তিরিশ নম্বর তুঘলক ক্রেসেন্ট। দিল্লি হাই কোর্টের বিচারপতি যশবন্ত বর্মার সরকারি বাসভবন। তাঁর অনুপস্থিতিতে ওই বাড়ির স্টোররুমে আগুন লাগে। ছুটে আসে পুলিশ ও দমকল বাহিনী। স্টোররুমে অচিরেই আগুন নেবানো গেলেও ভাইরাল হওয়া ভিডিয়োয় দেখা যায়, বস্তা-বস্তা অর্ধদগ্ধ নোটের বান্ডিল সেখানে উদ্ধার হয়েছে। দিল্লির পুলিশ কমিশনার সঞ্জয় অরোরা যদিও প্রাথমিক ভাবে জানিয়েছিলেন, শুধু কিছু কাগজপত্র পুড়েছে।
১৪ মার্চের ঘটনার এই ভিডিয়ো দেশের মানুষকে হতচকিত করেছে, ধরে নেওয়া যায়। বিভিন্ন পেশাদার, ব্যবসায়ী, আমলাতন্ত্র সম্পর্কে নানা অভিমত থাকলেও এখনও বেশির ভাগ মানুষ বিচারপতিদের প্রকৃত অর্থে ‘ধর্মাবতার’ মেনে শ্রদ্ধা করেন। তাই বিচারব্যবস্থার উপর দেশবাসীর আস্থা আজও অটুট রয়েছে। বিচারপতি বর্মা এই পোড়া-নোটের বিষয়ে কিছুই জানেন না বলেছেন। ওই স্টোররুমে নাকি তাঁর কর্মচারী ও রক্ষীরা ছাড়া কেউ যেতেন না। সুতরাং, এই ঘটনা তাঁকে নিন্দিত করার জন্যেই ‘ষড়যন্ত্র’ ছাড়া কিছু নয়। ইতিমধ্যে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির নির্দেশে বিভিন্ন হাই কোর্টের তিন বিচারপতির তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। জাস্টিস বর্মাকে তাঁর পুরনো কর্মস্থল ইলাহাবাদ হাই কোর্টে বদলি করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় এজেন্সির স্ক্যানারে এই নোট-কাণ্ডের প্রেক্ষিতে এক সুপরিচিত ‘রিয়াল এস্টেট ডেভলপার’ আর জনৈক আইনজীবীর পরিচয় ধরা পড়েছে। বড় আকারের বেআইনি আর্থিক লেনদেনে যুক্ত কুখ্যাত ‘ফিক্সার-গ্যাং’এর সঙ্গে ওই ডেভলপারের যোগসাজশের সম্ভাবনাও এজেন্সি খতিয়ে দেখছে। ইতিমধ্যে পোড়া-নোটের তাপে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে সংসদ। সংসদের উচ্চকক্ষ অর্থাৎ রাজ্যসভার চেয়ারম্যান জগদীপ ধনখড়কে গত কয়েকদিন ধরে সভার ভিতরে ও বাইরে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতা সম্পর্কে বিবিধ মন্তব্য করতে শোনা গিয়েছে— যদিও এই ঘটনা সম্পর্কে নির্দিষ্ট ভাবে কিছু বলেননি তিনি। এমনকি সংসদের সার্বভৌম ক্ষমতা ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতা রক্ষায় সাংসদদের ভূমিকাও মনে করিয়ে দিয়েছেন। খবরে প্রকাশ, রাজ্যসভায় দলীয় নেতাদের সঙ্গে আলাদা বৈঠক করেও তিনি এই বিষয়ে তাঁর মতামত জানাচ্ছেন। আবার উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কী করণীয়, সে বিষয়ে তিনি নাকি অন্যদের কথা শুনছেন। কিন্তু নিজে কিছু বলছেন না। রাজধানীর রাজনীতির খোঁজখবর যাঁরা রাখেন তাঁরা বলছেন, জাস্টিস বর্মা-র বাসভবনে নোট-কাণ্ডকে ঘিরে সরকার হয়তো কড়া পদক্ষেপ করতে চলেছে।
কী কী পদক্ষেপ সরকার করতে পারে তা নিয়ে জল্পনারও শেষ নেই। যেমন, রাজ্যসভায় সরকারি প্রস্তাব পাশ করিয়ে কেন্দ্রীয় এজেন্সির মাধ্যমে পুরো ঘটনার তদন্ত করানো যেতে পারে। প্রাথমিক তদন্তে বিচারপতি বর্মার বিরুদ্ধে গুরুতর সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া গেলে দুর্নীতি নিরোধক আইনে ব্যবস্থা করা যেতে পারে। অবশ্য এমন কোনও সরকারি প্রস্তাব ঐকমত্যের ভিত্তিতে রাজ্যসভার অনুমোদন পাবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তাই এত ঘন ঘন আলাপ-আলোচনা চলছে।
প্রসঙ্গত বলা যাক, কে বীরস্বামী বনাম কেন্দ্রীয় সরকার (১৯৯১)-এর মামলায় সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছিল— হাই কোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা অবশ্যই সরকারি কর্তাব্যক্তি, কিন্তু তাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন আইনে ব্যবস্থা করতে হলে উপযুক্ত ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আগাম অনুমতি আবশ্যক। সুতরাং, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির আগাম অনুমোদন পেলে তবেই কেন্দ্রীয় এজেন্সি আইনি প্রক্রিয়া শুরু করতে পারবে। আবার সংসদের আনাচেকানাচে এমনও শোনা যাচ্ছে, রাজ্যসভায় ইমপিচমেন্ট প্রস্তাব পাশ করিয়ে সংশ্লিষ্ট বিচারপতিকে অপসারণের পথে সরকার নাকি যেতে আগ্রহী। সংবিধানে ‘ইমপিচমেন্ট’ শব্দটি নেই।
কিন্তু ওয়েস্টমিনস্টার ধাঁচে ব্রিটিশ সংসদীয় ব্যবস্থার অনুকরণে ভারতের সংবিধানে বিচারপতিদের ‘অপসারণ’ পদ্ধতির উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু তা অত্যন্ত বিলম্বিত প্রক্রিয়া। যার মধ্যে সুপ্রিম কোর্টেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সেই নির্দিষ্ট প্রক্রিয়াকে এড়িয়ে গিয়ে যে অধিবেশনে প্রস্তাব পেশ হবে, সেই অধিবেশনের সময়কালের মধ্যেই তার অনুমোদন পাওয়া কার্যত অসম্ভব। তাই সমালোচকদের মতে, বিচারপতিদের ‘দুর্ব্যবহার’ ও ‘অক্ষমতা’ (যা সংবিধানে অপসারণের ভিত্তি হিসেবে নির্দিষ্ট করা হয়েছে) প্রমাণ করার সংসদসম্মত সুদীর্ঘ প্রক্রিয়ার পাশাপাশি আরও বড় সমস্যা, ভারতে সুপ্রিম কোর্ট নিজস্ব রায়দানের মাধ্যমে ‘কলেজিয়াম’ প্রথা (যা সংবিধানে নেই) চালু করে বিচারপতিরাই হাই কোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগ করেন। এমনকি, তাঁদের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতি বা অন্য গুরুতর অভিযোগের তদন্তও সর্বোচ্চ আদালত নিযুক্ত অভ্যন্তরীণ কমিটিই করে থাকে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, পৃথিবীর কোনও দেশে এমন অস্বচ্ছ ব্যবস্থা নেই ।
ঘটনাপ্রবাহ যে দিকে বইছে তা শেষ পর্যন্ত যদি সরকার, সংসদ বনাম বিচারব্যবস্থার মধ্যে সংঘাতের পরিবেশ সত্যিই তৈরি করে, তা হলে ক্ষমতার পৃথকীকরণের যে ব্যবস্থা সংবিধানে নির্দিষ্ট ভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে তা বিপর্যস্ত হবে। কারণ, সংসদের যেমন সার্বভৌম ক্ষমতা বা সরকারের নীতি প্রণয়ন ও কার্যকর করার দায়িত্ব রয়েছে, তেমনই বিচারব্যবস্থারও নিরপেক্ষবিচারের অধিকার রয়েছে। ইতিপূর্বে সর্বোচ্চ আদালত বিচারবিভাগীয় স্বাধীনতাবলে সংসদে তৈরি নানা আইন, এমনকি সংবিধান সংশোধনী আইনও খারিজ করে দিয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট একাধিক রায়ে ঘোষণা করেছে, সংসদ আইন প্রণয়ন করবে, সংবিধানও সংশোধন করবে— কিন্তু সংবিধানের মূল কাঠামোকে কোনও ভাবে পাল্টাতে পারবে না।
সংবিধানের মূল কাঠামো সম্পর্কে সর্বোচ্চ আদালত অনেকগুলি সাংবিধানিক বিধিব্যবস্থার দিঙ্নির্ণয়ও করছে। সুতরাং, কোনও প্রতিষ্ঠানেরই নিজস্ব লক্ষ্মণরেখা লঙ্ঘন আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মান্যতা পেতে পারে না।
কিন্তু দুর্নীতি? দুর্নীতির বিষয়ে শাসক, বিরোধী, আমলাতন্ত্র বার বার দেশের মানুষের নজরে এসেছে। অনেকে শাস্তিও পেয়েছেন। বিচারব্যবস্থায় কি দুর্নীতির ছায়া কখনও পড়েনি? আইনজগতের সঙ্গে যাঁরা দীর্ঘ দিন ধরে যুক্ত, তাঁরা বিস্তর অভিযোগ শুনেছেন। কিন্তু নানা বিধিনিষেধ ও আইনি-সাংবিধানিক জটিলতার কারণে সেই অভিযোগের হয়তো সুরাহা হয়নি। তবু সিজ়ারের পত্নীকেতো সন্দেহের ঊর্ধ্বে থাকতেই হবে।
সম্প্রতি জাস্টিস বর্মা-র বাসভবনের নোট-কাণ্ড প্রসঙ্গে এক বর্ষীয়ান স্বনামধন্য আইনজীবী মন্তব্য করেছেন, “সূর্যোদয়ই হচ্ছে একমাত্র জীবাণুনাশক।” অতএব প্রকৃত ঘটনার পর্দা ফাঁস হওয়া অবশ্যই জরুরি। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কেউ আইন ও বিচারের ঊর্ধ্বে নয়। কেন্দ্রীয় এজেন্সি ইতিমধ্যে জাস্টিস বর্মা-র যে সমস্ত ব্যক্তি বা চক্রের সঙ্গে যোগসাজশের ইঙ্গিত দিয়েছে বলে খবর বেরিয়েছে, তা যদি বিন্দুমাত্র সত্যি হয় তা হলে একটাই কথা বলার থেকে যায়— “মি লর্ড, অল ইজ় নট ওয়েল!”
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)