Advertisement
E-Paper

জাতের নামে শুধুই বজ্জাতি

এক দিকে হিন্দুরা অধিকতর হিন্দু হয়ে উঠতে বদ্ধপরিকর, অন্য দিকে মুসলমান সমাজও পোশাক ও ধর্মীয় রীতিনীতি পালনের মাধ্যমে অধিকতর মুসলমান রূপে দৃশ্যমান হতে সচেষ্ট।

তূর্য বাইন

শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০২৫ ০৫:০৬
Share
Save

আমাদের দেশ তথা রাজ্যে সম্প্রতি ধর্ম নিয়ে যে উন্মাদনা ও অসহিষ্ণুতা বেড়ে চলেছে, তাতে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় আমরা এক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের বাসিন্দা। হিন্দুত্বের দাপট দেশের বিজ্ঞানচর্চা, সমাজরীতি, আইন, স্থান-নাম, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক-সহ নানা ক্ষেত্রে প্রকট হয়ে উঠছে। এ দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে সংখ্যার নিরিখে যাঁরা অগ্রগণ্য, সেই মুসলিমদের মধ্যেও ধর্মীয় অনুশাসনের প্রভাব সমান্তরাল ভাবে বেড়ে চলেছে। এক দিকে হিন্দুরা অধিকতর হিন্দু হয়ে উঠতে বদ্ধপরিকর, অন্য দিকে মুসলমান সমাজও পোশাক ও ধর্মীয় রীতিনীতি পালনের মাধ্যমে অধিকতর মুসলমান রূপে দৃশ্যমান হতে সচেষ্ট।

নিজ নিজ ধর্মের প্রতি আস্থা এবং তা অনুশীলনে নিষ্ঠাবান হওয়াটা দোষের নয়। কিন্তু তার বাধ্যবাধকতা স্বধর্মীয়দের ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিপন্থী ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের প্রতি বিদ্বেষাত্মক হয়ে উঠলে তা যে মানুষের পক্ষে চরম অকল্যাণকর হয়, ভারতের ইতিহাসে তার অজস্র নজির রয়েছে। কিন্তু সমস্যা হল, ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়া আমাদের ধাতে নেই। পরমতসহিষ্ণুতা সব ধর্মের সারকথা হলেও, এ দেশে ধর্ম এখন রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের অন্যতম অস্ত্র। প্রায় সব রাজনৈতিক দলই কখনও তোষণ, কখনও ভীতি প্রদর্শন, কখনও অযাচিত দান-খয়রাতির মাধ্যমে ধর্মের দিক থেকে বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা নির্বাচকদের আস্থা অর্জনের প্রতিযোগিতায় মত্ত। ধর্মের নামে আগ্রাসনের এই বেড়াজাল থেকে পশ্চিমবঙ্গও যে মুক্ত নয়, ধর্মান্ধদের বারংবার আস্ফালনেই তা প্রকট। এ রাজ্যের রাজনৈতিক দলগুলির সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড দেখে মনে হচ্ছে, যেন এক ধর্মযুদ্ধ শুরু হয়েছে। তবে এই ধর্মযুদ্ধ কোনও মহান উদ্দেশ্য-তাড়িত নয়, ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম নয়, বরং ঠিক বিপরীত।

কোনও রাষ্ট্রে সংখ্যালঘুদের জীবন, ধর্মাচরণ, সম্পত্তি ও জীবিকা সুনিশ্চিত করার দায় সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়েরই। তাই এক জন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির মুখে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিধায়কদের চ্যাংদোলা করে বিধানসভার বাইরে নিক্ষেপ করার হুমকি যেমন চরম দায়িত্বজ্ঞানহীন ও উস্কানিমূলক, তেমনই তাঁদের বিপরীতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কিছু কিছু নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারীর অদূর ভবিষ্যতে সংখ্যাগুরু হওয়ার স্বপ্ন ফেরি করা, বা বিশেষ এক সম্প্রদায়ের মানুষকে ভাগীরথীতে ভাসিয়ে দেওয়ার হুমকিও কোনও সুস্থ ধর্মাচরণের অঙ্গ হতে পারে না। মানুষকে মানুষ হিসেবে না দেখে স্রেফ ভোটব্যাঙ্ক হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত এই স্বঘোষিত ধর্ম-ঠিকাদারদের ভাবখানা এমন— সাধারণ মানুষের দুঃখকষ্ট, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার অব্যবস্থা, কর্মহীনতা, সামাজিক ও আর্থিক শোষণ, সীমাহীন দুর্নীতির গ্রাস, এই সব কিছু থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হল আপনাপন ধর্মকে বিস্তৃত ও প্রতিষ্ঠা করা। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে অভ্যস্ত বাঙালিকে ধর্মের নামে বিভেদে লড়িয়ে দিয়ে যাঁরা সেই মোক্ষলাভের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন, নিজের ধর্মের মানুষদের প্রতি তাঁদের মনোভাব একটু তলিয়ে দেখলেই তাঁদের স্বরূপ বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

উচ্চবর্ণের হাতে নিম্নবর্ণের মানুষের পীড়নও এ দেশে মোছে কই? মহারাষ্ট্রের সম্ভাবনাময় চিকিৎসক পায়েল তদভি, অন্ধ্রপ্রদেশের তরুণ গবেষক রোহিত ভেমুলা বা এ রাজ্যে লোধা সম্প্রদায়ের প্রথম স্নাতক চুনী কোটালের আত্মহত্যায় প্ররোচনার জন্যে দায়ী তথাকথিত উচ্চবর্ণের আত্মগর্বী কিছু মানুষ। আজও দেশের নানা প্রান্তে উচ্চবর্ণের মানুষের কুয়োর জল নিতে গিয়ে প্রাণ হারাতে হয় নিম্নবর্ণের পিপাসার্তকে, বাহন স্পর্শ করলেও জোটে গণপ্রহার। আজও দলিতের ছায়া পর্যন্ত অস্পৃশ্য কিছু তথাকথিত উঁচু জাতের লোকেদের কাছে। পূর্ব বর্ধমানের গীধগ্রামে গীধেশ্বর মন্দিরে নিম্নবর্ণের মানুষের প্রবেশাধিকার দিতে আজও পুলিশ প্রহরা বসাতে হয়, নদিয়ার কালীগঞ্জে শিবমন্দিরে প্রবেশের অধিকার আদায়ের জন্য তফসিলি সম্প্রদায়ের মানুষকে ছুটতে হয় আদালতে। হিন্দুত্ব জাহির করতে কেউ কেউ সদম্ভে নিজেদের ‘ব্রাহ্মণসন্তান’ ঘোষণা করেন, তখন স্বধর্মেরই নিম্নবর্ণের মানুষের প্রতি তাঁদের মনোভাব ফুটে ওঠে। অথচ সবাই জানেন, জাতি-বর্ণ কারও অর্জিত কৃতিত্ব নয়, কে কোন ধর্মে বা জাতে জন্মাবেন তা আগে থেকে স্থির করার কোনও সুযোগ নেই। অথচ জন্মের ভিত্তিতে প্রাপ্ত জাতি-বর্ণের দম্ভ আজও কিছু মানুষের এমনই মজ্জাগত যে, ‘নীচজাতি, মূর্খ, দরিদ্র, অজ্ঞ, মুচি, মেথর’-কে নিজের রক্ত, নিজের ভাই বলে কদাপি তাঁরা স্বীকার করেন না।

অগ্রজপ্রতিম এক মুসলমান সহকর্মী তাঁর কন্যার বিয়ের জন্য পাত্র খুঁজছেন জেনে আর এক মুসলমান সহকর্মীর ভাইয়ের কথা বলেছিলাম। পাত্র শিক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত হওয়া সত্ত্বেও প্রস্তাব তৎক্ষণাৎ খারিজই হয়নি, সৈয়দ বংশীয় কন্যার সঙ্গে আনসারি পাত্রের বিয়ের প্রস্তাব তোলার দায়ে সে যাত্রায় মৃদু তিরস্কারও জুটেছিল। তাই তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া যায় যে এক দিন এ দেশ ‘রামরাজ্য’ হবে, সে ক্ষেত্রেও এত সব সম্প্রদায়ের গভীরে বহতা শ্রেণি ও বর্ণভিত্তিক ঘৃণা ও শোষণ থেকে সহমানুষেরই মুক্তি মেলার সম্ভাবনা ক্ষীণ। স্বধর্ম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজে ও রাষ্ট্রে দারিদ্র, কর্মহীনতা, অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের সঙ্কট নিরসনও অলীক কল্পনামাত্র।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Caste Communalism

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}