Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Byomkesh Special Page

Byomkesh Bakshi: জটায়ু আর তোপসেকে নিয়ে ফেলুদার যা জনপ্রিয়তা, তার কাছে হার মানতেই হয়েছে ব্যোমকেশকে

ব্যোমকেশ যতটা বাঙালি, তার চেয়েও অনেক বেশি কাছের মনে হয় ফেলুদাকে— এটাই ফেলুদার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

ব্যোমকেশ যতটা বাঙালি, তার চেয়েও অনেক বেশি কাছের মনে হয় ফেলুদাকে— এটাই ফেলুদার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

ব্যোমকেশ যতটা বাঙালি, তার চেয়েও অনেক বেশি কাছের মনে হয় ফেলুদাকে— এটাই ফেলুদার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মূল ছবি: সত্যজিৎ রায়, গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

দেবাশিস মুখোপাধ্যায়
দেবাশিস মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৫:৫৮
Share: Save:

উচ্চতায় ৬ ফুট ৩ ইঞ্চি, নাতিস্থূল চেহারা, মৃদঙ্গ মুখ, হনু আর চোয়াল উঁচু, ধারালো নাক, বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। গায়ের রঙ ফর্সা। এক কথায় বলা যেতে পারে সুশ্রী এবং সুগঠিত। পোশাক ধুতি-পাঞ্জাবি, শীতে চাদর।

অন্য জন উচ্চতায় ৬ ফুট ২ ইঞ্চি, ছাতি ৪২ ইঞ্চি। সুদর্শন, সুগঠিত। গায়ের রঙ লেখায় নেই তবে ফর্সা বলেই মনে হয়। প্রখর দৃষ্টি। পোশাক ট্রাউজার্স, শার্ট। বাড়িতে পাজামা-পাঞ্জাবি। কখনও আধুনিক বাঙালি যুবকদের মতো ট্রাউজার্স-পাঞ্জাবি। অবরে সবরে ধুতি-পাঞ্জাবি।

দু’জনেই পেশায় গোয়েন্দা অর্থাৎ ডিটেকটিভ। প্রথম জন নিজের কাজকে বলে সত্যান্বেষণ। সে ডিটেকটিভ বা গোয়েন্দা শব্দ দু’টি পছন্দ করে না। দ্বিতীয় জন সরাসরি গুরু মানে শার্লক হোমসকে। প্রথম জন মুখে না বললেও শার্লক হোমসের কাজের পদ্ধতির সঙ্গে তার কাজের মিল পাওয়া যায়।

বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে প্রথম জন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যোমকেশ বক্সী। দ্বিতীয় জন সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা ওরফে প্রদোষ চন্দ্র মিত্র।

ব্যোমকেশের বিষয়ে শরদিন্দু নিজেই বলেছিলেন, ‘‘মানুষের সহজ সাধারণ জীবনে কতগুলি সমস্যা অতর্কিতে দেখা দেয়- ব্যোমকেশ তারই সমাধান করে। কখনও কখনও সামাজিক সমস্যাও এর মধ্যে দেখাবার চেষ্টা করেছি।’’

