Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Byomkesh Special Page

Byomkesh Bakshi: চরিত্রের উত্তরণেই ব্যোমকেশকে ছাড়িয়ে বাংলা সাহিত্যের সেরা গোয়েন্দা বালক যদুনাথ

বাংলা সাহিত্যের আর কোনও কেষ্টবিষ্টু ডিটেকটিভের এই চারিত্রিক পটভূমি আছে কি? এই অর্থে এই বালক গোয়েন্দা কি অদ্বিতীয় নয়?

যদুনাথ ওই পথের পথিক, নাকাল হলেও সে পথ হারায় না।

যদুনাথ ওই পথের পথিক, নাকাল হলেও সে পথ হারায় না। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

বরুণ চট্টোপাধ্যায়
বরুণ চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৬:৫২
Share: Save:

যদুনাথ ১৫ বছরের। যদুনাথ ভয় পায়। আড়ি পেতে হাড়হিম ষড়যন্ত্র শুনে ঠোঁটের কোণে পাইপ, সিগার, চারমিনার আর বাঁকা হাসি নিয়ে পায়চারি করে না, পালাতে চায়, পথ ভুলে গেরোয় পড়ে। একটা মাত্র তদন্তের সুযোগ পেয়েছে সে, তাও আগ বাড়িয়ে, রীতিমতো মাথা গলিয়ে।

বিপুল সম্পত্তির উত্তরাধিকারের এক অংশীদার প্রমোদা জীবিত না মৃত? এই প্রমোদাই কি সেই প্রমোদা যাকে পাগল সাজিয়ে গারদে পাঠানো হয়েছে? তা হলে কাকে হত্যা করে ওই শূন্য শবাধারে সমাধি দেওয়ার মতলব আঁটছে! তখনও যদুনাথ জানে না ষড়যন্ত্রীত্রয়ীর মধ্যে যুবতী, যার নাম লিলি, সে বাঙালি খ্রিস্টান নবকৃষ্ণ দত্তের প্রথম পক্ষের কন্যা, বয়স ২২। প্রমোদা নবকৃষ্ণের দ্বিতীয় পক্ষের, বর্তমানে ১৭। অর্থাৎ টাটকা হিসাবে লিলি সম্পত্তির অধিকারিণী হতে পারে, কিন্তু প্রমোদাকে অপেক্ষা করতে হবে আরও মাসকয়েক। লিলির সঙ্গে যে ছোকরা ফিরিঙ্গি ঈষৎ রসালাপ করছে, তার নাম মিস্টার টমারি। টমারির চেয়ে বয়সে খানিক বড় আর এক সাহেব জন।

যদুনাথ যখন লুকিয়ে এ বাড়িতে ঢুকছিল তখন তো এই সাহেবকেই ছায়ামূর্তির মতো ঢুকতে দেখেছে সে! বাকি তিন জনের মধ্যে দু’জনের পরিচয় ইতিমধ্যেই জেনে গিয়েছে যদুনাথ। এরাই তো সেই নিষ্পন্দ যুবতীকে টেনে তুলছিল ঘোড়ার গাড়িতে, তাদের কথায় খটকা লেগেই তো তার গাড়ির পিছু নিয়ে ভবানীপুর থেকে জানবাজারের এই বাড়ির মধ্যে সেঁধিয়ে গিয়ে ঘাপটি মেরে থাকা! দু’জনের একজন আইনজীবী, নাম ঘনশ্যাম রায়। অপরজন ভজহরি দত্ত, চিকিৎসক।

ভবানীপুরের অট্টালিকা থেকে এরা ওই মূর্ছিত মেয়েটিকে এনে তুলেছিল হেলেনা বিবি নামে আর এক তালেবরের কাছে। যদু বুঝে নিয়েছে হেলেনাও চক্রী, এই ষড়যন্ত্রে এখনও পর্যন্ত বিবিটির ভূমিকা মধ্যস্থতাকারিণীর। জানবাজারের বাড়িতে ঘনশ্যাম, ভজহরি ও হেলেনার পরিচয় এত খোলসা করে যদু জানল কী করে! না জেনে উপায় কী! তার সহচর সাধু সাবধান করাতেও রহস্যের প্রতি তার কিশোরমনের তীব্র আসক্তি! সেই টানেই তো সে গোপনে ঢুকেছিল জানবাজারের ওই বাড়িতে, নাটকের নান্দীমুখে নটনটীদের নামধামের একটা মোটা ধারণা পেলেও ছেলেমানুষি ভুল করে ফেলেছিল। হেলেনাবিবির খর নজরে পাকড়াও হয়েছিল সে। আবার পাকড়াও হয়ে ভয়ে আত্মারাম খাঁচাছাড়া হলেও নিজের উপস্থিত বুদ্ধিতে সে’দফা সামলেও নিয়েছিল। তবে ‘ভবি ভোলবার নয়’, যদুনাথ এমন এক ‘ন্যাড়া’ যে বেল পড়ে মাথা ফাটিয়েও বার বার যায় বেলতলাতে। কিন্তু প্রশ্ন ক’বার যায়। উত্তর আছে বঙ্কিমের নবকুমারের মধ্যে— ‘পরের কাষ্ঠাহরণ করা যাহার স্বভাব, সে পুনর্ব্বার পরের কাষ্ঠাহরণে যাইবে।’ যদুনাথ ওই পথের পথিক, নাকাল হলেও সে পথ হারায় না।

যদুনাথ যখন লুকিয়ে এ বাড়িতে ঢুকছিল তখন তো এই সাহেবকেই ছায়ামূর্তির মতো ঢুকতে দেখেছে সে!

যদুনাথ যখন লুকিয়ে এ বাড়িতে ঢুকছিল তখন তো এই সাহেবকেই ছায়ামূর্তির মতো ঢুকতে দেখেছে সে! ছবি: লেখক

উপন্যাসের চরিত্রে সবচেয়ে বড় গলদ স্থিতি। স্থানের ঠিক নয়, ব্যক্তিত্বের স্থিতি চরিত্রকে শুধু মন্থর করে না, তাকে অস্পষ্ট করতে থাকে। ক্রিয়াশীলতা কমলে চরিত্রের দীপ্তি ম্লান থেকে ম্লানতর হয়। গপ্পো এগোবার ছন্দে তালে চরিত্র না এগোলে, ক্রমশ পরিবর্তিত না হতে থাকলে, সে যেন মঞ্চের সেই নটের মতো যার মুখে সংলাপ নেই, শরীরের নড়াচড়া নেই, একেবারে জগদ্দল পাথর, স্থানু। প্রায় সব ধাঁচার গল্প-উপন্যাসেই চরিত্র সম্পর্কে, বিশেষত নায়ক বা প্রধান চরিত্র বিষয়ে, এই পর্যবেক্ষণ খেটে যায়। গোয়েন্দা কাহিনিতে তো বটেই। গোয়েন্দা চরিত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ধারাল বুদ্ধি। মগজাস্ত্র থাকলেও ফেলুদাকে এত লাফ ঝাঁপ করতে দেখলে একটা খটকা লাগে। গোয়েন্দার সক্রিয়তা ততটা শারীরিক ও বাহ্যিক নয় যতটা সক্রিয় তার অনুসন্ধানী মেধা ও বিশ্লেষণে তুখোর মনন। একটা মোক্ষম উদাহরণ আছে। শার্লক হোমসের বড় দাদা মাইক্রফট। তিনি প্রায় পেশাদার অলস মানুষ, কিন্তু সমস্যা বা রহস্য হাজির হলেই চালু হয়ে যায় তার চিন্তার ইঞ্জিন। মহামহিম শার্লক মগজ ও শরীর উভয়েই তুমুল দক্ষ, তবু তিনি বার বার দ্বারস্থ হন ওই নট নড়নচড়ন দাদাটির। চরিত্র যদি গোয়েন্দা হয় তার হিল্লি-দিল্লি, সাগর-পাহাড় চক্কর দেওয়া চমকদার হতে পারে, কিন্তু গোয়েন্দা মহোদয়ের মান বাড়ে কোনও জটিল প্যাঁচালো রহস্যের দোরস্ত সমাধান করলে। আসলে ওই রহস্য সমাধানের অন্তর্ভেদী শক্তি শুধু রহস্যের সমাধান করে না, গোয়েন্দার চরিত্রকেও বদলে দেয়। তার অন্তর্জগতে আসে নতুন আলো, নতুন বিকিরণ। এক একটি সমাধান তাকে নতুন চরিত্র করে তোলে। তিনি নিয়ত বদলান, গড়ে ওঠেন।

এই সূত্রে এক বার গোয়েন্দাকাহিনির পরিসর থেকে বেরিয়ে একটু অন্য জাতের দুই কিসিমের উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য ছুঁয়ে যেতে হবে। বাঙালি পাঠকের কাছে এই গোত্রটি একেবারেই অপরিচিত নয়। ‘পথের পাঁচালী’ আর ‘অপরাজিত’ কে না পড়েছে? দু’টি উপন্যাস জুড়েই অপুর হয়ে ওঠার আখ্যান। নিশ্চিন্দিপুর-কাশী-কলকাতায় স্থানান্তর, নানান জীবিকা, নানা গোত্রের মানুষের সংসর্গ, এগুলোই কি অপু চরিত্রটিকে তৈরি করছে? ওসব উপাখ্যানের বাইরের নকশা, ইমারতি উপাদান। আসলে ধীরে ধীরে বদলে যাওয়া এক অপু থেকে নানা অপু হয়ে উঠতে থাকা, এটাই অপুর আসল বৃত্তান্ত। শুধু যদি নিশ্চিন্দিপুর ছেড়ে যাওয়া আর সর্বজয়ার মৃত্যুর পর আর একবার নিশ্চিন্দিপুর ফিরে আসা অপুকে দেখা যায়— কতটা বদলে গিয়েছে অপু! জার্মান তাত্ত্বিকেরা নাম দিতে ওস্তাদ। কোনও একটি মানুষের এমন নানা রূপান্তরের মধ্যে দিয়ে হয়ে ওঠার উপন্যাসের দু’টি নাম দিয়েছেন ‘বিল্ডুংসরোমা’ ও ‘কান্টসলেরোমা’। নাম দু’টি খটোমটো হলেও ব্যাপারটা অতি সরল। প্রথমটি যে কোনও একটি মানুষের হয়ে ওঠার বৃত্তান্ত, দ্বিতীয়টি কোনও একজনের নানা রূপান্তরের পথে শিল্পী হয়ে ওঠার আলেখ্য। পথের পাঁচালী-অপরাজিত-র মধ্যে এই দুই রকমফেরই যেন মিলেমিশে আছে। গোয়েন্দাকাহিনির মূল চরিত্র মূলত দু’রকমের— গোয়েন্দা এবং অপরাধী। এই বিপুল জনপ্রিয় ধারাটিকে দুনিয়ার প্রায় কোনও তাত্ত্বিকই এতকাল তেমন মান্যিগন্যি করেননি। তাই হয়তো গোয়েন্দা চরিত্রের কপালে স্বতন্ত্র নাম জোটেনি। কোনও চরিত্রের অপরাধী হয়ে ওঠার কাহিনি যদিও বা দৈবাৎ মেলে, অতি সমাদৃত বাংলা গোয়েন্দা কাহিনিগুলির ক’টির মধ্যে দেখা যায় গোয়েন্দা চরিত্রটির এই ক্রমবিকাশ? সত্যান্বেষী গল্পের ব্যোমকেশ কতটা বদলেছে পরের উপন্যাসগুলিতে? প্রদোষ মিত্রের বয়স বাড়ছে, তা অতি অস্পষ্টভাবে যদিও বা টের পাওয়া যায়, তার চারিত্রিক রূপান্তর তেমন চোখে পড়ার মতো কিছু আছে কী? একটা কারণ হয়তো ব্যোমকেশ বা ফেলুদার শৈশব-কৈশোরের কথা বলার তেমন অবকাশ শরদিন্দু বা সত্যজিৎ পাননি, বা পেতে চাননি। দু’জনকেই পেশ করা হয়েছে বৃন্তহীন পুষ্পসম আপনাতে আপনি বিকশিত ব্যক্তিত্ব হিসেবে। দু’জনকেই আমরা পরিণত যৌবনে দেখি। তাদের বয়স বাড়ার কিছু হদিশও যে পাই না তেমন নয়, কিন্তু দু’জনেই তো শুরু থেকে শেষ তক সব উপাখ্যানেই প্রায় ওই একই রকম প্রগাঢ় বুদ্ধিমান, প্রচণ্ড ক্ষমতাসম্পন্ন, প্রবল ন্যায়নিষ্ঠ ও মওকা পেলেই মহৎ-মানবিক হয়ে থেকে যান। ক্ষেত্রমোহন ঘোষের বালক গোয়েন্দা যদুনাথের মধ্যে এই ঘাটতিটিই মাত্র একটি গল্পের পরিসরে আশ্চর্য কুশলতায় চারিয়ে দেওয়া হয়েছে। একটি অপহরণের মতো মনে হওয়া রহস্যময় কাণ্ড পাকেচক্রে দেখে ফেলে তার কুশীলবদের পিছু নিতে নিতে বদলে গিয়েছে যদুনাথ। তার বয়সটাই রোঁয়া ওঠার বয়স, প্রেম ও প্রতারণার লীলা গোড়ায় তাকে বিমূঢ় করে দিয়েছে। কিন্তু আখ্যানের পরিণতির সঙ্গে সঙ্গে সে ক্রমশ যেন পৌঁছে গিয়েছে বালকের নাদানি ছেড়ে কৈশোরের থরথর রোমাঞ্চের দিকে।

ওই আখ্যান বালকটিকে শুধু রহস্য উন্মোচনের কেরামতিতে কাবিল করেনি, প্রাপ্তবয়স্কের দুনিয়ার জটিল অনুভব অভিজ্ঞতার ঘূর্ণিপাকে সরল থেকে লায়েক করে তুলেছে।

ওই আখ্যান বালকটিকে শুধু রহস্য উন্মোচনের কেরামতিতে কাবিল করেনি, প্রাপ্তবয়স্কের দুনিয়ার জটিল অনুভব অভিজ্ঞতার ঘূর্ণিপাকে সরল থেকে লায়েক করে তুলেছে। ছবি: লেখক

এ বার যদি ক্ষেত্রমোহনের আখ্যান গড়ার ছাঁচের ধরণটা দেখা যায়, তা হলে যদুর চরিত্রের এই ব্যাপার খানিকটা বোঝা যাবে। ওই আখ্যান বালকটিকে শুধু রহস্য উন্মোচনের কেরামতিতে কাবিল করেনি, প্রাপ্তবয়স্কের দুনিয়ার জটিল অনুভব অভিজ্ঞতার ঘূর্ণিপাকে সরল থেকে লায়েক করে তুলেছে। কেমন করে গপ্পো গড়তেন ক্ষেত্রমোহন? সাঁটে জানা যায় তাঁর প্রতাপচাঁদ উপন্যাসের কাহিনিচুম্বক থেকে:

‘মল্লিক বাড়িতে চুরি, রামেশ্বরের রহস্যপূর্ণ আত্মহত্যা, সন্দেহ বশে নবীনের কারাবাস, কুটিলা বিজলীবালার পৈশাচিক ষড়যন্ত্র, নারকীয় প্রেমের উন্মাদকর বিকাশ, প্রতিভাবান্ ডিটেকটিভ প্রতাপচাঁদের বুদ্ধিবলে সকল রহস্যের উদ্ভেদ, রামেশ্বরের গ্রেপ্তার, মেয়ে-গোয়েন্দা বামার বিপদ প্রভৃতি অতি আশ্চর্য্য ঘটনায় পুস্তকখানি পূর্ণ।’

প্রমোদা উপাখ্যানটি প্রতাপচাঁদের পরে রচিত, ১৯১২ সালে প্রকাশিত। নিজের গোয়েন্দা প্রতাপচাঁদকে পেশ করে সমাদর পেয়ে আরও খেলিয়ে গল্প বলেছেন ক্ষেত্রমোহন। রীতিমতো কঠোরভাবে প্রাপ্তবয়স্ক ভাবের প্রমোদা উপন্যাসের মূল কাহিনির একাংশের সংক্ষিপ্তসার লেখার প্রথমেই আছে। সব গোয়েন্দা উপন্যাসেই প্রথমে জট পাকানোর পালা। উত্তরভাগ জট ছাড়ানোর বৃত্তান্ত। সেই পর্বে যদুনাথকে জোর করে ওষুধে অজ্ঞান করে শবাধারে পুরে কবরে পুঁতে দেওয়া হয়ে গিয়েছে। এ বার ত্রাতার ভূমিকায় আসরে যদুর আদর্শ হরিনাথ মজুমদার, পুলিশের দক্ষ গোয়েন্দা।

প্রত্যাশিতভাবেই উপন্যাস শেষ হয় সর্ববিঘ্ন সমাপনে। কল্পিত গোয়েন্দারা রীতিমতো ঝুঁকিলুব্ধ হলেও বাংলা গোয়েন্দা উপন্যাস, প্রায় পনেরো আনাই, নিরাপদ মধ্যপন্থা মেনে চলে। সেখানে সুগোল সমাপ্তিই প্রত্যাশিত। সেই ঐতিহ্য সেকালেও ছিল।

কিন্তু এখানে বিচার্য যদুনাথের গোয়েন্দা হয়ে ওঠা। প্রমোদার গল্প যদুনাথকে শুধু গোয়েন্দা হওয়ার পথে কয়েক ধাপ এগিয়ে দেয় না, প্রাপ্তবয়স্ক করে তোলে। এই হয়ে ওঠার গোপন কথাটি অতি বিরল বাঙালি গোয়েন্দাকাহিনিকারদের রচনায়। অদ্যবধি সিংহভাগ গোয়েন্দা চরিত্র ভুঁইফোড় গোত্রের, বাংলা সাহিত্যে যেন ফুঁড়ে ওঠার মাটিটাও হাপিস। ‘কোথা হইতে কী হইয়া গেল’— শশধর দত্তের দস্যু মোহনের এই ব্র্যান্ড-বাক্যটিকে একটু তুবড়ে বলা যেতে পারে, বাঙালি গোয়েন্দা যে কোথা হইতে কী করিয়া আসিল তা বোঝা দুষ্কর। ঝানু সাহিত্যতাত্ত্বিকেরা একাধিক কারণে আজও গোয়েন্দাকাহিনিকে ‘সিরিয়াস’ বলে গণ্য করেন না। গোয়েন্দা চরিত্রের হয়ে ওঠার অভাব এই কারণগুলির অন্যতম। অথচ গোয়েন্দা চরিত্রের ব্যক্তিত্বের একটা চমৎকার প্রেক্ষাপট যে সুনিপুণ সূক্ষ্মতায় বজায় রাখা অসম্ভব নয়, তা ইউরোপীয় সাহিত্যের প্রথম উল্লেখযোগ্য ডিটেকটিভ অগুঁস্ত দ্যুঁপা তার চমৎকার নজির। এই ডিটেভটিভ কল্পকাহিনির লেখক এডগার অ্যালান পো অসামান্য কবি হওয়ার কারণেই হয়তো দ্যুঁপার সঙ্গে জড়িয়ে দেন এক সংকেতময়তা। ব্যক্তিগত জীবনে সে বিস্মৃতপ্রায় গ্রন্থাগারের আলোআঁধারিতে খুঁজে বেড়ায় এক রহস্যময় গ্রন্থ, যার সন্ধান কখনোই মেলে না, অথচ তার অনুসন্ধান স্থগিত থাকে না। এমন এক গ্রন্থাগারেই তার সঙ্গে মোলাকাত কাহিনি-কথক জি’র। বরং এই কথকের পরিচয় রহস্যাবৃত, তাকে চেনা যায় না। এই অনুসন্ধানের নানান বাঁকে সাজানো থাকে তার জীবনের নানান বৃত্তান্তের ইশারা। সাম্প্রতিক কালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি-ডিটেকটিভ অ্যাডাম ডেলগ্লিস, স্রষ্টা ব্যারনেস পিডি জেমস। প্রসবকালে ডেলগ্লিসের স্ত্রী ও সদ্যোজাতের মৃত্যু তার আগামী প্রেমের নানান সম্ভাবনায় বার বার দিয়ে গিয়েছে বাধা। ব্যারনেস জেমস শুধু তাঁর ডিটেকটিভের মক্কেল ও অপরাধীদের চরিত্র বিশ্লেষণ করেননি, নানান প্রেক্ষিত খনন করেছেন ডিটেকটিভের মনস্তত্ত্বও।

যদুনাথের মধ্যে অন্য সম্ভাবনা। প্রাণসংশয়ের মুহূর্তে সে অনুভব করে:

‘বিস্ময়ে যদুর চক্ষু বিস্ফারিত হইল। সে বালক সত্য, সংসারের ভ্রষ্টপ্রকৃতি নরনারীর চরিত্র বিশ্লেষণের শক্তি তাহার অল্প, তথাপি এই সকল পিশাচপ্রকৃতি লোকের পৈশাচিক ভাবসম্পন্ন, ভাবিতে ভাবিতে তাহার বালহৃদয় ব্যথিত এবং সমগ্র নরনারীর উপর ঘৃণা এবং সন্দেহের একটা আবছায়া প্রতিফলিত হইল।’

কাহিনির শুরুতে এই বালক বুঝতে পারেনি নারী-পুরুষের সম্পর্কের ক্লেদাক্ত রহস্য, অন্তিমেও সে যে সর্বজ্ঞ হয়ে ওঠে তা নয়। কিন্তু তার হৃদয়ে ঘৃণা ও সন্দেহের জন্ম হয়। প্রথম তদন্তের অভিজ্ঞতায় বালক হারিয়ে ফেলে তার বালক চরিত্রকে। বাংলা সাহিত্যের আর কোনও কেষ্টবিষ্টু ডিটেকটিভের এই চারিত্রিক পটভূমি আছে কি? এই অর্থে এই বালক গোয়েন্দা কি অদ্বিতীয় নয়?

(লেখক গবেষক। মতামত ব্যক্তিগত)

আরও পড়ুন:
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy