না মোহনলালের প্রতি আমার আর কোনও রাগ নেই। যা করেছেন, বেশ করেছেন।
ঘটনার সূত্রপাত গত সপ্তাহে মালয়ালম ছবি এম্পুরন মুক্তি পাওয়ার পর। কেরলে বিজেপি বা কারও কোনও মাথাব্যথা ছিল না এই ছবিটি নিয়ে। একে রোমহর্ষক থ্রিলার, তায় কেরলে উত্তমকুমারের মতো জনপ্রিয় মোহনলাল এই সিনেমার নায়ক (ছবি)। কার কী বলার আছে? কিন্তু বিজেপি, আরএসএস ও হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি বলতে শুরু করল, এখানে ২০০২-এর গুজরাত দাঙ্গা দেখানো হয়েছে। যা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও দেশের সুস্থিতির পক্ষে বিপজ্জনক। আরএসএস-এর মুখপত্র অর্গানাইজ়ার তো মোহনলাল থেকে ছবির পরিচালক পৃথ্বীরাজ সুকুমারন, চিত্রনাট্যকার গোপী সকলের সম্মিলিত প্রয়াসে ছবিটাকে ‘বামপন্থী চক্রান্ত’ বলে দেগে দিল। অবস্থা এমন পর্যায়ে গেল যে কেরলের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নকেও ফেসবুকে লিখতে হল, “আমি ছবিটা দেখলাম। অযথা জল ঘোলা হচ্ছে, সে রকম কিছু নেই। শিল্পের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা, শিল্পী ও কলাকুশলীদের ভয় দেখিয়ে চাপে রাখা আজকাল হিন্দুত্ববাদীদের দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে।” তার পরই মোহনলাল লিখলেন, “জনতার ভালবাসা আমি পেয়েছি। যদি কেউ আমার এই ছবিতে দুঃখিত বা ক্ষুব্ধ হয়ে থাকেন, তার প্রতিকারও আমার কর্তব্য। দরকার হলে আমরা স্বেচ্ছায় কয়েকটা জায়গা এডিট করে দেব বলে আলোচনায় বসছি।” সেই কাঁচি চালানো এর মধ্যেই সারা। তাতেও অবশ্য মেটেনি— শুক্রবারই প্রযোজক গোকুলম গোপালনের কেরল ও তামিলনাড়ুর বাড়িতে তল্লাশি চালাল ইডি।
যদি জেনেশুনে ছবিটা করে থাকেন, তা হলে সেন্সর ছবি পাশ করার পর ফের এডিট কেন? সাত তাড়াতাড়ি ছুটলাম হলে। এবং ছবি দেখে মুগ্ধ। এ প্রায় সিনেমার ভূরিভোজ। কেরল থেকে আফ্রিকার ঘানা, ইয়েমেন থেকে লন্ডন, কোথায় না ছুটেছে এই ছবির গল্প? অবিকল জেমস বন্ডের ছবির মতো। অযথা কম্পিউটার গ্রাফিক্স এবং স্পেশ্যাল এফেক্টস নয়, ভারতীয় ছবি যে গল্প বলার কায়দা এবং নানা বিষয়ে কতটা এগিয়ে গিয়েছে, তা এই ছবি না দেখলে অজানা থেকে যেত। সিনেমাবোধহীন ফালতু বিতর্কে না ঢুকে মোহনলাল ও তাঁর টিম ঠিক করেছেন। কুণাল কামরার রসিকতা থেকে শুরু করে সব কিছুতে সিঁদুরে মেঘ দেখে যারা, তাদের সিনেমা এবং থ্রিলার বোঝাতে সময় নষ্ট করবে কে?
দক্ষিণের অন্য ভাষাগুলির তুলনায় মালয়ালমের গড়ন অনেকটা সংস্কৃতের কাছাকাছি। ‘এম্পুরন’ কথাটার মানে অধীশ্বর। যে ছোটখাটো সামন্ত রাজারা আরও বড় রাজাকে কর দেয়, তিনিই অধীশ্বর। মালয়ালম ভাষায় এই ছবির ক্যাচলাইন ‘মানুষের উপরে, ঈশ্বরের নীচে।’
এই অধীশ্বরটি কে? স্টিফেন নেদুমপলি? স্টিফেন ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন ফ্রন্ট বা আইইউএফ দলের প্রতিষ্ঠাতা, একদা মুখ্যমন্ত্রী রামদাসের পালিত পুত্র। সে-ও দলের নেতা ছিল, কিন্তু বাবার জায়গায় রামদাসের পুত্র যতীন মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর সে রহস্যজনক ভাবে টানা কয়েক বছর ভাগলবা। কোথায়, কেউ জানে না। তার পরই দেখা যায় আফ্রিকার মাদক পাচারকারীদের নেতা কুরেশি আব্রাহামকে। সে-ই এখানে আন্তর্জাতিক মাদকচক্রের অন্যতম চালক। কখনও পুলিশ ও ইন্টারপোলের অফিসারদের ভুল রাস্তায় নিয়ে গিয়ে নিকাশ করে, লন্ডনের টিউব রেলে সেই অফিসারের মৃতদেহ একটা ব্যাগে ভরে রেখে দেয়, যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। স্টিফেনই কি এখন কুরেশি? রহস্য বজায় রেখে মোহনলাল এই দুই চরিত্রেই!
মাদক চোরাচালান ও মাফিয়া সংক্রান্ত এই গল্পটি শুরু হয়েছিল অন্য ভাবে। পশ্চিম ভারতের এক শুখা রাজ্য, সেখানে অন্ধকার রাতে পর পর লরিতে চড়ে, গামছায় মুখ ঢাকা কয়েকশো সশস্ত্র মানুষ। পুরনো মন্দির পেরিয়ে সুভদ্রাবেনের কোঠার সদর দরজা ভেঙে ঢুকছে তারা, ঢুকেই সেখানকার স্থানীয় সংখ্যালঘুদের কোতল করা। পুরুষদের নৃশংস ভাবে খতম করা হচ্ছে, তরোয়াল নিয়ে বৃদ্ধা মায়ের সামনে মেয়েকে ধর্ষণ করা হচ্ছে। কোঠার দরিদ্র কর্মচারী মাসুদ তার দুই ছেলে জায়েদ ও জাহিরকে বাঁচাতে একটা ঘরে লুকিয়ে রাখে, কিন্তু শেষরক্ষা হয় না। খুনেদের নেতা বলরাজ আই-হোল দিয়ে সব কিছু দেখে নেয়। মাসুদ খুন হয়ে যায়, জায়েদ ছোট ভাই জাহিরকে পিঠে চাপিয়ে অন্ধকার গ্রাম, নদীনালা বেয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। এক সময় দেখা যায়, জাহির দাদার পিঠেই লুটিয়ে মরে পড়ে আছে। এই সময়েই টাইটল কার্ডে শেষ স্টিল ছবি, একটা জ্বলন্ত ট্রেন। ‘এটা ছিল প্রতিক্রিয়া, ক্রিয়াটা তো ছিল গোধরার ঘটনা। ট্রেনে আগুন দিয়ে হিন্দুদের পুড়িয়ে মারা হল, সে সব তো দেখায়নি,’ হিন্দুত্ববাদী দলগুলির সমবেত প্রতিক্রিয়া। সিনেমার ভাষাটা বুঝতে শিখুন, ভাই। দাঙ্গাটা চলচ্ছবি, আর তার আগে ট্রেনে আগুন শুধুই স্মৃতির স্থিরছবি। এদের মধ্যে চলচ্ছবি সত্য, ‘সিনেমা ইজ় ট্রুথ টোয়েন্টি ফোর টাইমস পার সেকেন্ড’ গোছের একটা কথা গোদার বলে গিয়েছিলেন না!
গোদার বাদ দিন। সবার উপরে গোলওয়ালকর সত্য, তাহার উপরে নাই। সেই দাঙ্গার পর ছবি সটান চলে আসে কয়েক দশক পর আজকের সময়ে। আইইউএফ-এর প্রয়াত নেতা রামদাসের পুত্র যতীন পাঁচ বছর আগে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছে, এখন আবার ভোট। এ দিকে যতীনের নামে আর্থিক তছরুপ ও অনেক কিছুর অভিযোগ, দিল্লির গোয়েন্দারা তার জীবন জেরবার করে দিচ্ছে। যতীন দল ভেঙে, ইস্তফা দেয়। এ বার উত্তর ভারতের প্রভাবশালী দল ‘অখণ্ড শক্তি মোর্চা’র সঙ্গে সে জোট বাঁধে। রামদাসের আমলে এই শক্তি মোর্চা কয়েকবার কেরলের মাটিতে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেও ব্যার্থ হয়েছিল। অতএব আনন্দিত চিত্তে কেরলে পা রাখে সেই দলের প্রভাবশালী হিন্দুত্ববাদী নেতা বজরঙ্গি। দর্শক অবাক চোখে দেখে, কয়েক দশক আগের সেই খুনি, দাঙ্গাবাজ বলরাজই আজকের বজরঙ্গি।
কিন্তু দলের প্রতিষ্ঠাতা রামদাস তো কখনও চায়নি উত্তর ভারতের হিন্দুত্ববাদী দলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ভোটে জিততে। অতএব, যতীনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় তার দিদি প্রিয়দর্শিনী (মঞ্জু ভারিয়ের)। ভাই দল ভেঙে বেরিয়েছে বেরোক, কিন্তু এ বার থেকে বাবার দলকে নেতৃত্ব দেবে সে। তার আগে দলীয় নেতৃত্বকে সে শর্ত দেয়, যতীনের আর্থিক তছরুপে যোগসাজশের সন্দেহে গোয়েন্দারা যেন তাকে সকলের সামনে হাতকড়া পরিয়ে থানায় নিয়ে যায়, এবং সে থানায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে দল যেন জনতাকে নিয়ে বিক্ষোভ দেখায়। এই ভাবেই দিদি হয়ে ওঠে দলের অবিসংবাদিত নেত্রী, উত্তর ভারতের হিন্দুত্ববাদীদের সঙ্গে জোট বেঁধে ভাইয়ের দ্বিতীয় বার ভোটে জেতার স্বপ্ন চুরমার হয়ে যায়। প্রসঙ্গত, কে আসল উত্তরাধিকারী তা নিয়ে প্রতিষ্ঠাতার মৃত্যুর পর দক্ষিণ ভারতের রাজনৈতিক দলগুলির আকচাআকচি ঘোর বাস্তব। তামিলনাড়ুতে এম জি রামচন্দ্রনের মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী জানকী রামচন্দ্রন না নায়িকা জয়ললিতা কে আসল উত্তরাধিকারী তা নিয়ে ব্যাপক গোলমাল হয়েছিল। শেষ অবধি জয়ললিতাকে নতুন দল এআইএডিএমকে তৈরি করতে হয়। অন্ধ্রে এন টি রামারাওয়ের মৃত্যুর পরেও তাঁর উত্তরসূরিদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব বাধে, শেষে মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সি পান তাঁর জামাতা চন্দ্রবাবু নায়ডু।
খাল কেটে বজরঙ্গিকে কেরলে আনার পর কী হল? বাহুবলী রাজনীতির তুমুল বিশৃঙ্খলা। মঞ্চে প্রিয়দর্শিনীর বক্তৃতা, একের পর এক সোডার বোতল আর বোমা আছড়ে পড়ছে। আগুনের মধ্যে দিয়েই নতুন নেত্রী পালাতে থাকে, জঙ্গলের মধ্যে তাকে অনুসরণ করে গুন্ডারা। রাজনীতির সবক তাদের জানা নেই, নারীমাত্রেই ভোগ্যা।
আর তখনই একের পর এক লাল আলোর বিন্দু। হেলমেটে স্যাটেলাইট ফোন নিয়ে ওই গুন্ডাদের বিরুদ্ধে আরও কিছু লোক। প্রিয়দর্শিনীকে বাঁচাতে আফ্রিকা থেকে এসে গিয়েছে তার পালিত ভাই স্টিফেন। অতঃপর প্রিয়দর্শিনীই ভোটে দাঁড়ায়, মাঝসমুদ্রে জাহাজের ডেকে একটা হেলিকপ্টারের সামনে স্টিফেন যতীনকে নিয়ে গিয়ে বলে, “তোর সামনে এখন একটাই রাস্তা। এ দিকে নয়, কপ্টারে উঠে অন্য কোথাও কেটে পড়া।”
আর বজরঙ্গি? সে পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে। স্টিফেন এ বার তার পোষ্যপুত্র জায়েদের হাতে রিভলভার তুলে দেয়। সেই যে দাঙ্গার পর ভাইয়ের মরদেহ পিঠে নিয়ে জায়েদ পালাচ্ছিল, পালাতে পালাতে সে উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের পাকিস্তানে। সেখান থেকে আফগানিস্তানের মাদক পাচারকারীদের পাল্লায়। কুরেশি গ্যাং তাকে কিনে নেয়। মাদক পাচারকারী ক্রাইম লর্ড কুরেশি আব্রাহাম তথা স্টিফেন তাকে বলে, “এত দিন বাবা, দাদার মৃত্যুর শোধ তোলার কথা ভেবেছিস। যা, শোধ নে এ বার।” প্রতিশোধের মর্ম স্টিফেন জানে। মুম্বই বিস্ফোরণ-পরবর্তী দাঙ্গায় প্রায় মরতে বসেছিল সে। জনা কয়েক চিনা তাকে বাঁচায়। তারাও ড্রাগ মাফিয়া। তাদের শিক্ষাতেই কি আফ্রিকার মাদক চোরাচালানের নাটের গুরু হয়ে উঠেছে সে?
এই প্রশ্নের উত্তর আরও বছর দুয়েক পরে। পরবর্তী পর্ব তখনই মুক্তি পাবে। দ্য কাশ্মীর ফাইলস বা দ্য কেরালা স্টোরি-র মতো প্রচারসর্বস্ব ছবিতে হিন্দুত্ববাদ ছিল, জোর করে পুরস্কার দেওয়ার রাজনীতি ছিল। কিন্তু পর্বে পর্বে টানটান থ্রিলারের এই শিল্পিত অমোঘ উত্তেজনা ছিল না।
আপাতত স্টিফেনের অনুপ্রেরণায় জায়েদ রিভলভার তাক করে এগিয়ে যায়। এই সেই বলরাজ! তার বাবা, ভাইকে দাঙ্গার আগুনে পু়ড়িয়ে আজ দিল্লির নেতা সেজে বসে আছে যে! নির্ভুল লক্ষ্যে ট্রিগার টিপে দেয় সব-হারানো জায়েদ।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)