Advertisement
E-Paper

এক দুঃসহ আঁধার

আইন আদালত কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলিকেও মোটামুটি ‘ম্যানেজ’ করে ফেলা সম্ভব হয়েছে। মাঝে মাঝে তাঁরা সক্রিয় হন বটে, আবার একটা পর্যায়ের পর ‘ঘুমিয়ে’-ও পড়েন।

দিশাহারা: সুপ্রিম কোর্টের রায় শোনার পর রাজ্যের স্কুল শিক্ষক ও কর্মীদের উদ্বেগ, ৩ এপ্রিল।

দিশাহারা: সুপ্রিম কোর্টের রায় শোনার পর রাজ্যের স্কুল শিক্ষক ও কর্মীদের উদ্বেগ, ৩ এপ্রিল। বিশ্বনাথ বণিক।

দেবপ্রতিম চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০২৫ ০৮:২১
Share
Save

সব বিষয় নিয়ে ভিন্ন মত ও বিতর্ক থাকতে পারে, কিন্তু এই রাজ্যের বর্তমান শাসক দল যে আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত, তা নিয়ে বোধ হয় পারে না। দলের নেতা-নেত্রী, কর্মী-সমর্থকরাও এ নিয়ে তর্ক তোলেন না! আত্মপক্ষ সমর্থন করে তাঁদের বলতে শোনা যায়: ‘কারা দুর্নীতিগ্রস্ত নয়?’ আত্মবিশ্বাসী মন্ত্রী টিভির সাংবাদিককে অবলীলায় বলেন, “কার কী বলার আছে, আমার আইনি চাকরি আমি কাকে দেব না দেব?”

এ-কথা তাঁরা বলতে পারেন, কারণ পশ্চিমবঙ্গবাসী তাঁদের সেই ‘ছাড়পত্র’ দিয়েছে। দুর্নীতি, বিপুল টাকার বিনিময়ে চাকরি বেচা, নেতাদের হিসাব-বহির্ভূত অগাধ সম্পত্তি এখন সমাজসিদ্ধ। আইন আদালত কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলিকেও মোটামুটি ‘ম্যানেজ’ করে ফেলা সম্ভব হয়েছে। মাঝে মাঝে তাঁরা সক্রিয় হন বটে, আবার একটা পর্যায়ের পর ‘ঘুমিয়ে’-ও পড়েন। কিছু নেতা-মন্ত্রী গ্রেফতার হন বটে; কিন্তু কয়েক জন দুর্নীতিগ্রস্ত নেতার অনুপস্থিতিতে কী-ই বা আসে যায়, বাকিরা তো আছেন। সকলেই জানেন যে দলটা ওঁদের নয়। দলটা আসলে এক জন বা দু’জনের। সেই এক-দুই জন যত দিন আছেন, দলটিও আছে, ভোটে-জেতার মেশিনটিও আছে। গত বৃহস্পতিবার, রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থায় অভূতপূর্ব ‘কালো দিন’-টিতে, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ২৫৭৫৩ জন শিক্ষকের চাকরি যাওয়ার পরে, রাস্তার মোড়ে জনৈক ভদ্রলোককে বলতে শুনলাম, “যাঁরা ঘুষ দিয়ে চাকরি পেলেন, তাঁরা শাস্তি পেলেন। যাঁরা তা করেননি তাঁরাও বরখাস্ত হলেন। কিন্তু যাঁরা টাকা খেলেন, সেই নেতা-মন্ত্রীদের কিছুই হল না, তাঁরা আবার ভোটে জিতে ফিরে আসবেন।”

সুপ্রিম কোর্ট বলেনি, চাকরি-হারানো সবাই দুর্নীতিতে লিপ্ত। মূল দোষটা স্কুল সার্ভিস কমিশনকেই দিয়েছে আদালত। “অনিয়মের তথ্যভিত্তিক সমর্থন ও বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ সত্ত্বেও, পশ্চিমবঙ্গ স্কুল সার্ভিস কমিশন শুরুতে ত্রুটি ও বেআইনি ব্যাপারগুলি ঢাকতে সচেষ্ট হয়েছিল। নিয়োগ প্রক্রিয়ার প্রতিটি স্তরে অনিয়মগুলিকে ঢাকার ও লুকানোর ব্যাপক প্রচেষ্টাই যাচাই ও নির্ধারণের প্রক্রিয়াকে কঠিন, কার্যত অসম্ভব করে তুলেছে। আমরা নিশ্চিত যে সম্পূর্ণ নির্বাচন প্রক্রিয়াটি ইচ্ছাকৃত ভাবে বেআইনি কার্যকলাপের মাধ্যমে দুর্নীতিগ্রস্ত করা হয়েছে”, রায়ে মাননীয় বিচারপতিরা এমনই বলেছেন। আর সে জন্যেই প্রক্রিয়াটি বাতিল করা হয়েছে, যার শিকার হয়েছেন যেমন চিহ্নিত দুর্নীতিগ্রস্তরা, তেমনই যাঁদের বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ বা অপ্রমাণ আনা যায়নি, সেই শিক্ষক-শিক্ষিকারাও।

নির্দোষ শিক্ষকদের এই অসহায় বিপন্নতা বর্ণনাতীত। জানি না কী ভাবে তাঁরা এই বিপর্যয় সামলে উঠবেন। এই ‘বিপন্নতা’-র দায়ভাগ কার, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে কুটিল রাজনৈতিক তরজা, যার লক্ষ্য অবশ্যই ভোট-রাজনীতি। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি ‘সুযোগ’ কাজে লাগিয়ে রাজ্য রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে চাইবে, স্বাভাবিক। সরকারও চাইছে মামলাকারী উকিল, ‘অমানবিক’ বিচারব্যবস্থা ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিকে নিশানা করতে। অথচ সুপ্রিম কোর্টের রায় থেকেই দায়ভাগটা স্পষ্টত এসএসসি-র, এবং অবশ্যই তাদের পৃষ্ঠপোষক রাজ্য সরকারের। বুক-ফুলিয়ে দুর্নীতি করা এবং তার পর অত্যন্ত পরিকল্পিত ভাবে দুর্নীতির আদালতগ্রাহ্য প্রমাণগুলিকে লোপাট করা— সেই সারদা দুর্নীতির সময় থেকেই চালু ছক হয়ে গিয়েছে রাজ্যে; কিছু দিন আগে আর জি কর কাণ্ডের সময়ও যা আমরা লক্ষ করেছি। প্রশ্ন আসে মনে যে, এতটা জনসমর্থনে পুষ্ট একটি রাজনৈতিক দল ও তাদের পরিচালিত সরকার কেন তাদের নিজেদের ‘ভুল’ সংশোধন করে না? কেন বার বার দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে? কেন দুর্নীতিগ্রস্তদের পক্ষ নিয়ে বিপুল সরকারি অর্থ ব্যয় করে আদালতে? একটা ‘মোটামুটি দুর্নীতিহীন’ প্রশাসনও কি তারা তৈরি করতে অক্ষম?

উত্তর খুঁজলে দু’টি কথা মনে আসে। এক, এই দল, দলের নেতা-কর্মীদের সামাজিক শ্রেণি, পেশা, আর্থিক আয়ের উৎস এমনই যে ‘অবৈধ’ উপায়ে নিরন্তর অর্থের জোগান ছাড়া এই দল চলবে না। পনজ়ি স্কিমগুলি একদা ছিল আয়ের প্রধান উৎস। সেই ‘স্ক্যাম’ ধরা পড়ে যাওয়ার পরে, আয়ের জন্য এদের বিকল্প ‘অবৈধ’ উপায় খুঁজতে হয়েছে। এর মধ্যে একটি পথ হল, বিভিন্ন প্রকল্পে সরকারি অর্থবরাদ্দের একটি অংশকে ‘কাটমানি’ হিসেবে পার্টি ফান্ডে ও নেতাকর্মীদের ব্যক্তিগত পকেটে স্থানান্তরিত করা। ব্যাপারটা দুই দিক থেকেই লাভজনক, ‘উন্নয়ন’-ও হল, আবার ‘উন্নয়ন’-এর একটা অংশ নেতাকর্মীদের পকেট ভরিয়ে পার্টি-মেশিনারিকে চালু রাখাও গেল। কিন্তু আর্থিক সঙ্কটে ভুগতে থাকা একটি সরকারের পক্ষে এই উপায়ে আর কত অর্থই বা সংগৃহীত হতে পারে? ফলে আয়ের আরও নানা অবৈধ উপায় হন্যে হয়ে খুঁজতে হল। সরকারি চাকরি বিক্রি তার মধ্যে একটা।

আর এটা সম্ভব হয়েছে দুর্নীতিকে সমাজসিদ্ধ (নেসেসারি ইভল) করে দেওয়ার ফলে। অথচ আশ্চর্য, ক্ষমতাসীন হওয়ার প্রাক্কালে এই দলের অন্যতম প্রধান বার্তা ছিল ‘সততা’-র, সৎ প্রশাসনের। ‘সততার প্রতীক’ হিসেবে সে দিন মিডিয়ার প্রচার ও জনতার তরফ থেকে তার স্বীকৃতির একটা ভিত ছিল— বামফ্রন্ট জমানার নিচু স্তরে দুর্নীতির প্রসার। কিন্তু এখন বলতেই হবে, দুর্নীতির এমন সামাজিকীকরণ ও বৈধকরণ আগে হয়নি। আমাদের সমাজমন ইতিমধ্যে অনেকটা পচে-গলে গিয়েছে বলেই দুর্নীতির এ লজ্জাহীন উদ্‌যাপন সম্ভব হচ্ছে।

তাই আজ শুধু ক্ষমতাসীন সরকারের দিকে আঙুল তুললেই হবে কেন? এই বিপুল দুর্নীতি তো আমাদের চোখের সামনেই হয়েছে। নাগরিক সমাজ, দুর্নীতির সমস্ত লক্ষণ টের পেয়েও, চাওয়া-পাওয়ার হিসেব কষে নিশ্চুপ হয়ে বসে থেকেছে। যে শিক্ষক সমাজ স্বাধীনতা-উত্তর বাংলার রাজনৈতিক চালচিত্রে সবচেয়ে প্রতিবাদী একটি শ্রেণি হিসেবে নিজেদের জানান দিয়েছিল, তাদের আমরা কতটুকুই বা পথে নামতে দেখেছি! এর একটি কারণ নিশ্চয় সরকারের ‘শাসন-তোষণ’ নীতি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে সরকারি নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করে শিক্ষক সমাজকে সরকার-মুখাপেক্ষী করে তোলার প্রচেষ্টা, যেখানে বিরোধিতা করলেই ‘বদলি’-করে দেওয়ার প্রচ্ছন্ন বার্তাও রয়েছে। কিন্তু এই শিক্ষক সমাজ তো প্রাক্‌-বামফ্রন্ট পর্বে যথেষ্ট সরকারি বিরোধিতার মুখেই প্রতিবাদী সত্তা ধরে রেখেছিল। তা হলে কি ইতিমধ্যে শিক্ষক সমাজের মানসিকতা ও শ্রেণিচরিত্রে একটি লক্ষণীয় রূপান্তর ঘটে গিয়েছিল? তাঁরাও অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন সেই সম্পন্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে যাঁদের কাছে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার মান ধরে রাখার বা উন্নত করার আর তেমন সামাজিক তাগিদ ছিল না? তৃণমূল শাসনের দীর্ঘ সময়ে (যা বামফ্রন্ট জমানা থেকেই শুরু হয়েছিল) আমরা লক্ষ করেছি এক দিকে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার ভেঙে পড়া, অন্য দিকে বেসরকারি শিক্ষাব্যবসার উত্তরোত্তর প্রসার। সচ্ছল নাগরিক সমাজ, সরকারি ‘প্রসাদলোভী’ বিদ্বজ্জনেরা তাঁদের সন্তানদের এই বিদ্যালয়গুলিতে পাঠান না, তাই কি এর ভেঙে পড়াও তাঁদের কাছে উপেক্ষণীয় বিষয় হিসেবে থেকে যায়?

বস্তুত, স্বাধীনতা-উত্তর পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে বড় ‘শিক্ষা কেলেঙ্কারি’-র পর সমাজের একটি অংশকে যে ভাবে সরকারের ভজনা করতে দেখা যাচ্ছে, তা থেকে বোঝা যায় স্তাবকতার সংস্কৃতি কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে। প্রশ্নটা বোধ হয় এই নয় যে, বিকল্প কী? বিকল্প কোথায়? বিরোধীরা এলে কি অবস্থার কোনও মৌলিক বদল হবে? বর্তমান পরিস্থিতিতে এদের দুর্বল করা মানে তো ‘বৃহত্তর বিপদ’-কে জায়গা ছেড়ে দেওয়া? প্রশ্নটা হয়তো এই যে, আমাদের প্রতিবাদহীনতা এই শক্তিকেও কি সেই বাধাবন্ধহীন পরিসর দিচ্ছে না যার মধ্যে দাঁড়িয়ে শাসক যা খুশি তাই করে পার পেয়ে যাওয়ার ছাড়পত্র পেয়ে যাচ্ছেন?

কেবল সরকারকে উৎপাটন করার জন্যে নয়, একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকারকে সৎ-পথে রাখার জন্যেও তো প্রয়োজনীয় প্রতিবাদটা দরকার। সেই পথে গড়িমসি, নানা হিসাবনিকাশ, কেবল দুঃসহ অন্ধকারকেই প্রলম্বিত করছে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Corruption SSC Supreme Court of India

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}