গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
ইশকুলের পরীক্ষা হোক কিংবা অধ্যাপনার নেট প্র্যাকটিস— কালিদাস গোয়েন্দা ছিল, এই কথা লিখে এলে সাহিত্যের ইতিহাসে গোল্লা পাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নিশ্চিত। গর্দান না যাক, কানমলা জুটবেই! কিন্তু বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যের প্রসঙ্গ এলে কালিদাস ছাড়া আলোচনা কি সম্ভব? এমনকি, তাকে তো এক নম্বরেই রাখা উচিত বলে মনে হয়।
সত্যিই বাঙালির সৌভাগ্য যে তার ভাষায় ব্যোমকেশ বক্সী, প্রদোষচন্দ্র মিত্রর মতো চরিত্র নির্মিত হয়েছে। কিন্তু একইসঙ্গে গড় বাঙালির এ দুর্ভাগ্যও যে গোয়েন্দা বলতে সে অদ্যাবধি মূলত ব্যোমকেশ আর ফেলুদাই বুঝে এল; যারা আদপে ষোলো আনা মৌলিক নয়। বেকার স্ট্রিটে ঢুঁ না মেরেও বলে দেওয়া যায়, তাদের কাজের তরিকা শ্রীহোমস থেকে বহুলাংশে অনুপ্রাণিত। ঘাবড়াবেন না, ‘অনুপ্রেরণা’ শব্দটি বাংলার রাজপথের হোর্ডিং-ব্যানারে নবরূপে আবির্ভূত হয়ে থাকতে পারে, বাংলা সাহিত্যের গলিঘুঁজিতে এর ব্যবহার সুপ্রাচীন। নিন্দকেরা যাকে ঠেস দিয়ে বলে থাকেন— প্রভাবিত।
তা সত্ত্বেও স্রেফ গদ্যভাষার কারণেই শরদিন্দুবাবুকে আজও মাথায় করে রাখতে হয়। রায়সাহেবের ঝরঝরে লেখার ক্ষেত্রেও তার অন্যথা দেখি না। তাঁদের সৃষ্ট গোয়েন্দা চরিত্রগুলির প্রসঙ্গ এলেও খানিক নড়েচড়ে বসি বইকি! মলাট টু মলাট মন্ত্রমুগ্ধের মতো ভেসে যেতে হয়। তবু, তার পরেও, ভোট যাবে কালিদাসের পক্ষে।
কবি কালিদাস। ধীর। স্থিতধী। তীক্ষ্ণবুদ্ধি। অথচ, দৃশ্যত কমন ম্যান। যাকে চট করে চেনা যায় না। আবার অচেনার মাঝে কী রকম চেনা চেনা ঠেকে। এই আপাত সাদামাটা, ভিড়ে-মিশে-থাকা কালিদাসের বরং আভাস মিলবে শরদিন্দুরই সেই কয়লা-শহরে। অজিত ও ব্যোমকেশ যেখানে হপ্তাখানেকের জন্য প্রবাসযাত্রা করেছিল। ঘনিয়ে উঠেছিল মোহিনীমায়ায় প্রাণহরি পোদ্দারের মৃত্যুরহস্য। কাহিনির শেষ দিকে অজিত লিখছে, ‘খুনের রাত্রে ট্যাক্সি-ড্রাইভার ভুবনেশ্বর দাস যে অকুস্থলে উপস্থিত ছিল তা আমরা সকলেই জানতাম, অথচ তার কথা একবারও মনে আসেনি। একেই জি. কে. চেস্টারটন বলেছেন, অদৃশ্য মানুষ— ইনভিজিবল ম্যান।’ এইখানে মনে পড়তে পারে আর এক ট্যাক্সি ড্রাইভারের কীর্তিকলাপ। ‘আ স্টাডি ইন পিঙ্ক’-এ বেনেডিক্ট কাম্বারব্যাচ অভিনীত শার্লকের সঙ্গে টক্কর নিতে চেয়েছিল প্রফেসর জেমস মরিয়র্টির যে এজেন্ট। সেও ওই অদৃশ্য মানুষ। কিন্তু সাক্ষাতে এলে ঠাহর হয় তার ঠান্ডা দৃষ্টি, চাপা স্বর। জানা যায়, মৃত্যুর ঠিকানা লেখা আছে তার পকেটের বিষবটিকায়। এই ট্যাক্সি ড্রাইভারকে গুলিবিদ্ধ করতে সফল হয় ওয়াটসন, কিন্তু অজিতের কাহিনিতে ফের মানুষের ভিড়ে হারিয়ে যায় ড্রাইভার ভুবন। অ্যান্টাগনিস্ট নয় বটে, কিন্তু কালিদাসও ঠিক এমনই। অসাধারণ ভাবে সাধারণ। ব্যোমকেশের এই রহস্যোপাখ্যানের শিরোনামটিও তাই লক্ষণীয়— ‘কহেন কবি কালিদাস’।
লোকশ্রুতি আর সংস্কৃত সাহিত্য অমর করে রেখেছে কবি কালিদাসকে। গোয়েন্দা হিসেবে সেই চরিত্রকেই বেছে নিয়েছিলেন সুকুমার সেন। ‘কালিদাস তাঁর কালে’, ‘যিনি সকল কাজের কাজি’ কিংবা ‘সত্য মিথ্যা কে করেছে ভাগ’— এমন একাধিক গল্পগ্রন্থে বুনেছিলেন ডিটেকটিভ কালিদাসকে। চলিত ভাষায় লেখা গল্পগুলির সময়কাল খ্রিস্টীয় প্রথম দুই শতক। সেখানে চালু ইংরাজি বুলি আর ভারী তৎসম শব্দ স্বচ্ছন্দে বসেছে পাশাপাশি। কালিদাসের ‘ইনভেস্টিগেশন রিপোর্ট’ অনায়াসে লেখা হয়েছে সংস্কৃত কূটলিপি আর শ্লোকের আকারে। রচনার এই ব্যতিক্রমী ঢঙে এক হয়ে গিয়েছে সুকুমারের পাণ্ডিত্য ও রসবোধ। এক হয়েছে সত্য ও মিথ্যা। কল্পকথা ও ইতিহাসও। বাংলা বাজারে ‘হটকেক’ না হয়েও কালিদাসের কাহিনিগুলি হয়ে উঠেছে বাংলা সাহিত্যে ‘হটকে’!
এই কালিদাস দুনিয়া কাঁপানো কোনও রহস্যের সমাধান করে না। আবার রাজা বিক্রমাদিত্যের রাজধানী উজ্জয়িনীতেই যে কেবল তার কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ থাকে, এমনও নয়। বস্তুত সে তার আশপাশে তৈরি হওয়া নানা ছোট-বড় সমস্যা থেকে মুক্তির হদিশ বাতলে দেয়। রানির মণিকুণ্ডলের একটি চুনি হারিয়ে গেলে যেমন খুঁজে দিতে পারে, তেমনই পাড়ার বালকটি নিরুদ্দেশ হলেও উদ্ধারকর্তা হয় সে। এমনকি তার নিজের কবিখ্যাতি নিয়েও একবার যখন উজ্জয়িনীর কবি-পণ্ডিত মহলে সন্দেহ দানা বেধে ওঠে— গুজব রটতে থাকে, ‘কবয়ঃ কালিদাসাদ্যা বররুচির্মহাকবিঃ’, অর্থাৎ কি না, কালিদাস প্রভৃতি হল বাজে কবি, আর বররুচি হলেন মহাকবি— তখন নিজেই সেই অপবাদের জাল কেটে বেরিয়ে আসতে সমর্থ হয় কালিদাস।
কালিদাসের রহস্যগুলি যেমন বাস্তবানুগ, সমাধানের প্রক্রিয়াও তেমনই। তার কর্মপদ্ধতি তথাকথিক গোয়েন্দা-সুলভ নাটকীয়তায় ভরা নয়। কালিদাস স্বভাবগত ভাবেই শান্ত। বুদ্ধি আর বিবেচনাই তার সম্বল। মনে রাখতে হবে, দু’হাজার বছর আগের এক পৃথিবীর মানুষ সে। তার তদন্ত চলাকালীন নেপথ্যে কোনও উচ্চকিত বিটবহুল থ্রিলারপ্রতিম ট্র্যাক বেজে চলে না।
গোয়েন্দা কালিদাসের স্রষ্টা সুকুমার সেনই ‘কবি’ শব্দের সবচেয়ে পুরনো অর্থ বাতলেছিলেন— ‘অসীম জ্ঞানী পরম বিচক্ষণ অদ্ভুতকর্মা’। বাল্মীকি, ব্যাসের ছেড়ে যাওয়া কালি ও কলম সম্পদ হয়েছিল কবিশ্রেষ্ঠ কালিদাসের। তিনি ছিলেন একাধারে দক্ষ কবিতা-রচয়িতা, আর এক দিকে পরম জ্ঞানী। দুই সহস্রাব্দ পেরিয়ে গত শতকের সত্তর-আশির দশকে এসে লিখনশক্তি ও জ্ঞান-বুদ্ধির এই যুগলবন্দির উত্তরণ ঘটেছে রহস্য-উদ্ঘাটন দক্ষতায়। জন্ম পেয়েছে এক ম্যাজিক-রিয়াল চরিত্র।
‘হারা ধন’ গল্পে মন্ত্রী শারদানন্দকে দেখি কালিদাসকে সঙ্গে নিয়ে পালকি চেপে একটি বিয়েবাড়িতে পৌঁছতে। অনুষ্ঠানে আচমকা মন্ত্রীমশাই এসে পড়ায় বিস্মিত হয়ে বাড়ির কর্তা, বরকর্তা মুক্তকচ্ছ হয়ে ছুটে আসেন। আপ্যায়ন করে নিয়ে গিয়ে বসান। গৃহকর্তার সঙ্গে তার পরের কথোপকথন এই রকম—
‘‘ ‘আমার দ্বারে মহামন্ত্রী, এ কী সৌভাগ্য।’ কালিদাসকে দেখিয়ে বললেন, ‘ইনি কে মহাপুরুষ?’
‘ইনি কালিদাস।’
‘অ্যাঁ, কালিদাস— ইনিই?’
কালিদাস হেসে বললেন, ‘কল্পনার সঙ্গে মিলল না বুঝি?’ ’’
আমরাও গোয়েন্দা বলতে যা বুঝি, সেই কল্পনার সঙ্গে মিলতে চায় না কালিদাস। সেখানেই তার স্বাতন্ত্র্য। ব্যোমকেশ বক্সী শুধু নয়, যে কোনও বাঙালি গোয়েন্দার চেয়েই ভাবে ও ভারে বিস্তর আলাদা হয়ে পড়ে সে। এই বিশিষ্টতাই কি তার শ্রেষ্ঠত্বের প্রধানতম প্রমাণ নয়?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy