কিছু দিন আগে ভারত সরকার পরিচ্ছন্নতার নিরিখে এগিয়ে থাকা দেশীয় শহরগুলির একটি তালিকা প্রকাশ করেছে।
এই মুহূর্তে চালু ব্যবসাগুলির মধ্যে শহরের অবস্থান নির্ণয়ের কারবার (সিটি র্যাঙ্কিং) বেশ লাভজনক। ‘ইকনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট’ এ সপ্তাহে একটি তালিকা প্রকাশ করেছে, যেখানে সব থেকে ব্যয়বহুল এবং সব থেকে সস্তা শহর দেখানো হয়েছে। এই তালিকার শীর্ষ ১০টি শহরের মধ্যে সব থেকে নীচে রয়েছে আমদাবাদ। তার সঙ্গে একাসনে বসেছে দামাস্কাস বা ত্রিপোলির মতো প্রায় বিশেষত্বহীন শহর।
কিছু দিন আগে ভারত সরকার পরিচ্ছন্নতার নিরিখে এগিয়ে থাকা দেশীয় শহরগুলির একটি তালিকা প্রকাশ করে, যেখানে ইনদওর আরও এক বার শীর্ষস্থানে উঠে আসে। সরকার একই ভাবে স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ জীবনযাত্রার নিরিখেও একটি তালিকা প্রকাশ করেছিল, যেখানে শীর্ষে ছিল বেঙ্গালুরু, তার পরেই ছিল পুণে আর শ্রীনগর। ধানবাদ ছিল সবার নীচে। ‘সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট’-এর করা আরেকটি তালিকায় ওই নিরিখে বেঙ্গালুরু ছিল সর্বোচ্চ স্থানের অধিকারী, তার পরেই ছিল চেন্নাই (সরকারি তালিকায় চেন্নাই ছিল চতুর্থ স্থানে)।
এই ভাবেই ‘স্মার্ট সিটি’-র তালিকাও সম্ভবত প্রকাশের পথে। জানা নেই, ইতিমধ্যেই সেই কাজটি কেউ করে ফেলেছেন কি না। কারণ, এ সংক্রান্ত এক জটিল মাপকাঠির কথা হাওয়ায় ভাসছে।
কোনও কোনও প্রবণতাকে সহজে চিহ্নিত করা যায়। ভারত বা আন্তর্জাতিক— উভয় ক্ষেত্রেই বৃহৎ মহানগরগুলি কিন্তু এই সব তালিকায় মোটেই ভাল স্থানে থাকে না। মুম্বই এবং দিল্লি (সে অর্থে কলকাতাও) খুব কম সময়েই এমন তালিকার উপরের দিকে স্থান পেয়েছে। পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক পরিসরে বাসযোগ্যতার নিরিখে ভাল অবস্থানে রয়েছে ভিয়েনা, অকল্যান্ড বা ভ্যাঙ্কুভারের মতো মাঝারি মাপের তথা মানের শহরগুলি। খুব টেনেটুনে মেলবোর্ন এই তালিকার খানিক উপরের দিকে নিজের জায়গা করতে পেরেছে। ইউরোপ, আমেরিকা এবং চিনের বড় শহরগুলি বাসযোগ্যতার নিরিখে বেশ খারাপ স্থানেই রয়েছে। এর একটি আংশিক কারণ হতে পারে, এই শহরগুলিতে ব্যয়বহুল ‘রিয়েল এস্টেট’ বা আবাসন ব্যবসার রমরমা। সেই সঙ্গে রয়েছে যাতায়াতের সময় সংক্রান্ত মাপজোক এবং দূষণের বিষয়। জাপান এই মাপকাঠিতে বেশ লক্ষণীয়। সেখানে ওসাকা রাজধানী টোকিওর চেয়ে এগিয়ে রয়েছে।
দ্বিতীয় যে প্রবণতাটি দৃশ্যমান সেটি এই যে, বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিণে অবস্থিত শহরগুলি এই ধরনের তালিকায় বেশ ভাল অবস্থানে রয়েছে (এতে অবশ্য আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই)। সেই সঙ্গে রয়েছে গুজরাতের তিন বৃহৎ শহর। জীবনযাত্রার ব্যয় এবং স্বাস্থ্য পরিষেবা— এই দু’টি বিষয় জীবন যাপনের গুণগত মানের নির্ণায়ক সাতটি বিশ্ব-স্বীকৃত মাপকাঠির মধ্যে অন্যতম। মেঙ্গালুরু, কোয়ম্বত্তুর, চেন্নাই এবং থিরুঅনন্তপুরমের মতো শহর এমন তালিকায় ভাল অবস্থানেই থাকে। বৃহত্তর প্রেক্ষিতে দেখলে ভারতীয় শহরগুলির বেশির ভাগই এই সব তালিকার উপর থেকে তিন চতুর্থাংশের মধ্যেই বিরাজ করে। সাধারণত নিম্নতন আয়স্তর এবং উষ্ণ আবহাওয়ার কারণে এই শহরগুলি তালিকায় লক্ষণীয় স্থানে বিরাজ করতে পারে না। সে কারণে ভারতের সেরা শহরগুলির অধিকাংশই দাক্ষিণাত্যের মালভূমিতে অবস্থিত। এর অন্যতম কারণ গ্রীষ্মের দাবদাহ থেকে এই ভূগোলের দূরে থাকার সুবিধা। ইনদওর মালবের মালভূমির প্রান্তে অবস্থিত (সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে যার উচ্চতা ১৮০০ ফুট), সেখানে কোয়ম্বত্তুর (উচ্চতা ১৩৫০ ফুট) নীলগিরির পর্বতের সন্নিহিত।
যদি ভারতে সাফল্যের সঙ্গে নগরায়নের কাজটি ঘটাতে হয়, তা হলে এ ধরনের ‘টু টিয়ার’ শহরের (যে শহরগুলি আবাসন ব্যবসার বাজারের নিরিখে সম্ভাবনাময়) মধ্যে যেগুলির জনসংখ্যা ১০ লক্ষ থেকে ৫০ লক্ষের মধ্যে, সেগুলির উপর নজর রাখতে হবে। এই শহরগুলির মধ্যে কয়েকটি সরকারের ‘স্মার্ট সিটি’ প্রকল্পের আওতাধীন হয়ে ইতিমধ্যেই নজর কেড়েছে। বিষয়টি উৎসাহব্যঞ্জক, সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই সঙ্গে এ-ও মনে রাখা দরকার যে, এই ধরনের শহরের বেশ কিছু পরিকাঠামোগত খামতি রয়েছে। যেমন, এই সব শহরে প্রত্যক্ষ ভাবে নির্বাচিত মেয়র নেই, যুক্তিপূর্ণ সম্পত্তি-কর ব্যবস্থা নেই। নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্য তথা বাইসাইকেল চালনার উপযোগী (সাম্প্রতিক নগরায়নের এক অন্যতম শর্ত) পরিকাঠামো নেই। বহুতল অফিস বাড়িগুলির ফ্লোর এরিয়ার আনুপাতিক মাপও তেমন উল্লেখযোগ্য নয়, যে তা ব্যবসায়িক বিন্দু থেকে এবং নাগরিক সম্প্রসারণের দিক থেকে সহায়ক হবে।
কিন্তু এ থেকে একটি শিক্ষণীয় বিষয় এই যে, বৃহৎ মহানগরগুলি, তাদের জীবনযাত্রার মান যত খারাপই হোক না কেন, পরবর্তী কালের নগরোন্ননয়নকারীদের ক্রমাগত আকর্ষণ করে চলেছে। সত্যিই এই সব শহরের আকর্ষণে আজও বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসেন। যে কারণে মুম্বইয়ে এত বেশি গুজরাতি, পার্সি, দক্ষিণ ভারতীয় বাস করেন। মনে রাখতে হবে এক সময়ে এই শহর বাগদাদের ইহুদিদেরও আকর্ষণ করেছিল। একই কারণে দিল্লি এখন পঞ্জাবি-অধ্যুষিত এক শহর এবং কলকাতা তার স্বর্ণযুগে চিনা, আর্মেনীয়-সহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষকে ঠাঁই দিয়েছিল। আসলে এই মিশ্র জনগোষ্ঠীর সহাবস্থানই মহানগরগুলিকে আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু করে তোলে, তাকে ‘কসমোপলিটান’ করে তোলে। তুলনায় ছোট শহরগুলি তার প্রাদেশিক চরিত্র কাটিয়ে উঠতে ব্যর্থ হয়।
এই বিন্দু থেকে দেখলে, বেঙ্গালুরু একটি উৎসাহব্যঞ্জক ‘কেস স্টাডি’। বেশ কিছু মাপকাঠিতে কোয়ম্বত্তুর বা মেঙ্গালুরু তাকে পিছনে ফেলে দিয়েছে (দূষণ, স্বাস্থ্য পরিষেবা, নিরাপত্তা ইত্যাদি)। তবুও বাসযোগ্যতার নিরিখে বেঙ্গালুরু সব থেকে বেশি এগিয়ে রয়েছে।
মোটর গাড়ি-অধ্যুষিত শহরের যাবতীয় সমস্যা বেঙ্গালুরুর রয়েছে। কিন্তু তার জলবায়ু, মহানাগরিক পরিবেশ, সাধ্যের মধ্যে সম্পত্তি কেনার সুবিধা এবং ক্রয়ক্ষমতার তালিকায় তার এগিয়ে থাকা (মূলত প্রযুক্তি জীবিকা-সম্ভূত নব্য অভিজাতদের দৌলতে) বেঙ্গালুরুকে সেই সব মানুষের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলেছে, যাঁরা মুম্বইয়ে সম্পত্তি কেনার কথা ভাবতেও পারেন না (প্রসঙ্গত, মুম্বই তার বাসিন্দাদের আয়ের তুলনায় বিশ্বের সব থেকে ‘দামি’ শহর)। বাসযোগ্যতার নিরখে খুব খারাপ স্থানে থাকা দিল্লি-গুরুগ্রাম-নয়ডার থেকেও বেঙ্গালুরু শ্রেয় বলেই অনেকে মনে করেন। তা সত্ত্বেও ‘টু টিয়ার’ শহরগুলির দ্রুত নগরায়ন, সুরতের মতো শহরের জনসংখ্যা গত চার দশকে গড়ে ৭০ শতাংশ বাড়াতে সাহায্য করেছে। ভারতের ভবিষ্যৎ নগরায়নের সাফল্য বা ব্যর্থতার ললাটলিপি কিন্তু এই সব শহরের জারণের সঙ্গেই লিখিত রয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy