Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Communist

শ্রমজীবীর ‘কোটা’, বটেই তো

শতবর্ষপ্রাচীন কমিউনিস্ট দলটির বিভিন্ন ধারায় এখনও হিন্দু উচ্চবর্ণজাতদের আধিপত্য।

শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০২২ ০৮:২১
Share: Save:

বার বার স্ট্রোক হচ্ছে, দেহ সম্পূর্ণ অচল। কিন্তু মাথা যেন অধিকতর সক্রিয়। নিজের জীবনের বাতি যতই নিবে আসতে দেখছেন, ততই যেন তিনি— ভ্লাদিমির ইলিচ— মস্তিষ্কের সচলতায় মানবসভ্যতার বাতি জ্বালিয়ে রাখার রসদ জুগিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর সেই ভাবনার অন্যতম ছিল পার্টি সংগঠনের পুনর্বিন্যাস। অর্ধশতাব্দী আগে ঘটে যাওয়া প্যারিস কমিউনের অভিজ্ঞতা এবং সদ্য সংঘটিত রুশ বিপ্লব তাঁকে শেখাল: যে পার্টির নেতৃত্বে বিপ্লব সংঘটিত হতে পারল, তাকে ক্রমাগত নতুন করে গড়ে তুলতে হবে; তা না হলে বিপ্লবকে রক্ষা করা যাবে না, এবং বিপ্লবী পার্টির বিশ্বজোড়া মানবমুক্তির লক্ষ্যের দিকে এগোনো যাবে না। ১৯২২-এর ডিসেম্বর ও ১৯২৩-এর জানুয়ারি মাসে কংগ্রেসকে পাঠানো নোটে বার বার তিনি জোর দিচ্ছেন কেন্দ্রীয় কমিটিতে সদস্যসংখ্যা বাড়ানোর উপর। আরও গুরুত্বপূর্ণ, তাঁর মতে, সদস্যদের অন্তত অর্ধেককে আসতে হবে শ্রমিকদের মধ্য থেকে। পার্টিতে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত লোকেদের গুরুত্বকে তিনি খাটো করছেন না— কিন্তু, পার্টি ও সোভিয়েটকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে এগিয়ে-থাকাদের সঙ্গে শ্রমিকদের নেতৃত্বকেও যোগ করতে হবে। লেনিন জোর দিচ্ছেন এমন এক সামূহিক নেতৃত্বে, যেখানে একে অপরের কাছ থেকে শিখবে, এবং নিজেকে ও অপরকে অধিকতর বিকশিত করে তুলবে। নানা কারণে তাঁর সেই ইচ্ছা পূর্ণ হয়নি, যার মাসুল দিতে হচ্ছে বিশ্ব শ্রমজীবী আন্দোলনকে।

ভারতেও কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে তথাকথিত এগিয়ে-থাকাদেরই প্রাধান্য। ভারতীয় বাস্তবতা নিয়ে পার্টির প্রভাবশালীরা মনোযোগ দিলে হয়তো দেখতে পেতেন, ভারতীয় সমাজে অনুৎপাদক উদ্বৃত্তভোগী ও উৎপাদক শ্রমজীবী, এই দু’টি ভাগ অনেকাংশেই গড়ে উঠেছে বর্ণ ও জাতপাতের বিভাজনের মধ্য দিয়ে। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে ভাষা, আঞ্চলিকতা, ধর্ম, ইত্যাদি নানা পরিচিতির জটিল মিশ্রণ। রাশিয়ার মতো শিল্পে কিছুটা অগ্রসর দেশের সঙ্গে তো বটেই, এমনকি চিনের মতো গ্রামীণ ও কৃষিনির্ভর সমাজের সঙ্গেও ভারতীয় সমাজের বিরাট পার্থক্য ছিল— ভারতীয় সমাজ গড়ে উঠেছে শত শত জাতীয়তার সংমিশ্রণে। স্বাধীনতার সময় ভারতে কিছু মাত্রায় শিল্পশ্রমিক গড়ে ওঠে, কিন্তু প্রাক্-পুঁজিবাদী সম্পর্কগুলো ছিল জোরালো। তাদের মধ্যে জাতি-বর্ণ ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে। উদাহরণ হিসেবে, ভারতের শ্রমজীবীদের শতকরা ৯৩ শতাংশই অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক, আবার এঁদের বিপুল অংশই হচ্ছেন পরিচিতিতে নিম্নবর্ণ, আদিবাসী, এবং মুসলমান। এই পরিচিতিগুলোকে দমনের মধ্যে দিয়ে এমন এক ‘শ্রমের বাজার’ গড়ে তোলা হয়, যেখানে শ্রম সস্তা আর শ্রমিক ঊনমানব।

স্বাধীনতার পরে কমিউনিস্ট পার্টি শ্রমজীবীদের পক্ষে দাঁড়িয়ে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে। কিন্তু ভারতের কমিউনিস্টরা এ দেশে সামন্ততন্ত্রের উচ্ছেদ করার জন্য ‘কৃষকের হাতে জমি’র দাবিতে যতটা জোরের সঙ্গে এগিয়ে এলেন, জাতি-বর্ণ-ভিত্তিক এবং অন্যান্য পরিচিতিভিত্তিক দমনের বিরুদ্ধে লড়াই সংগঠিত করার দিকে সেই ভাবে এগিয়ে আসতে পারলেন না। ফলে সামন্ততন্ত্রবিরোধী আন্দোলনের চরিত্রটা কখনওই তার পূর্ণ রূপে বিকাশ লাভ করতে পারল না। এই ব্যর্থতার একটা কারণ, কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতাদের বড় অংশটাই এসেছিলেন হিন্দু উচ্চবর্ণ থেকে— সচেতন ভাবে না হলেও তাঁদের জন্মগত উৎস তাঁদের মনোজগতে উচ্চবর্ণ দর্শন ও ভাবধারাকে প্রভাবিত করেছিল। ভারতীয় সমাজের গণতন্ত্রীকরণের জন্য ‘কৃষকের হাতে জমি’ স্লোগান যেমন খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই যুগ যুগ ধরে চলে আসা জাতি-বর্ণ-ব্যবস্থা, অর্থাৎ জাতি-বর্ণের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা বিশেষাধিকার ও বৈষম্যের অবলুপ্তি ও একান্ত জরুরি। প্রকৃতপক্ষে, সমাজের গণতন্ত্রীকরণের এই ধাপটি অতিক্রম না করে ভারতীয় সমাজে শ্রমজীবী মানুষের শ্রেণিভিত্তিক জোট গড়ে উঠতে পারবে না, এবং সমাজবিপ্লবের পরবর্তী কর্মসূচি, অর্থাৎ সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে না।

এই ধাপটি পেরোতে হলে সমস্যাটিকে তার প্রকৃত স্বরূপে জানতে হবে। সেই জানার প্রক্রিয়া তখনই নিষ্পন্ন হতে পারে, যখন নেতৃত্বের মধ্যে সুবিধাভোগী অংশের থেকে আসা বিশ্বের নানাবিধ জ্ঞানের দিক দিয়ে এগিয়ে-থাকা লোকেদের সঙ্গে সমাজের নিপীড়িতদের ভিতর থেকে উঠে আসা নেতৃত্বের আন্তরিক যোগ ঘটে। তার জন্য তো নিপীড়িত অংশের থেকে নেতৃত্ব তুলে আনতে হবে— যে সমাজে জাতি ধর্ম ভাষা আঞ্চলিকতা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে শাসকরা সমাজের বিপুলাংশের স্বাভাবিক বিকাশ রুদ্ধ করে রেখেছে, সেখানে সচেতন চেষ্টা ছাড়া তাঁদের মধ্য থেকে কমিউনিস্ট দলে নেতা উঠে আসবেন, তা হয় না। হয়নিও। শতবর্ষপ্রাচীন কমিউনিস্ট দলটির বিভিন্ন ধারায় এখনও হিন্দু উচ্চবর্ণজাতদের আধিপত্য।

এই দিক দিয়ে সিপিআইএম দলের সদ্য-সমাপ্ত কংগ্রেসে রামচন্দ্র ডোমের মতো এক জন দলিতের, এবং দেবলীনা হেমব্রমের মতো এক জন আদিবাসীর যথাক্রমে পলিটবুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির মতো নীতি নির্ধারক সংস্থায় নির্বাচিত হয়ে আসা নিশ্চয় গুরুত্বপূর্ণ। যাঁরা এঁদের ‘কোটা’য় মেম্বার হতে দেখছেন, তাঁদের বোধ হয় এটা জানা উচিত যে, লেনিন ঠিক এই রকম কোটাই চেয়েছিলেন— ভারতীয় শ্রমজীবীর প্রতিনিধি যদি দলিত আদিবাসী মুসলমান না হন, তবে সেটা কারা? কেবল আত্মসন্তুষ্টির উপলক্ষে নয়, এঁদের নেতৃত্বটা প্রকৃত অর্থে স্বীকার করে নেওয়াই শ্রমজীবী মানুষের প্রতি বিশ্বস্ততার নিদর্শন। সেটাই লেনিনের দেখানো পথ, তাঁর নির্দেশিত, নেতৃত্বে অন্তত পঞ্চাশ শতাংশ শ্রমজীবীর যোগদান নিশ্চিত করা।

অন্য বিষয়গুলি:

Communist
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy