Advertisement
E-Paper

শিক্ষক দারোগারূপে সংস্থিত?

তবুও স্কুল-পড়ুয়াদের প্রতিষ্ঠানকে নস্যাৎ করার এই ভঙ্গি, এবং শিক্ষকদের লক্ষ্য করে এতটা হিংস্র হয়ে ওঠাকে কেন্দ্র করে কয়েকটি প্রশ্ন উঠে আসে।

শৈবাল বসু

শেষ আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০২৫ ০৮:২৭
Share
Save

সম্প্রতি রাজ্যের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার একটি কেন্দ্রে মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে পরীক্ষার্থীদের তল্লাশি করা হয়েছিল। তাতে ক্ষুব্ধ এক দল পরীক্ষার্থী কর্তব্যরত মাস্টারমশাইদের মারধর করে। সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া শিক্ষক-নিগ্রহের ভিডিয়ো সকলকে বিচলিত করেছে। পরীক্ষাকেন্দ্রে শিক্ষক-নিগ্রহ, হুমকি বা সংঘর্ষের সংবাদ অবশ্য নতুন নয়। পরীক্ষার শেষ দিনে পরীক্ষাকেন্দ্রের চেয়ার বেঞ্চ পাখা ভাঙচুর, পরীক্ষা শেষে প্রকাশ্যে কুচি কুচি করে বইয়ের পাতা বা চিরকুটের আকারের কাগজ সোল্লাসে উড়িয়ে দেওয়া— এ সব কিছুই ধীরে ধীরে একটা রেওয়াজে পরিণত হতে দেখেছি আমরা, বিগত প্রায় কুড়ি বছর ধরে।

তবুও স্কুল-পড়ুয়াদের প্রতিষ্ঠানকে নস্যাৎ করার এই ভঙ্গি, এবং শিক্ষকদের লক্ষ্য করে এতটা হিংস্র হয়ে ওঠাকে কেন্দ্র করে কয়েকটি প্রশ্ন উঠে আসে। যেমন, যেখানে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের মূল ভিত হওয়ার কথা পারস্পরিক শ্রদ্ধা আর বিশ্বাস, এ দেশের পরীক্ষাব্যবস্থার চিরকালীন নজরদারিপ্রথা (এবং সাম্প্রতিক তল্লাশি) সেই পারস্পরিক বিশ্বস্ততার কেন্দ্রে কি আঘাত করছে না? শিক্ষক মেটাল ডিটেক্টর হাতে অন্য বিদ্যালয়ের একটি পরীক্ষার্থীর মাথা থেকে পা পর্যন্ত পরীক্ষা করছেন রাষ্ট্রীয় রক্ষীর মতো। অপর দিকে, একটি অচেনা বিদ্যালয়ের প্রবেশদ্বারে অল্পবয়সি পড়ুয়াটি সেই রক্ষীরূপী শিক্ষকের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের সততার পরীক্ষা দিচ্ছে। সেই মুহূর্তে দু’জনের মধ্যে ক্ষমতার কোন সমীকরণ রচিত হচ্ছে?

আধুনিক শিক্ষার অন্যতম স্থপতি রবীন্দ্রনাথ ঠিক একশো পাঁচ বছর আগে লিখছেন “...যাদের উচিত ছিল জেলের দারোগা বা ড্রিল সার্জেন্ট বা ভূতের ওঝা হওয়া তাদের কোনমতেই উচিত হয় না ছাত্রদিগকে মানুষ করিবার ভার লওয়া।” (ছাত্রশাসনতন্ত্র/ শিক্ষা)। অথচ, এটাও তো সত্য সাম্প্রতিক কালে ডিজিটাল অসদুপায় সমাজের সর্বস্তরে যে বিপুলতায় ছড়িয়ে পড়ছে, লক্ষ লক্ষ পরীক্ষার্থী-সম্বলিত একটি পরীক্ষায় এই ধরনের তল্লাশিব্যবস্থা চালু করা ছাড়া আর কী উপায় রয়েছে, সহসা চোখে পড়ে না। একাধিক অনভিপ্রেত ঘটনার পরে পরীক্ষাকেন্দ্রে শিক্ষকদের উপরেও অনেক বিধিনিষেধ আরোপ করতে হয়েছে পরীক্ষানিয়ামক সংস্থাগুলিকে। শুধু আমাদের রাজ্যে নয়, সারা দেশেই পরীক্ষাব্যবস্থাকে মুড়ে দিতে হচ্ছে প্রায় রাষ্ট্রীয় ধাঁচের নজরদারি ব্যবস্থায়।

এ সব দেখে মনে হয়, আমাদের দেশের স্কুলগুলোর প্রধান পরিচয় আর শিক্ষাকেন্দ্র নয়, পরীক্ষাকেন্দ্র। ছাত্র ও শিক্ষক, দু’তরফই অসহায়, কারণ স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলি হয়ে উঠছে, রবীন্দ্রনাথেরই ভাষায়— ‘মার্কা দিবার কল’। অনেক দিন ধরেই পরীক্ষার ফলের সঙ্গে চাকরি বা টাকা রোজগারের সম্পর্ক পরীক্ষা-ব্যবস্থাকে করে তুলেছে একটি ক্ষমতাকেন্দ্র, যার প্রতিনিধি হলেন মাস্টারমশাই আর প্রতীক হল স্কুলবাড়ি। দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মূল লক্ষ্য যে মানুষ গড়া, সে কথাটা অবান্তর হয়ে গিয়েছে। মার্কশিটকে সবচেয়ে দামি জিনিস বলে মনে করা হচ্ছে। শিক্ষাব্যবস্থায় লক্ষ্যের চেয়ে উপলক্ষ বড় হয়ে উঠেছে।

স্কুল যখন কেবলই ক্ষমতা দেখিয়ে শিশুকে শাসন করতে চায়, শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা প্রয়োগ করে তাকে ‘ছোট’ করতে চায়, তখন ছোটদের মধ্যে জন্ম নেয় প্রতিক্ষমতা তৈরির আকর্ষণ। প্রায়ই তার প্রকাশ হয় লঘু রুচির ‘রিল’ বানিয়ে ভার্চুয়াল সমাজে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার ইচ্ছেয়। এই সব রিল, ভিডিয়োর মাধ্যমে উপার্জন করে নিজের কাছে নিজের মূল্য প্রমাণ করার চেষ্টা করছে অনেক ছাত্রছাত্রী। সেই সঙ্গে জন্ম হচ্ছে এক ধরনের হিংস্রতার। যে পড়ুয়াটি স্কুলের ওই ক’টি ঘণ্টার বাইরে, সমাজে এবং সমাজমাধ্যমে প্রতিদিন নানা হিংসা প্রত্যক্ষ করছে, শুষে নিচ্ছে বল্গাহীন অসহিষ্ণুতার ভাষা, তার মনে সূক্ষ্ম, গভীর সংবেদন জাগিয়ে তোলা যাবে কী করে? তার পাঠপদ্ধতি আমরা এখনও ভেবে উঠিনি।

এ রাজ্যে সরকারি বিদ্যালয়গুলিতে, বিশেষত উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে সিমেস্টার চালু হয়েছে, গ্রহণ করা হচ্ছে ধারাবাহিক মূল্যায়ন-পদ্ধতি। আশা করা যায়, এতে একটিমাত্র চূড়ান্ত পরীক্ষা দেওয়ার মানসিক চাপ হালকা হবে, হয়তো অনেক ভারহীন হবে পথচলা। এর সঙ্গে আরও নীচের ক্লাসগুলি থেকে জোর দেওয়া হোক শিশুদের জন্য নির্মল আনন্দ-পরিসর রচনায়। স্কুলের সিলেবাসে, ধারাবাহিক মূল্যায়নে থাকুক গান, নাচ, ছবি আঁকা, গল্প বলা, থিয়েটার। এর জন্য নতুন শিক্ষকপদ তৈরি করার প্রয়োজন নেই, কম-বেশি সব স্কুলেই পড়ুয়াদের নিয়ে নাচ-গান, আবৃত্তি বা নাটক করানোর মতো আগ্রহী মাস্টারমশাই, দিদিমণিরা আছেন। খেলাধুলা ঐচ্ছিক থেকে আবশ্যক হোক। ফুটবল, ক্রিকেট, কবাডি শহরের স্কুলগুলিতে সম্ভব না হলে পাঠক্রমে আসুক ড্রিল বা ব্রতচারী নৃত্য। জেলার নিজস্ব লোকসংস্কৃতির চর্চা হোক জেলা স্কুলগুলিতে। এক বিদ্যালয়ের শিশুরা অন্য বিদ্যালয়ে গিয়ে খেলাধুলা, নাচ-গানে যোগ দিক।

সেই সঙ্গে সিলেবাসে আসুক আপৎকালীন সহায়তা এবং প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবহারিক অনুশীলন, আসুক শুশ্রূষার শিক্ষা, ভিন্ন মত, ভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি শ্রদ্ধার আর সহিষ্ণুতার পাঠ। মনে পড়ে, বাবরি মসজিদ ভাঙার ঠিক ঊনসত্তর বছর আগে, ১৯২৩ সালে মহাত্মা গান্ধী ইয়ং ইন্ডিয়া-তে লিখছেন, ইস্কুলের পাঠ্যে থাকা উচিত সমস্ত ধর্মের সারকথা, সিলেবাসে নিহিত থাকুক উদারতা এবং সহিষ্ণুতার সারাৎসার। মূল্যবোধের শিক্ষাকে বিদ্যালয় স্তরে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছিলেন গান্ধী। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কটি কেমন হওয়া দরকার, তা তো লেখায়, কথায়, আর হাতে-কলমেও দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।

আসলে, শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্ককে ক্ষমতা-বিন্যাসের চোখ দিয়ে যাতে দেখা না হয়, তার পথ খোঁজাটাই বাকি রয়ে গিয়েছে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

HS Exam 2025

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}