ব্যোমকেশের পারিবারিক জীবন বলতে গিয়ে জানিয়েছিলেন, বাবা ছিল স্কুল শিক্ষক। স্কুলে অঙ্ক শেখাত, বাড়িতে সাংখ্য পড়াত। মা বৈষ্ণব ব্রাহ্মণ কন্যা। বাবা-মা দু’জনেরই মৃত্যু যক্ষ্মা রোগে। ফলে অন্য রকম ব্যক্তিগত রুচিহীন কাজের সঙ্গে ব্যোমকেশ জড়িত থাকতে পারেই না। ব্যোমকেশের কাহিনিগুলিকে প্রথম থেকে যদি একটু দেখা যায়, দেখতে পাই তার প্রথম গল্পটি, ‘পথের কাঁটা’ প্রকাশ পাচ্ছে ১৯৩২-এ। পাঁচ মাস পর দ্বিতীয় গল্প ‘সীমন্ত হীরা’। এই দু’টি গল্প লেখার পরই শরদিন্দুর মাথায় ব্যোমকেশকে নিয়ে একটি সিরিজ লেখার পরিকল্পনা আসে। প্রকাশিত হয় তৃতীয় গল্প ‘সত্যান্বেষী’। এই গল্পটিতেই উনি ব্যোমকেশ চরিত্রটি ‘এস্টাব্লিশ’ করেন। পাঠকের সুবিধের জন্যে তিনি ‘সত্যান্বেষী’ গল্পটিকেই ব্যোমকেশের প্রথম গল্প হিসাবে ধরতে বলেন। ব্যোমকেশ চরিত্রটিকে এমন ভাবে তৈরি করেন, তাকে ভারতীয়, বিশেষ করে খাঁটি বাঙালি মধ্যবিত্তের অনেক কাছের বলে মনে হয়। সেই সময় যে ধরনের গোয়েন্দা বাংলা সাহিত্যে দেখা যেত, তার থেকে অনেক সাধারণ এই ব্যোমকেশ। মুখে পাইপ নেই, এমনকি অন্য দেশি-বিদেশি গোয়েন্দাদের মতো রিভলবারও চালাতে পারে না। ব্যোমকেশের কাহিনিগুলিকে কেবলমাত্র গোয়েন্দা কাহিনি নয়, সামাজিক উপন্যাস হিসাবে স্বচ্ছন্দে দেখা যেতে পারে।

সত্যজিৎ রায়ও প্রথম যখন ফেলুদাকে নিয়ে কাহিনি লিখতে শুরু করেন, তখন ব্যোমকেশ প্রায় অবসর নেওয়ার মুখে।

সত্যজিৎ রায়ও প্রথম যখন ফেলুদাকে নিয়ে কাহিনি লিখতে শুরু করেন, তখন ব্যোমকেশ প্রায় অবসর নেওয়ার মুখে। ফাইল চিত্র

অন্য দিকে সত্যজিৎ রায়ও প্রথম যখন ফেলুদাকে নিয়ে কাহিনি লিখতে শুরু করেন, তখন ব্যোমকেশ প্রায় অবসর নেওয়ার মুখে। ১৯৬৫ সালের ডিসেম্বর সংখ্যার ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশ পায় ‘ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি’। ধারাবাহিক। তিন সংখ্যায় শেষ। একটু হাল্কা টানে লেখা। ফেলুদার গোয়েন্দাগিরিটা তখন শখের। সত্যজিৎ তখনও ফেলুদার ভাল নামটা ঠিক করে উঠতে পারেননি। শরদিন্দুর মতো প্রথম দিকে সত্যজিৎও ফেলুদা নিয়ে সিরিজ করার কথা ভাবেননি। তাই তৃতীয় গল্পে প্রদোষচন্দ্রের পদবী ‘দত্ত’ লিখেছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় উপন্যাস ‘বাদশাহী আংটি’ সন্দেশে এক বছর ধরে ধারাবাহিক প্রকাশের সময় থেকেই প্রচণ্ড জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তবে একটি ‘ইন্টারেস্টিং’ বিষয়, এই ধারাবাহিক লেখার সময় তিনি গোয়েন্দা কাহিনি, বাঙালি গোয়েন্দা-চরিত্রের সঙ্গে এমনই একাত্ম হয়ে পড়েন, গোয়েন্দা কাহিনিকে এতটাই ভালবেসে ফেলেন যে, ঠিক এই সময়েই তিনি তাঁর পরবর্তী ফিল্মটির কাহিনি নির্বাচন করেন তাঁর প্রিয় আর এক বাঙালি গোয়েন্দা চরিত্রকে নিয়ে। তার নাম ব্যোমকেশ।

ফেলুদার পিতাও স্কুলের অঙ্ক আর সংস্কৃত শিক্ষক। সে যেমন ডানপিটে, তেমনই দুঃসাহসী। সুস্বাস্থ্যের অধিকারী এবং নামকরা খেলোয়াড় ছিল। জ্যাঠা নামকরা ঠুংরি গায়ক। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রুচি এবং সংস্কৃতি বংশপরম্পরায় ফেলুদার প্রাপ্তি হয়েছে। এমন পারিবারিক পরিচিতি অর্থাৎ মধ্যবিত্ত সাংস্কৃতিক রুচিসম্পন্ন বাঙালি পরিবার খুঁজলে অনেক পাওয়া যাবে। কিন্তু তাদের মধ্যে থেকেই নিজের কর্মক্ষমতায় ফেলুদা আলাদা হয়ে ওঠে। ফলে ফেলু মধ্যবিত্ত মানসিকতার কারণেই কিশোর-কিশোরীদের কাছে নিজের দাদার মতোই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

এই সহজ, সরল, স্বাভাবিক একজন চেনা যুবকের মতো করেই চরিত্রটি তৈরি করেছিলেন সত্যজিৎ। ব্যোমকেশ যতটা বাঙালি, তার চেয়েও অনেক বেশি কাছের মনে হয় ফেলুদাকে— এটাই ফেলুদার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সাধারণের সঙ্গে সামান্য একটু অসাধারণত্ব মিশিয়েই চরিত্রটির সৃষ্টি।

প্রথমে ‘সন্দেশ’, পরে ‘দেশ’ শারদ সংখ্যায় ফেলুদা উপন্যস প্রকাশিত হয়। বড়দের পত্রিকা হলেও দেশ-এ প্রকাশিত হওয়ার সময় সত্যজিৎ ফেলুদা চরিত্রটিকে একটুও হেরফের হতে দেননি। বড়দের কাছেও চরিত্রটি জনপ্রিয় হওয়ার শুরু এই সময় থেকেই। ফেলুদা জনপ্রিয় হওয়ার মূল কারণ ছিল কাহিনিগুলি কাল্পনিক এবং মৌলিক। মেদহীন কাহিনিগুলি বিদেশি কাহিনি অবলম্বনে লেখা নয় এবং সবচেয়ে বড় কথা বইয়ের মধ্যে মেলে ধরা ইতিহাস, ভূগোল বা বিজ্ঞান যাই থাকুক না কেন, তাতে এক কণাও ভুল নেই। ছোটদের কৌতুহলী মনের খিদে মেটাবার জন্য অপরিহার্য। এবং গল্পের কথক অর্থাৎ গল্পটা বলছে কে? না তার খুড়তুতো ভাই, তোপসে। দেখা যায়, পাঠক অর্থাৎ কিশোর পাঠক যতটা ফেলুদা হিসেবে নিজেকে মেলাতে চায়, তার চেয়ে অনেক বেশি নিজেকে মেলাতে পারছে তোপসের সঙ্গে। সেখানে ছোট হওয়ার কোনও কারণ নেই, কারণ তোপসে না থাকলে গল্পটাই যে লেখা হত না।

ফেলুদার বিপক্ষে যাদের দাঁড় করিয়েছিলেন, তারা প্রত্যেকেই ছিল তুখোড় বুদ্ধিমান এবং নিজেদের ক্ষেত্রে শীর্ষে থাকার অধিকারী চরিত্র।

ফেলুদার বিপক্ষে যাদের দাঁড় করিয়েছিলেন, তারা প্রত্যেকেই ছিল তুখোড় বুদ্ধিমান এবং নিজেদের ক্ষেত্রে শীর্ষে থাকার অধিকারী চরিত্র। নিজস্ব চিত্র

মাঝে মাঝে মনে হয় প্লট বা কাহিনির গড়নে না থাকলেও, ফেলুদা সৃষ্টির সময় সত্যজিতের অবচেতনে ব্যোমকেশ ছিল। ব্যোমকেশের যেমন সিগারেট আর চায়ের নেশা, সব বিষয়ে কৌতূহলী এবং চমৎকার সাধারণ জ্ঞানসম্পন্ন, ফেলুদাও তাই। ব্যোমকেশ এবং ফেলুদা দু’জনেই অন্য গোয়েন্দাদের মতো নিজেকে ঘিরে রোমাঞ্চ সৃষ্টি করা পছন্দ করত না। ধীর, স্থির, সংযত বাক, সহৃদয়, অন্তর্মুখী, নির্লোভ, কৌতুক ও রহস্যপ্রিয় এবং দু’জনেই দেশপ্রেমী।

