১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে প্রভাবতী দেবী সরস্বতী ‘কৃষ্ণা’ চরিত্রটি নির্মাণ করেন। গ্রাফিক : শৌভিক দেবনাথ
গোয়েন্দা কাহিনির জগতে মেয়েরা সচরাচর দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। গোয়েন্দা বললে আমাদের মনে শুধু সাহসী, তীক্ষ্ণধী, শারীরিক শক্তি সম্পন্ন মানুষের ছবিই ভেসে ওঠে না, লিঙ্গ পরিচয়ও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে একুশ শতকের পাঠকের মনে পুরুষ গোয়েন্দাদের পাশাপাশি মিতিন মাসি, গার্গীও প্রায় স্থায়ী জায়গা তৈরি করে ফেলেছে। বাংলা সাহিত্যের এই মেয়ে গোয়েন্দা নির্মাণের ভিত তৈরি হয়েছিল বিশ শতকের পাঁচের দশকে, আর তা হয়েছিল এক লেখিকার হাতে।
১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে প্রভাবতী দেবী সরস্বতী ‘কৃষ্ণা’ চরিত্রটি নির্মাণ করেন। ‘গুপ্তহত্যা’ কাহিনিতে দেখা যায় পুলিশ অফিসার সত্যেন্দ্র চৌধুরীর সঙ্গে শত্রুতার কারণে দস্যু ইউ-উইন তার স্ত্রীকে হত্যা করে এবং কন্যা কৃষ্ণাকে হত্যা করার হুমকি দেয়। একমাত্র সন্তানের জীবন বাঁচানোর জন্য সত্যেন্দ্র চৌধুরী স্বেচ্ছাবসর নিয়ে তৎকালীন বার্মা থেকে কলকাতায় চলে আসে। তবে কৃষ্ণার প্রাণ বাঁচাতে পারলেও সে নিজের প্রাণ বাঁচাতে পারে না। ছ’মাসের মধ্যে কিশোরী কৃষ্ণা বাবা এবং মাকে হারায়। কিন্তু এর ফলে কৃষ্ণা ভেঙে পড়ে না, বরং অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার সংকল্প নেয়। ‘হত্যার প্রতিশোধ’ কাহিনি থেকে কৃষ্ণার অপরাধীর পিছনে ধাওয়া করা শুরু হয়। ‘প্রহেলিকা’ এবং ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা সিরিজ’-এর এই দুই কাহিনির জনপ্রিয়তার পর কৃষ্ণা চরিত্রটিকে নিয়ে প্রকাশিত হতে থাকে ‘কৃষ্ণা সিরিজ’।
‘কৃষ্ণা সিরিজ’-এর প্রথম কাহিনিতেই আমরা দেখতে পাই কৃষ্ণা মেয়ে গোয়েন্দা হিসাবে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছে। শুধুমাত্র নারী সমাজে নয়, দেবুর মতো স্কুল পড়ুয়া কিশোরদের চোখেও সে কল্পকাহিনির নায়িকা বা বলা ভাল নায়ক হয়ে উঠেছে। এই মুগ্ধতার পিছনে সবচেয়ে বড় কারণ হল, কৃষ্ণা আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতো নয়, সে সব দিক থেকেই অনন্যা। কাহিনিগুলি থেকে জানা যায় কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে সে প্রথম বিভাগে আইএ পাশ করেছে, তার পর বিএ পরীক্ষার জন্য সে প্রস্তুতি নিচ্ছে। ‘গ্রহের ফের’ কাহিনিতে কৃষ্ণার সম্পর্কে লেখিকা জানান,‘এই বয়সে কৃষ্ণা মাতৃভাষা ছাড়া আরও পাঁচ-সাতটি ভাষা শিখিয়াছে। কেবল শিখিয়াছে বলিলেই হইবে না, যে কোনও ভাষায় সে অনর্গল কথা বলিতে পারে, পড়িতে পারে। পিতা তাহাকে অশ্বারোহণে পারদর্শী করিয়াছে, মোটর সে নিজেই চালায়, পিতার সহিত বর্মার জঙ্গলে সে বহু শিকার করিয়াছে। উপযুক্ত ব্যায়ামের ফলে তাহার দেহ সুগঠিত, শক্তিশালিনী, দেহে যেমন তার অটুট শক্তি, অন্তরে তার তেমনই অকুতো সাহস।’
কৃষ্ণার পরিচয়ে লেখিকা জানান কৃষ্ণার বয়স ১৬-১৭ বছর। সেই অনুযায়ী কৃষ্ণার জন্ম ১৯৩৬ বা ১৯৩৭ সালে বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে একক কন্যা সন্তান খুব সাধারণ বিষয় হলেও বিশ শতকের প্রথমার্ধে সমাজ বিষয়টিকে সহজ ভাবে গ্রহণ করেনি, বিশেষত সেই সন্তান যখন একটি মেয়ে। কিন্তু লেখিকা কৃষ্ণাকে এ ভাবেই চিত্রিত করলেন। কৃষ্ণার ‘গোয়েন্দা কৃষ্ণা’ হয়ে ওঠার পিছনে এই নির্মাণ কৌশলও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। আমরা ‘গুপ্ত ঘাতক’ কাহিনিতে সত্যেন্দ্র চৌধুরীকে এ কথা বলতে দেখি, “আমার ছেলে নেই, তুমি মেয়ে হলেও তোমায় গড়ে তুলেছি ছেলের মতো— আমি আশাও করি আমার যা কিছু অসমাপ্ত কাজ তুমি শেষ করবে, আমার মুখ তুমি উজ্জ্বল রাখবে।’ এ কথার পর খুব স্বাভাবিক ভাবে মনে প্রশ্ন জাগে, সত্যেন্দ্র চৌধুরীর আর একটি ছেলে থাকলে কি কৃষ্ণাকে তিনি এমন ‘ছেলের মতো’ করে গড়ে তুলতেন? এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য এক বার প্রভাবতী দেবীর ব্যাক্তিগত জীবনের দিকে তাকানো প্রয়োজন।
১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ৫ মার্চ চব্বিশ পরগনার (বর্তমানে উত্তর চব্বিশ পরগনার) গোবরডাঙ্গায় খাঁটুরা গ্রামে প্রভাবতী দেবীর জন্ম। মাত্র ন’বছর বয়সে গৈগুর গ্রামের বিভূতিভূষণ চৌধুরীর সঙ্গে প্রভাবতীর বিয়ে হয়। কিন্তু এক সপ্তাহ পরে প্রভাবতী চলে আসেন মা সুশীলাবালা দেবীর কাছে, এর পর শ্বশুরবাড়িতে আর কখনও ফিরে যাননি। এর পর প্রভাবতীর বাবা গোপালচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় পেশার খাতিরে সপরিবারে দিনাজপুরে চলে যান। সেখানে পড়াশোনার জন্য স্কুলে ভর্তি হয়ে শেষ ধাপ পর্যন্ত পৌঁছেও প্রভাবতী পরীক্ষা দিতে পারেননি। কারণ, পাঁচ বোন এক ভাইয়ের সংসারে ভাই সত্যসাধনের গুরুত্ব ছিল সবচেয়ে বেশি। তাকে কলেজে ভর্তি করার জন্য সুশীলাবালা দেবী ছয় সন্তানকে নিয়ে বহরমপুরে চলে আসেন। পড়াশোনায় খুব মনযোগী হওয়ার পরও একমাত্র ভাইয়ের শিক্ষাজীবনের সামনে তাঁর শিক্ষাজীবনের গুরুত্ব ফিকে হয়ে যায়। কিন্তু তার পরও তিনি পড়াশোনা সম্পূর্ণ করেছেন, সফল শিক্ষিকা ও সাহিত্যিক হিসাবে পরিচিত হয়ে উঠেছেন। পিতৃতন্ত্রের প্রচলিত ধারণার সামনে মাথা নত না করে সুপ্রতিষ্ঠিত স্বাধীনচেতা নারী হিসেবে নিজেকে মেলে ধরেছেন। পাশাপাশি নারীদের জন্য কলম ধরেছেন। শিক্ষিত আধুনিক নারীর আদর্শ রূপ কেমন হওয়া উচিত এবং বিপদে পড়লে একটি মেয়ে কী ভাবে নিজের প্রচেষ্টায় তা থেকে মুক্তি পেতে পারে, তার দৃষ্টান্ত স্বরূপ তিনি কৃষ্ণা চরিত্রটিকে নির্মাণ করেন।
কৃষ্ণাকে তার বাবা ‘ছেলের মতো’ করে মানুষ করলেও লেখিকা কিন্তু কৃষ্ণা চরিত্র থেকে নারীত্ব ছেঁটে ফেলেননি। বরং বলা যায় তৎকালীন আধুনিক সমাজের মনোমুগ্ধকারিনী নারী হিসেবেই কৃষ্ণাকে নির্মাণ করেছেন। ‘গুপ্ত ঘাতক’-এ লেখিকা লেখেন— “গাত্রবর্ণ উজ্জ্বল থাকায় কেহ সন্দেহ করিতে পারিবেনা যে, সে ইউরোপিয়ান নয়। প্রণবেশ তাহার ইংরেজি উচ্চারণ শুনিয়াছে,— ইউরোপিয়ান গভর্নেসের কাছে দুই বৎসর হইতে মানুষ হওয়ায় কথাবার্তা ও চালচলনে তাহাকে সর্বাংশে ইউরপিয়ান-বালিকা বলিয়াই মনে হয়।” এই কারণে বেশিরভাগ কাহিনিতেই অপরাধী পক্ষের বিভিন্ন চরিত্র তার প্রেমে পড়ে। আর নিজেকে মুক্ত করার জন্য কৃষ্ণা তাদের দুর্বলতাকে ব্যবহার করে। এই প্রসঙ্গে একটি কথা উল্লেখ করতেই হয়, প্রভাবতী দেবী জানান কৃষ্ণা কখনও বিয়ে করবে না পণ করেছে। এর পিছনে পাশ্চাত্য নারীবাদের দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাব থাকা অসম্ভব নয়। তবে তার চেয়েও লেখিকার ব্যক্তিগত জীবনের প্রভাবই বেশি বলে মনে হয়। কিন্তু বিয়ে করবে না বলে সে একেবারে তার আবেগ বা পুরুষকে জয় করার প্রবণতাকে সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়ে দেয়নি। এক দিকে নারায়ণ দাস বা মিংলোর (‘মায়াবী ও কৃষ্ণা’) মতো চরিত্রগুলিকে সে কার্যোদ্ধারের সিঁড়ি হিসেবে ব্যাবহার করেছে, তাদের সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করেছে। অন্য দিকে সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ না হয়েও অপরাধ জগতের পুরুষ রাজা রায় (‘কৃষ্ণার অভিযান’) বা অমর নাথের (‘মায়াবী ও কৃষ্ণা’) দেওয়া প্রেমের উপহারকে সে সাদরে গ্রহণ করেছে। সমকালের পাঠকের প্রচলিত ধারণাকে আঘাত করার মতো এমন উপাদান জনপ্রিয় সাহিত্য ধারায় বেশ বিরল বলা যেতে পারে। ব্যোমকেশ বা ফেলুদার মতো চরিত্রকে দিয়ে সমাজচলতি সংস্কার ভাঙার এমন দুঃসাহসী কাজ তাদের স্রষ্টারা করতে পারেননি।
‘কৃষ্ণা সিরিজ’ সমকালে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও তার পর বহু বছর পাঠকের কাছে তার কোনও হদিশ ছিল না। এর জন্য বিষয় নির্বাচনের সীমাবদ্ধতা অনেকটাই দায়ী। জাল নোটের কারবার, ড্রাগের ব্যাবসা, নারী পাচার ইত্যাদি অপরাধের প্রসঙ্গ থাকলেও অপহরণ, বন্দি করে রাখা ও বেআইনি ভাবে সম্পত্তি আত্মসাৎ করার প্রসঙ্গের উপরেই লেখিকা বেশি জোর দিয়েছেন। পাঠক যখন কোনও একটি কাহিনি পড়েছেন, চমৎকৃত হয়েছেন। কিন্তু সব কাহিনি একবার পড়ে ফেলার পর আর তার প্রতি আকর্ষণ বোধ করেননি। একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে পুরনো গোয়েন্দা কাহিনির দিকে ফিরে দেখার একটি প্রবণতা চোখে পড়ে। এই সময়ে কৃষ্ণার কাহিনিগুলিকে একত্রে এনে ‘গোয়েন্দা কৃষ্ণা’ বইটি প্রকাশ করা হয়। পাঠক সমাজের সামনে আবার নতুন করে হাজির হয় ‘গোয়েন্দা কৃষ্ণা’।
একুশ শতকের পাঠকের কাছে ‘কৃষ্ণা সিরিজ’ সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। কিন্তু একটি সাহিত্য সমালোচনার জন্য রচনাকালের দিকে ফিরে তাকানোও জরুরি। বর্তমান পাঠক ‘কৃষ্ণা সিরিজ’ হাতে পাওয়ার আগেই একুশ শতকের মেয়ে গোয়েন্দাদের সঙ্গে পরিচিত হতে পেরেছে। তাই স্বাভাবিক ভাবেই অন্যান্য মেয়ে গোয়েন্দাদের সঙ্গে তুলনা করার অবকাশ পেয়েছে। কিন্তু আজ থেকে প্রায় সাত দশক আগে প্রভাবতী দেবী যখন কৃষ্ণা চৌধুরী চরিত্রটি নির্মাণ করেন, তখন তিনি পথ প্রদর্শক হিসেবে কোনও চরিত্রকে পাননি। পূর্ববর্তী লেখকদের ত্রুটি থেকে সাবধান হওয়ার কোনও অবকাশ তাঁর ছিল না। কোনও সহজ রাস্তা ধরে তিনি হাঁটা শুরু করতে পারেননি, বরং উত্তরসূরিদের জন্য নতুন রাস্তা তৈরি করে দিয়ে গিয়েছেন। সবচেয়ে বড় কথা যে সময়ে বাঙালি মেয়েরা তথাকথিত সুগৃহিণী হয়ে সংসার সামলানোর মধ্যেই জীবনের সারবত্তা খুঁজে নিচ্ছে, সেই সময়ে তিনি কৃষ্ণা চরিত্রটিকে সমাজের সামনে এনে আদর্শ নারীর সংজ্ঞা বদলের চেষ্টা করলেন। বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যের ইতিহাসে তো বটেই, বাংলার নারীবাদী সাহিত্যের আলোচনায়ও ‘গোয়েন্দা কৃষ্ণা’র প্রাসঙ্গিকতা অনস্বীকার্য। যে সময়ে মেয়ে গোয়েন্দা নিয়ে গল্প লেখার ক্ষেত্রেও লেখকরা মিস জেনি মারপেলের আদলের বাইরে অন্য কিছু ভাবতে পারেননি, সেই সময়ে এমন একটি মেয়ে গোয়েন্দা সিরিজ রচনা প্রশংসার দাবি রাখে। বলতে বাধা নেই, এই সিরিজ শুধুমাত্র পাঠকদের মনোরঞ্জনকারী সৃজনই নয়, সমাজের প্রচলিত মানসিকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদও বটে।
(লেখক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যের গবেষক। মতামত ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy