সুপ্রিম কোর্টে ওয়াকফ (সংশোধনী) আইন সংক্রান্ত মামলার প্রথম দু’দিনের শুনানির পর সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতাকে তিন বিচারপতির বেঞ্চকে যে আশ্বাস দিতে হয়েছে, তাতে স্পষ্ট যে, ওয়াকফ সংশোধনী আইনের সমস্যাপূর্ণ ধারাগুলিকে কেন্দ্রীয় সরকার আপাতত স্বেচ্ছায় স্থগিত রাখল। গত এক দশকে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন মোদী সরকার নিরন্তর ভাবে ভারতের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ ও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে খর্ব করার একটি নির্দিষ্ট কর্মসূচি অনুসরণ করে এসেছে। সংবিধানের ৩৭০ ধারা রদ, অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের ধ্বংসাবশেষের উপরে রামমন্দির নির্মাণ, অসমে এনআরসি, ২০১৯-এ নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ), অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করার উদ্যোগ— প্রতিটি পদক্ষেপই করা হয়েছে ভারতের কুড়ি কোটির বেশি মুসলমান জনগোষ্ঠীকে নিশানা বানিয়ে, সংবিধানপ্রদত্ত অধিকারগুলি কেড়ে নিয়ে তাঁদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করার লক্ষ্যে। ওয়াকফ সংশোধনী আইনও সেই কর্মসূচিরই অংশ। বর্তমান মামলার শুনানি চলাকালীন প্রধান বিচারপতি সরকারকে যে সব প্রশ্ন করেছেন, এবং বিভিন্ন মন্তব্য করেছেন, তাতে মনে হয় যে, শীর্ষ আদালত এ বার সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে অপব্যবহার করে অসাংবিধানিক আইন প্রণয়নকে বৈধতা দিতে নারাজ।
ওয়াকফ সম্পত্তি হল মুসলিম ব্যক্তিগত আইনে দান করা ধর্মীয় সম্পত্তি। মসজিদ, মাদ্রাসা, কবরখানা, দরগা, ইদগা, এতিমখানার মতো মুসলিম সম্প্রদায়ের সমস্ত ধর্মীয় সম্পত্তিই ওয়াকফ সম্পত্তির অন্তর্গত। ব্রিটিশ আমলে ওয়াকফ সম্পত্তির বৈধতাকে স্বীকৃতি দিয়ে আইন করা হয়েছিল। স্বাধীনতার পর সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো অনুযায়ী ১৯৫৪ সালে ওয়াকফ আইন পাশ করা হয়। ১৯৯৫ সালে ওয়াকফ সম্পত্তির ব্যবস্থাপনার উন্নতি এবং আধুনিকীকরণের উদ্দেশ্যে নতুন আইন প্রণয়ন হয়। ১৯৯৫ সালের ওয়াকফ আইন অনুযায়ী, ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ওয়াকফ সম্পত্তির সমীক্ষার জন্য রাজ্যভিত্তিক সার্ভে কমিশনার নিযুক্ত করা হয়। সার্ভে কমিশনারের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে রাজ্যভিত্তিক ওয়াকফ বোর্ডের উপরে ওয়াকফ সম্পত্তির চূড়ান্ত সূচি প্রকাশ করে তার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। এই আইন অনুসারে, রাজ্যের মুসলিম সাংসদ, বিধায়ক, বার কাউন্সিলের সদস্য এবং বার্ষিক এক লক্ষ টাকার বেশি রোজগার এমন ওয়াকফ সম্পত্তির মুত্তাওয়ালি বা ম্যানেজারদের মধ্যে থেকে রাজ্যভিত্তিক ওয়াকফ বোর্ডে এক বা দু’জন করে সদস্য নির্বাচিত হয়ে আসেন। রাজ্য সরকারের মনোনীত কিছু সদস্য বোর্ডে থাকলেও, নির্বাচিত সদস্যদেরই সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকত ওয়াকফ বোর্ডে। ওয়াকফ বোর্ডের চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার মুসলিম হওয়া বাধ্যতামূলক ছিল।
ওয়াকফ সম্পত্তি সংক্রান্ত কোনও বিবাদ দেখা দিলে তার নিষ্পত্তির দায়িত্বে ছিল রাজ্যভিত্তিক ওয়াকফ ট্রাইবুনাল, যার সিদ্ধান্ত কেবল উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যেত। কেন্দ্রীয় ওয়াকফ কাউন্সিলের কাজ ছিল মূলত রাজ্যভিত্তিক ওয়াকফ বোর্ড এবং ওয়াকফ সম্পত্তির ব্যবস্থাপনার বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করা। ২০২৫-এর নতুন আইনে সার্ভে কমিশনার এবং রাজ্যভিত্তিক ওয়াকফ বোর্ডের সমীক্ষার মাধ্যমে ওয়াকফ সম্পত্তি নির্ণয় করার ক্ষমতা তাদের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে জেলাশাসক এবং অন্যান্য উচ্চপদের আমলাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি যে কোনও সরকারি সম্পত্তির ক্ষেত্রে ওয়াকফ বোর্ডের কোনও রকম দাবি থেকে থাকলে তাকে অবিলম্বে নাকচ করে দেওয়া হয়েছে। সরকারি সম্পত্তির ক্ষেত্রে বিবাদ নিষ্পত্তির অধিকারও সরকারি আমলাদের হাতে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে অনেক রাজ্যেই বহু ওয়াকফ সম্পত্তি রাতারাতি সরকারি সম্পত্তি হিসেবে গণ্য হয়ে যেতে পারে।
বহু কাল ধরে ব্যবহারের ভিত্তিতে ওয়াকফ সম্পত্তি নির্ণয় করা (ওয়াকফ বাই ইউজ়ার)— যা পুরনো সম্পত্তির ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট এবং হাই কোর্টের রায়ের মাধ্যমে স্বীকৃত পদ্ধতি— তাকে সম্পূর্ণ ভাবে বাতিল করা হয়েছে। রাজ্য ওয়াকফ বোর্ডগুলির সদস্যপদে নির্বাচিত সদস্যদের সরিয়ে তার জায়গায় সমস্ত পদকে মনোনীত করা হয়েছে। ওয়াকফ বোর্ডে অ-মুসলিম সদস্যের সংখ্যাও বৃদ্ধি করা হয়েছে, বোর্ডের চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার মুসলিম হওয়া আর বাধ্যতামূলক নয়। অর্থাৎ, ওয়াকফ বোর্ডের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার কার্যত কেড়ে নেওয়া হল। রাজ্যভিত্তিক ওয়াকফ ট্রাইবুনালের ক্ষমতাও খর্ব করা হয়েছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক, ওয়াকফ সংশোধনী আইন অনুসারে কেন্দ্রীয় সরকার একটি অনলাইন পোর্টাল এবং ডেটাবেস তৈরি করবে যেখানে আগামী ছয় মাসের মধ্যে সমস্ত রাজ্যের ওয়াকফ সম্পত্তির দলিল-দস্তাবেজ, অডিট রিপোর্ট ইত্যাদি আপলোড করে পুনরায় রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার দেশের ওয়াকফ সম্পত্তির সমগ্র ব্যবস্থাপনাটাই কার্যত নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেবে। কেন্দ্রীয় অনলাইন পোর্টালের নিয়মমাফিক কোনও ওয়াকফ সম্পত্তির দলিল আপলোড না করতে পারলে সেই সম্পত্তি ওয়াকফ সম্পত্তির সূচি থেকে বাদ পড়ে যাবে।
আগের ওয়াকফ আইনে ‘ওয়াকফ’-এর সংজ্ঞা ছিল: “যে কোনও ব্যক্তি কর্তৃক কোনও স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি মুসলিম আইনে স্বীকৃত ধর্মীয়, পুণ্য বা দাতব্য উদ্দেশ্যে স্থায়ী ভাবে উৎসর্গ করা।” সংশোধনের পর এই সংজ্ঞাটি বদলে করা হয়েছে: “যে কোনও ব্যক্তি, যিনি প্রমাণ করতে পারবেন যে, তিনি অন্তত পাঁচ বছর ধরে ইসলাম ধর্ম পালন করছেন এবং যাঁর কোনও সম্পত্তির মালিকানা রয়েছে এবং উৎসর্গের পিছনে কোনও ছলচাতুরি নেই, তিনি ওই স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি স্থায়ী ভাবে উৎসর্গ করলে তা হবে ওয়াকফ।” অর্থাৎ, এক জন মুসলিম দাতাকে তাঁর নিজস্ব সম্পত্তি ওয়াকফ হিসাবে দান করার ক্ষেত্রে তাঁর নিজের ধর্মবিশ্বাসের প্রমাণ দিতে হবে। পাঁচ বছর ধরে ইসলাম ধর্ম পালন করার সার্টিফিকেট কে দেবে, বা সেটা যাচাই করবে কে? ছলচাতুরি না থাকাই বা প্রমাণ হবে কী ভাবে?
ভারতের অন্য কোনও সম্প্রদায়ের ধর্মীয় দানের ক্ষেত্রে এ রকম কোনও শর্ত চাপানো নেই। ওয়াকফ সংশোধনী আইনে কেবলমাত্র ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের দানের ক্ষেত্রে এ রকম শর্ত চাপিয়ে সংবিধানের ১৪ নম্বর (সমানাধিকার) এবং ১৫ নম্বর (বৈষম্যহীনতা) ধারাকে উল্লঙ্ঘন করা হয়েছে। এই শর্ত স্পষ্ট ভাবে ধর্মান্তর বিরোধী, যা বিবেকের ও ধর্মবিশ্বাসের স্বাধীনতার পরিপন্থী। যে সব অ-মুসলিম নিজেদের সম্পত্তি ওয়াকফ করাতে চান অথবা যাঁরা গত পাঁচ বছরের মধ্যে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন, তাঁদের মৌলিক অধিকারেও অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে।
এক দিকে নতুন আইনে মুসলমান ব্যতীত অন্য কোনও সম্প্রদায়ের নাগরিকের ব্যক্তিগত সম্পত্তি ওয়াকফ সম্পত্তি হিসেবে দান করা বন্ধ করা হয়েছে, অন্য দিকে ওয়াকফ সম্পত্তির ব্যবস্থাপনায় অ-মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব বাড়ানো হয়েছে। এই দ্বিচারিতা সংবিধানের ২৫ নম্বর ধারায় প্রদত্ত ধর্ম পালনের স্বাধীনতার অধিকার এবং ২৬ নম্বর ধারা অনুযায়ী সকল ধর্মীয় গোষ্ঠীর নিজস্ব ধর্মীয় বিষয় পরিচালনার অধিকারের পরিপন্থী। হিন্দু বা শিখদের ধর্মীয় সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বর্তমানে যা আইন আছে, সেখানে অ-হিন্দু বা অ-শিখদের সেই ব্যবস্থাপনায় অন্তর্ভুক্তির কোনও শর্ত চাপানো নেই।
যে ভাবে কেন্দ্রীয় সরকারকে একটি পোর্টাল এবং ডেটাবেস বানিয়ে সব রাজ্যের ওয়াকফ সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে তুলে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে তাও সংবিধানসম্মত নয়। সংবিধানের ২৪৬ ধারা অনুযায়ী ধর্মীয় এবং দাতব্য সম্পত্তি সংবিধানের যৌথ তালিকার অন্তর্ভুক্ত, অর্থাৎ সংসদ এবং রাজ্য বিধানসভা উভয়য়েই এই বিষয়ে আইন প্রণয়ন করতে পারে। এই ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার যে ভাবে ওয়াকফ সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা করার ক্ষমতা নিজের হাতে কুক্ষিগত করতে চাইছে, তাতে রাজ্যগুলির অধিকার খর্ব হবে, যেটা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় অবাঞ্ছিত।
ওয়াকফ (সংশোধনী) আইন ২০২৫-এর বিরুদ্ধে শতাধিক জনস্বার্থ মামলা দায়ের হয়ে গেছে সুপ্রিম কোর্টে, ঠিক যেমন হয়েছিল নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন, ২০১৯-এর বিরুদ্ধে। সে সব মামলার নিষ্পত্তি এখনও হয়নি। ওয়াকফ সংশোধনী আইনের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট কী করে, সেই দিকে সকলের নজর থাকবে।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)