আর একটি প্রাসঙ্গিক বিষয়, সত্যজিৎ ফেলুদাকে বড় করার জন্য একটি কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। সেটা হল, ফেলুদার বিপক্ষে যাদের দাঁড় করিয়েছিলেন, তারা প্রত্যেকেই ছিল তুখোড় বুদ্ধিমান এবং নিজেদের ক্ষেত্রে শীর্ষে থাকার অধিকারী চরিত্র। ফেলুদার প্রত্যেকটি কাহিনির ভিলেনদের বিশেষত্ব যদি লক্ষ্য করা যায়, তা হলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এদের বুদ্ধিতে হারাতে গিয়ে ফেলুদা আপনা থেকেই বড় হয়ে উঠেছে। বিশ্বের অন্য যে কোনও গোয়েন্দা কাহিনির সঙ্গে সত্যজিতের ফেলুদার তফাৎ এখানেই।

ব্যোমকেশের কাহিনিগুলি উপন্যাস হিসাবে যথেষ্ট সাহিত্যগুণসম্পন্ন ঠিকই তবে সেখানে গোয়েন্দার কাজকর্মের পাশাপাশি লেখক গুরুত্ব দিতেন কাহিনির পটভূমিকে। অপরাধের সূত্র ধরে সমাজের এবং সময়ের বাঁকগুলিকে চিহ্নিত করতে চাইতেন। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা অনেক বারই এসেছে ব্যোমকেশের কাহিনিতে। তিনি অপরাধটার পিছনে সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার কারণ খুঁজে পেতেন। ফলে সেই কথাটাই বার বার উঠে আসে। কেবলমাত্র গোয়েন্দা কাহিনি হিসাবে শরদিন্দুর ব্যোমকেশ-কাহিনিগুলি তুলে ধরলে আমরা ভুল করব। অন্যায় করব।

ফেলুদার ভিলেনের প্রসঙ্গে যদি ব্যোমকেশের ভিলেনদের দেখা যায়, লক্ষ করা যেতে পারে, তারা একদমই অন্য রকম। মনে হয় যেন বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মানুষ। সমাজে বাস করলেও তারা নিজেরাই অন্য সম্পর্ক থেকে দূরে থাকে। তারা যেন একক অস্তিত্বের মানুষ। এদের অপরাধের পিছনে বিচ্ছিন্নতা বেশ বড় ভূমিকা নিয়েছে। একই সঙ্গে থাকার কারণে এক ধরণের বিচ্ছিন্নতাবোধ কাজ করে এদের মধ্যে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, পারিবারিক স্থিতি এবং সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার তাড়নাতেই এরা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে।

শার্লক হোমসের কাহিনি অবলম্বনে লিখতে শুরু করলেও তাঁর ব্যোমকেশ-কাহিনি সম্পূর্ণ মৌলিক। এবং এই কাহিনিগুলির বৈশিষ্ট্য ছিল লিখনভঙ্গি এবং বিষয় অবতারণায়। শেষ দিককার কাহিনিতে তিনি ব্যোমেকেশের জীবনের কথাও বলার চেষ্টা করেছেন। অর্থাৎ কাহিনিগুলিতে গোয়েন্দাও যেন একটা বিশেষ চরিত্র। তুলনায় সত্যজিৎ কেবল মাত্র গোয়েন্দা কাহিনিটিই সহজ সুন্দর করে বলার চেষ্টা করেছেন এবং পেরেছেন। সব মিলিয়ে বলা যায়, কাহিনি হিসাবে, সাহিত্য হিসেবে শরদিন্দুর ব্যোমকেশ কাহিনিগুলি যেমন শ্রেষ্ঠ, তার থেকে সত্যজিতের ফেলুদা গোয়েন্দা হিসাবে তার কথক তোপসে এবং বন্ধু জটায়ুকে নিয়েই অনেক বেশি জনপ্রিয়।

(লেখক সত্যজিৎ গবেষক। মতামত ব্যক্তিগত)

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy