হোয়াইট হাউসে দ্বিতীয় অবতারে অধিষ্ঠিত হওয়ার আগেই ডোনাল্ড ট্রাম্পের শ্রীমুখ থেকে ডাইনে-বাঁয়ে স্বভাবসিদ্ধ গোলাগুলি নিক্ষিপ্ত হয়ে চলেছে। যেমন, মেক্সিকো উপসাগরের নাম পাল্টে তিনি নাম রাখবেন আমেরিকা উপসাগর, কানাডাকে অর্থনৈতিক চাপ দিয়ে আমেরিকার ৫১ নম্বর প্রদেশে পরিণত করা যেতে পারে, পানামা ক্যানালের নিয়ন্ত্রণ পানামার হাত থেকে ফিরিয়ে নেওয়া দরকার, গ্রিনল্যান্ডের দখল নেওয়ার জন্য সামরিক শক্তি প্রয়োগ না-করার কোনও প্রতিশ্রুতি তিনি দিতে পারছেন না। এক দশক আগে তাঁর বাগ্ধারায় চমৎকৃত দুনিয়ার মানুষ ভেবেছিলেন: মহাশয় কি সত্যই এমনধারা, না কেবল মিচকেমি করেন? আজ আর সেই বিস্ময়ের কোনও অবকাশ নেই। সবাই জানে, এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও জানেন যে সবাই জানে, তাঁর কথামালা সত্যাসত্যের হিসেবের বাইরে এক বহুমুখী রণকৌশল। তার কোনওটা অর্ধসত্য, কোনওটা সিকি-মিথ্যে, কোনওটা নিছক লোকের নজর ঘুরিয়ে দেওয়ার ছল, কোনওটা আবার দর-কষাকষির অস্ত্র— প্রতিপক্ষকে সর্বনাশের ভয় দেখিয়ে আধখানা আদায় করে নেওয়ার সুচতুর পরিকল্পনা।
গ্রিনল্যান্ডের ব্যাপারটাই ধরা যাক। আয়তনে মেক্সিকোর থেকে বড়, শতকরা ৮০ ভাগ বরফের চাদরে ঢাকা, হাজার ষাটেক অধিবাসী— চাদর এবং লোকসংখ্যা দুইই অবশ্য ক্রমশ হালকা হচ্ছে। গত দুই শতাব্দী যাবৎ প্রায় একটানা ডেনমার্কের নিয়ন্ত্রণে আছে দুনিয়ার এই বৃহত্তম দ্বীপভূমি, তবে ক্রমশ স্থানীয় মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রসারিত হয়েছে, ২০০৯ সাল থেকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আনুষ্ঠানিক স্বশাসন, পূর্ণ স্বাধিকারের কথাও চলছে। ভূগোলের বিচারে এই ভূখণ্ড উত্তর আমেরিকার ঘনিষ্ঠ, কিন্তু হাজার বছর ধরে ইউরোপের সঙ্গে তার সংযোগ। আমেরিকান রাষ্ট্রনেতারা অতীতে বার বার গ্রিনল্যান্ডের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ চেয়েছেন, কিন্তু ইতিহাস ভূগোলকে হারিয়ে দিয়েছে। এ-যাবৎ।
ডোনাল্ড ট্রাম্প সেই ইতিহাস পাল্টাতে চান। আমেরিকাকে আবার মহান বানানোর ‘মাগা’ নামক ব্রত পালনের প্রথম পর্বেই, ২০১৯ সালে তিনি ডেনমার্কের কাছে গ্রিনল্যান্ড কিনে নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। শুনে ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট নিশ্চয়ই ঠাট্টা করছেন। অতঃপর ট্রাম্প তাঁর ডেনমার্ক সফর বাতিল করেন। চাপ রাখতে? রাগ দেখাতে? না কি, অপমানের জ্বালায়? হতেই পারে। তাঁর কাছে ব্যবসা স্বর্গ, ব্যবসা ধর্ম। ওই প্রস্তাবের বছরখানেক পরে তিনি জানিয়েছিলেন, গ্রিনল্যান্ডের ব্যাপারটা তাঁর কাছে জমি-বাড়ি কেনাবেচার মতোই— একটা কর্নার প্লট দেখে তাঁরা যেমন ভাবেন, তাঁদের নতুন রিয়েল এস্টেট প্রকল্পের জন্য ওই জমি হাতে পাওয়া দরকার, ‘এটাও তার থেকে খুব একটা আলাদা কিছু নয়’। এমন এক মহান বাণিজ্যিক পরিকল্পনাকে ‘ঠাট্টা’ বলে উড়িয়ে দিলে প্রকৃত বণিকের আঁতেঘা লাগা অস্বাভাবিক নয়।
কিন্তু রাগ, দুঃখ, অপমান, এ-সব নিয়ে প্রকৃত বণিক বসে থাকতে পারে না। অতএব খেলায় ফিরে এসে ট্রাম্প অসমাপ্ত কাজে নেমে পড়তে চান। তাঁর সাফ কথা: আমেরিকার অর্থনীতি এবং প্রতিরক্ষার স্বার্থে গ্রিনল্যান্ড অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তার উপর নিয়ন্ত্রণ চাই, এ ব্যাপারে চাওয়া-পাওয়ার বিবাদভঞ্জনের জন্য দরকার হলে— ঠাস ঠাস দ্রুম দ্রাম। না, সত্য সত্যই কাল বাদে পরশু গ্রিনল্যান্ডের দখল নেওয়ার জন্য আমেরিকা তার নেটো-সঙ্গী ডেনমার্কের সঙ্গে যুদ্ধে নামতে যাচ্ছে না। কিন্তু এই হুমকিকে অর্থহীন গলাবাজি বলে উড়িয়ে দিলেও মস্ত ভুল হবে। এতদ্দ্বারা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শুরুতেই একটি কথা বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন। সেটা হল, উত্তরের ওই ভূখণ্ডে প্রবলতর ভূমিকা দখলের জন্য আমেরিকা এ-বার অনেক বেশি চাপ দেবে। অর্থনীতি এবং প্রতিরক্ষার স্বার্থেই চাপ বাড়ানো জরুরি।
কেন? অনেক কারণে। প্রথমত, প্রতিরক্ষার আয়োজন এখন উপগ্রহ-প্রযুক্তির উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল, সেই প্রযুক্তির প্রয়োগভূমি হিসেবে মেরু অঞ্চলের গুরুত্ব অপরিসীম। লক্ষণীয়, গ্রিনল্যান্ডের জমিতেই আছে পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তরে থাকা আমেরিকান বিমানঘাঁটি— তার ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ শক্তির এক অপরিহার্য প্রকরণ। দ্বিতীয়ত, এই অঞ্চলের সামুদ্রিক বাণিজ্যপথ প্রতিরক্ষা এবং অর্থনীতি, দু’দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ। বরফ যত গলবে, এই পথের গুরুত্ব তত বাড়বে। মনে রাখা দরকার, ওই অঞ্চলে এ ব্যাপারে ট্রাম্পের থেকে যিনি বিস্তর এগিয়ে আছেন তাঁর নাম ভ্লাদিমির পুতিন। বিশেষত, মেরুসমুদ্রে বরফের অতিকায় চাঁই ভেঙে বাণিজ্য-জাহাজের পথ কেটে এগোতে হলে যে বিপুলায়তন ও ব্যয়বহুল ‘আইসব্রেকার’ দরকার হয়, রাশিয়ার হাতে তার সম্ভার বহুগুণ বেশি, আমেরিকা সম্প্রতি পাল্লা দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে বটে, কিন্তু ফল পেতে সময় লাগবে। তৃতীয়ত, গ্রিনল্যান্ডের ভূগর্ভে— জমাট বরফের নীচে— প্রোথিত আছে ইট্রিয়াম বা স্ক্যান্ডিয়াম-এর মতো নানান ‘রেয়ার আর্থ’, লিথিয়াম, জ়িরকোনিয়াম ইত্যাদি পদার্থ এবং ইউরেনিয়াম। বরফ যত গলবে ততইসেই খনিজ ভান্ডার নাগালে আসবে। বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারি এবং পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনের এমন সব কাঁচামাল যে ভূমিতে মজুত আছে, তার অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক গুরুত্ব বলে বোঝানোর দরকার হয় না। এবং এ ক্ষেত্রেও প্রতিযোগিতা কম নয়— বিশেষ করে ‘রেয়ার আর্থ’ গোত্রের অনেকগুলি পদার্থের প্রায় একচেটিয়া মালিকানা আছে চিনের হাতে। অন্য দিকে, বরফের নীচে বড় মাপের পেট্রলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাসের ভান্ডার থাকার সম্ভাবনাও আছে, বরফ যত গলবে ততই সেই ভান্ডার নাগালে আসবে।
‘বরফ যত গলবে’— কথাটা যে বার বার ফিরে আসছে, তার একটি বিশেষ কারণ আছে। সেটা এই গ্রহের পক্ষে বিরাট ভয়ের কারণ, উদ্বেগেরও। পৃথিবীর তাপমাত্রা সবচেয়ে বেশি বাড়ছে উত্তরমেরু অঞ্চলে, যার পরিণামে এখন গ্রিনল্যান্ডের ‘চিরতুষার’ ক্ষয়ে ক্ষয়ে বছরে গড়ে হারিয়ে যাচ্ছে ২৭০০০ কোটি টন জল, আন্টার্কটিকার তুষার-ক্ষয়ের থেকে ৮০ শতাংশ বেশি। বেলাগাম বিশ্ব উষ্ণায়নের তাড়নায় এই ক্ষয়ের মাত্রা দ্রুত বেড়ে চলার আশঙ্কা প্রবল। এবং, একটা ‘টিপিং পয়েন্ট’ বা ক্রান্তি-বিন্দুতে পৌঁছনোর পরে সেই মাত্রা আপনবেগে পাগলপারা হয়ে যেতে পারে, যার কোনও পূর্বাভাস সম্ভবই নয়। এমনও হতে পারে যে আগামী দশকের শেষে গ্রিনল্যান্ডে চিরতুষার বলে আর কিছু থাকবে না! বলা বাহুল্য, এই প্রক্রিয়ার পরিণামে দুনিয়া জুড়ে সমুদ্রের জলস্তর বাড়ছে, বিপন্ন হচ্ছে উপকূলবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকা, আমাদের সাধের কলকাতা যার অন্তর্গত। তার পাশাপাশি সামুদ্রিক তরঙ্গের চেহারা-চরিত্র পাল্টে যাওয়ার ফলে বিশ্বের নানা অঞ্চলে জলবায়ুর আকস্মিক পরিবর্তন ঘটতে পারে। নানা দিক থেকে সর্বনাশের শঙ্কা উত্তরোত্তর ঘোরতর হচ্ছে।
এবং তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রবলতর হয়ে উঠছে সর্বগ্রাসী ‘সমৃদ্ধি’র সুবর্ণসুযোগ। বাণিজ্যের সমৃদ্ধি। মুনাফার সমৃদ্ধি। পুঁজির সমৃদ্ধি। মেরুপ্রদেশের বরফ যত গলবে, নতুন বাণিজ্যের জলপথ ততই খুলে যাবে, তার ফলে ব্যবসার খরচ কমবে। অন্য দিকে, এত দিন যে বিপুল মহামূল্যবান ও মহাশক্তিধর প্রাকৃতিক সম্পদ কঠিন তুষারের নীচে কঠিন ঘুমে অচেতন ছিল, তাকে তুলে এনে বাজারের পণ্যে পরিণত করা ক্রমশই সহজ এবং আরও সহজ হয়ে উঠবে। এখানেই গ্রিনল্যান্ড নামক কর্নার প্লটের অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ। ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর নিজস্ব ভাষায় সেই স্বর্ণভান্ডারের দখল নেওয়ার কথা বলেছেন, কিন্তু তাকে সাম্রাজ্য বিস্তারের পুরনো ছকে ফেলে দেখলে ভুল হবে। যে সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হতে চান তিনি এবং তাঁর সঙ্গীরা, তার নাম পুঁজির সাম্রাজ্য। এই গ্রহের যা কিছু পদার্থ (মানুষ-সহ) মুনাফা অর্জনের কাজে অর্থাৎ পুঁজির ভান্ডার সমৃদ্ধ করার কাজে লাগতে পারে, তার দখল নেওয়াই ভান্ডারিদের লক্ষ্য। সেই দখলদারির লড়াই চলছে পৃথিবী জুড়ে, বস্তুত পৃথিবী ছাড়িয়ে মহাকাশে তা প্রসারিত হয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প এই সত্যটিকে নিরাবরণ করে দিয়েছেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ দোসর ইলন মাস্ক সেই সত্যের প্রতিমূর্তি। গ্রিনল্যান্ডের প্রাকৃতিক সম্পদ তাঁর বৈদ্যুতিক গাড়ি এবং মহাকাশযান-সহ নানা ব্যবসার প্রয়োজনে অমূল্য সম্পদ, সুতরাং ট্রাম্পের নির্বাচনী সাফল্যে তিনি পরম উল্লাসে দু’হাত তুলে নৃত্যরত। এই উল্লাস সর্বগ্রাসের।
সর্বগ্রাসের উল্টো পিঠেই আছে সর্বনাশ। সমস্ত গ্রহটাকে ব্যবসার কাঁচামাল বানিয়ে তোলার যে দুর্নিবার অভিযান, তার পরিণামেই, কেবল উষ্ণায়ন নয়, বিশ্বের প্রকৃতি-পরিবেশ সমস্ত দিক থেকে বিপর্যয়ের কবলে পড়েছে। ‘চরম আবহাওয়া’র দুর্লক্ষণগুলি প্রতিনিয়ত প্রকট হয়ে উঠছে দুনিয়া জুড়ে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের আপন দেশে সাম্প্রতিক দাবানলের মাত্রা কেবল অভূতপূর্ব নয়, অকল্পনীয়। কিন্তু তাই বলে কি কাঁচামাল কাঁচাই রেখে দেওয়া হবে? মুনাফার সেবায় লাগবে না? পৃথিবী উষ্ণতর হোক, প্রলয়পয়োধিজলে ভেসে যাক জীবন ও জীবিকা, অগ্নিবলয় গ্রাস করুক তারকাদের কতিপয় প্রাসাদ এবং আমজনতার অগণন বাসস্থান, কর্নার প্লট তো আর ছেড়ে দেওয়া যায় না!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy