোপীয় দেশে নিযুক্ত করলাম। তিনি যাবার আগে আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। তিনি বললেন, ‘আপনার কাছে আসার আগে আমি প্রেসিডেন্ট কালামের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখলাম উনি কম্পিউটার খুলে বসে আছেন এবং ইউরোপীয় দেশটি সম্পর্কে সব তথ্য সংগ্রহ করে রেখেছেন। আমাকে পাশে বসিয়ে উনি দীর্ঘ লেকচার দিলেন। বললেন, ‘সব নোট করে নিন।’ আমি তাড়াতাড়ি কাগজকলম বার করলাম।’ বিদেশে নিযুক্ত হলে তিনি বরাবরই রীতি মেনে বিভিন্ন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গিয়েছেন। কিন্তু এমন অভিজ্ঞতা আগে কখনও হয়নি।
ওঁর সঙ্গে সম্প্রীতির সম্পর্ক স্থাপিত হবার পর আমি ওঁকে নেতাজি ভবনে আমন্ত্রণ জানালাম। উনি প্রথম কলকাতা ভিজিটেই নেতাজি ভবনে এলেন। আবদুল কালামকে নেতাজি ভবন ঘুরিয়ে দেখানো এক অভিজ্ঞতা। সব কিছু খুঁটিয়ে দেখলেন, সুগতকে অনেক ইতিহাসঘটিত প্রশ্নও করলেন। তাঁর মধ্যে এক মানসিক আবেগ লক্ষ করলাম, যখন তিনি নেতাজির শোবার ঘর ও বসবার ঘর পরিদর্শন করলেন। বসবার ঘরে ঢুকে উনি নেতাজির টেবিলের উল্টো দিকে চেয়ার টেনে বসে পড়লেন। সঙ্গী রাজ্যের গভর্নরকে পাশের চেয়ার দেখিয়ে বললেন, ‘আপনিও বসুন।’ তার পর নির্দেশ দিলেন, ‘এ বার চোখ বুজে ফেলুন।’ তিনি চোখ বন্ধ করলেন। সব সমবেত দর্শক ও সাংবাদিককুলকে তিনি বললেন, ‘সবাই চুপ করুন, শান্ত হোন। আমি এখন সামনের চেয়ারে নেতাজিকে ভিশুয়ালাইজ করব।’ সবাই নীরব। পরের দশ মিনিট আমরা কেউ চোখ বন্ধ করে, কেউ বা খুলে রেখেও স্থাণুবৎ রইলাম।
অনেকে ওঁর ব্যবহারের মধ্যে খামখেয়ালিপনা দেখতেন। কিন্তু তিনি সব বিষয়ে অত্যন্ত সিরিয়াস ও আন্তরিক ছিলেন। এই যে ছাত্রদের প্রতি তাঁর ভালবাসা, নতুন প্রজন্মকে দিয়ে শপথ গ্রহণ করাতেন দেশের মঙ্গল ও উন্নতির জন্য সর্বস্ব দিতে হবে, এর মধ্যে কোনও দেখনদারি ছিল না। ছিল গভীর আত্মোপলব্ধি। তাই তো ‘পিপল্স প্রেসিডেন্ট’, জনসাধারণের প্রিয় রাষ্ট্রপতির পরিচিতি পেয়েছিলেন তিনি। আমরা ভুলে যাইনি মাত্র বছর তিনেক আগে যখন কাকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেখলে মানুষ খুশি হবেন এই সমীক্ষা করা হয়েছিল, সত্তর শতাংশ পেয়ে এগিয়ে ছিলেন আশি বছর বয়সি ‘তরুণ’ বিজ্ঞানী।
দিল্লিতে এক বিশাল সেমিনার। তখন আমি পার্লামেন্টে নেই, সাধারণ নাগরিক হিসেবে গিয়েছি। কালাম এসেছেন উদ্বোধন করতে। মঞ্চে উঠে সামনের সারিতে আমাকে দেখে তিনি শিশুর মতো খুশি হয়ে হাত নাড়তে লাগলেন। ‘মিসেস বোস, মিসেস বোস’— উচ্চস্বরে বলতে লাগলেন তাঁর কলকাতা ভিজিটের কথা। আমি অপ্রতিভ তবে আনন্দিত। চমৎকার ভাষণ দিলেন। তার পর প্রশ্নোত্তর পর্ব চলছে। উদ্যোক্তারা আমাকে একটা চিরকুট পাঠালেন, ‘আপনাকে দেখে উনি এত খুশি হলেন, আপনি একটা প্রশ্ন করুন।’
আমি ওঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, সেই যে প্রথম সাক্ষাতে দিল্লি বিমানবন্দরে আপনি শক্তিশালী ও দুর্বল তত্ত্বের কথা বলেছিলেন, তার পর অনেক দিন হয়ে গেল, আপনি কি আজও সেই তত্ত্বে বিশ্বাস করেন, না মত পালটেছেন? তিনি বললেন, ‘আজও আমি বিশ্বাস করি ব্যক্তিজীবনে যেমন, জাতীয় জীবনেও তেমনই আত্মবিশ্বাস থাকা। আত্মমর্যাদাবোধ থাকা জরুরি। শক্তিশালী হলে তবেই সেটা অর্জন করা যায়।’
কালাম আমাদের মধ্যে আজ আর নেই। দেশের মঙ্গলের জন্য চিন্তা করার, জগৎসভায় ভারতের মানমর্যাদা তুলে ধরার ভাবনা করার মতো এক জন মানুষ চলে গেলেন।
ভূতপূর্ব সাংসদ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy