ইদানীং আমাদের দেশে কর্মসংস্কৃতি নিয়ে নানা মহলে আলোচনা বিতর্ক ইত্যাদি চলছে। ‘আলস্যজর্জর’ দেশে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে কেউ সপ্তাহে বাধ্যতামূলক সত্তর ঘণ্টা, কেউ নব্বই ঘণ্টা কাজের নিদান দিচ্ছেন। দেশ গঠনে শ্রমের অভ্যাস অবশ্যই জরুরি, কিন্তু কর্তব্য পালনের প্রেরণা বিনা কর্মে নিষ্ঠার অভাব থাকবেই। দেশাত্মবোধে পরিচালিত হয়ে কর্মপ্রেরণা লাভ করেন কোনও কোনও দেশের মানুষ। কিন্তু দেশভেদে কর্মাদর্শ ভিন্ন হয়। স্বামী বিবেকানন্দ অবশ্য এমন এক কর্মাদর্শ আমাদের উপহার দিয়েছেন যা কালোত্তীর্ণ এবং জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের গ্রহণযোগ্য।
আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, কর্ম আমাদের ক্লান্ত করে। হাপিত্যেশ করে বসে থাকি ছুটির জন্য। কারণ, আমরা আমাদের ক্ষুদ্র দৈহিক অস্তিত্ব অবলম্বন করে বেঁচে থাকি, জাগতিক কিছু প্রাপ্তির আশায় কাজ করি। কাজটি ভিতর থেকে কোনও প্রেরণা জোগায় না। স্বার্থবুদ্ধিতে করা কর্মে সুখের সঙ্গে দুঃখ আসবেই। স্বামী বিবেকানন্দের প্রচারিত কর্মাদর্শ আসলে তাঁর প্রধান আদর্শের এক রূপায়ণ পদ্ধতি। ভগিনী নিবেদিতাকে লেখা একটি চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেছেন, তাঁর লক্ষ্য মানুষের অন্তর্নিহিত ঐশী শক্তির বিকাশের উপায় নির্ধারণ। প্রতিটি মানুষের মধ্যেই অনন্ত শক্তি ও অনন্ত সম্ভাবনা— স্বামীজি ভারতীয় পরম্পরায় তাকে ‘দেবত্ব’ বা ‘ডিভিনিটি’ বলেছেন। বস্তুত মানুষের স্বরূপই তা-ই। কিন্তু জীবত্বের আবরণে তা ঢাকা। লোভ, ঈর্ষা, স্বার্থপরতা, ভোগলিপ্সা, হতাশা অতিক্রম করে আত্মশ্রদ্ধা, আত্মবিশ্বাস, পবিত্রতা, নিঃস্বার্থপরতা, পরহিতে তৃপ্তিবোধ ইত্যাদি গুণাবলি বা দেবত্ব প্রকাশের উপায়ের গোড়ার কথা: দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন।
কর্ম করতেই হয়, না করে কেউ থাকতে পারে না। আমার কর্ম তখনই দেবত্ব বিকাশের সহায়ক হবে, যখন তা পূজা জ্ঞানে করব। ভারতীয় অধ্যাত্মবিজ্ঞানীদের আবিষ্কার: অদ্বিতীয় এক চৈতন্যসত্তাই নানা ভাবে নানা রূপে বর্তমান। এক, বহু হয়েছেন: ‘বহুরূপে সম্মুখে’। বহুরূপে সম্মুখে যাঁরা, তাঁদের জন্য কিছু করা— দয়া দেখিয়ে বা দায়সারা ভাবে নয়, ভালবাসা-মিশ্রিত সেবা বা পূজার ভাবে। উপাসনালয়ে আমরা শ্রদ্ধা-ভক্তির সঙ্গে নানা উপচার ঈশ্বরকে নিবেদন করি। ঠিক তেমনই, বিবেকানন্দের আহ্বান— অন্ন-বস্ত্র-ওষুধ-পথ্য ও বিদ্যা উপচার দিয়ে দরিদ্রনারায়ণ, রোগীনারায়ণ, ছাত্রনারায়ণদের সেবা করতে হবে। কর্ম তখন ধর্ম বা পূজায় রূপান্তরিত হবে। এ ভাবেই স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, বাড়ি, সরকারি-অসরকারি অফিস, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান— সর্বত্রই বহু রূপে বস্তুত ‘এক’-এর পূজা-উপাসনা হবে। উপচার ভিন্ন ভিন্ন।
মূল কথা: মানসিকতা বা ভাবের শুদ্ধি। উপাসনালয়ে পূজক আপাতভাবে কর্মই করেন। মন্ত্রোচ্চারণ, আরতি, নৈবেদ্য প্রদান ইত্যাদি সবই তো কাজ। তবু এগুলিকে পুজো বলে অভিহিত করা কেন? কারণ, মন তখন আধ্যাত্মিক ভাবাশ্রিত। অন্য দিকে, বাজার করা বা ছাত্র পড়ানোকে নেহাত এক ঐহিক কাজ বলে ভাবা হয়। আসলে এ দৃষ্টিভঙ্গিরই পার্থক্য। অনেকের কাছেই এই কাজগুলিও পূজা। এই পূজায় পূজকের কী লাভ? তাঁর অন্তর্নিহিত ঐশী শক্তির যেমন প্রকাশ হবে, একই সঙ্গে বহুরূপে সম্মুখে যাঁরা নানা উপচারে পূজিত হচ্ছেন, তাঁদের আত্মপ্রকাশের বাধাও অপসারিত হবে।
স্বামী বিবেকানন্দের এই কর্মাদর্শ কী ভাবে অভ্যাস করা যাবে? যখন যা করব তা পুরো মন দিয়ে: দায়সারা বা গয়ংগচ্ছ ভাব যেন না থাকে। জাগতিক বা পারমার্থিক, প্রতিটি কাজের সাফল্য নির্ভর করে মনের একাগ্রতায়। তিনি কর্মযোগ-এ বলেছেন, সম্পূর্ণ মন দিয়ে কাজ করলে মনের বিক্ষেপ ও চঞ্চলতা দূর হয়। মনের চঞ্চলতা দূর হলে চিত্তশুদ্ধি, চিত্তশুদ্ধি হলেই অন্তর্নিহিত সত্য বা দেবত্বের প্রকাশ স্বতঃসিদ্ধ। দ্বিতীয়ত, স্বামীজির ভাষায় ‘ওয়ার্ক থ্রু ফ্রিডম, ওয়ার্ক থ্রু লাভ’। স্বাধীন ভাবে, ভালবাসার সঙ্গে কাজ করলে কাজের গুণগত মান বাড়বে, হতাশা দুঃখ স্পর্শ করবে না। শুধুই টাকার রসে সিঞ্চিত কাজ প্রেরণাবোধ জোগাতে পারে না।
সেবায় প্রত্যাশা বা প্রতিদানের আশা যেন না থাকে। স্বার্থ-অভিসন্ধি রহিত কাজে শুধুই আনন্দ: স্বার্থ নেই, আসক্তি নেই, ফলে অশান্তিও নেই। বিবেকানন্দ বলেছেন, মানুষ মূর্খের মতো মনে করে যে সে স্বার্থপর উপায়ে নিজেকে সুখী করতে পারবে; বহুকাল চেষ্টার পর অবশেষে বুঝতে পারে, প্রকৃত সুখ স্বার্থপরতা নাশে। তাঁর মতে, যদি কেউ পাঁচ দিন বা পাঁচ মিনিটও কোনও স্বার্থ-অভিসন্ধি ছাড়া কাজ করতে পারে, তার মধ্যে শক্তিমান মহাপুরুষ হওয়ার সামর্থ্য আছে।
যাঁর সেবা করছি, তাঁর মধ্যে ‘পরম’-এর উপস্থিতি অনুভব করার চেষ্টা করতে হবে। সেবা-পূজার সুযোগ লাভে সেবকও ধন্য, সেব্যও— এ এক অনন্য ধারণা, দুই পক্ষেরই উত্তরণ ঘটে যেখানে। স্বামী বিবেকানন্দের এই কর্মাদর্শ ব্যবহারিক ও আধ্যাত্মিক জীবনের মধ্যে কাল্পনিক ভেদরেখা মুছে দেয়। বুঝিয়ে দেয়, উপাসনালয়ে পূজা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাস, হাসপাতালে রোগীর শুশ্রূষা, অফিসে ফাইল দেখার মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। আমরা আর কবে বুঝব?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy