ছোটবেলায় একটা মজার ছড়া শুনেছিলাম— কলকাতায় পড়তে যাওয়া ছেলে বাবাকে চিঠি লিখছে, ‘টাকা নাই, টাকা চাই; ইতি, কানাই’! আজ প্রায় সেই সুরেই গোটা সুন্দরবন যেন সরকারকে বলছে, ‘বাঁধ নাই, বাঁধ চাই; ইতি, সবাই’।
ইয়াস-পরবর্তী সুন্দরবনে গত দু’মাস যাবৎ বার বার যাতায়াতের সূত্রে দেখা যে, মৌসুনি থেকে ঘোড়ামারা, জি প্লট থেকে কুমিরমারি, বাঁধ-ভাঙা জলে-ডোবা ছবিটা কম-বেশি একই রকম। দাবিটাও এক— ‘সুন্দরবন বাঁচাতে কংক্রিট বাঁধ চাই’। ‘কংক্রিট’ শব্দটা সুন্দরবনের সাধারণ মানুষ মূলত ব্যবহার করছেন স্থায়ী বাঁধের প্রয়োজন বোঝাতে। এ দাবি প্রথম ওঠে ২০০৯ সালে, যখন আয়লা সাইক্লোনের সময় ঠিক ইয়াসের মতোই প্রবল ঝড়, উত্তুঙ্গ জোয়ার আর পুবালি হাওয়ার ত্র্যহস্পর্শে সুন্দরবনের প্রায় হাজার কিলোমিটার বাঁধ তাসের ঘরের মতো ভেঙে গিয়েছিল।
এটা স্পষ্ট যে, রাজ্য সরকার আগামী দিনে সুন্দরবনকে বাঁচাতে ম্যানগ্রোভকেই পাখির চোখ করেছে। কোটি কোটি ম্যানগ্রোভ লাগানোর পরিকল্পনার পাশাপাশি একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি তৈরি হয়েছে— কী রকম ম্যানগ্রোভ ও অন্যান্য উদ্ভিদের ঢাল তৈরি করলে মাটির বাঁধগুলিকে বাঁচানো যাবে, তার প্রেসক্রিপশন দিতে। সুন্দরবনে ঝড় ও বন্যা আটকাতে ম্যানগ্রোভ বা বাদাবন যে একটি অত্যন্ত জরুরি ভূমিকা পালন করে, তা কোনও নতুন কথা নয়; কিন্তু পাশাপাশি এ কথাটা স্পষ্ট করে বলা ও বোঝা দরকার যে, শুধু ম্যানগ্রোভ বা বাদাবন দিয়ে সুন্দরবনকে বাঁচানো যাবে না— ম্যানগ্রোভ সমাধানের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ; সমাধান নয়।
যদি হত, তবে জম্বুদীপ, ডালহৌসি, বুলচেরি বা ভাঙাদুয়ানির মতো মানুষের প্রায় পা-না-পড়া ম্যানগ্রোভ দ্বীপগুলি গত পঞ্চাশ বছরে কোথাও পাঁচ ভাগের এক ভাগ তো কোথাও অর্ধেকের কম হয়ে যেত না। এও মনে রাখতে হবে যে, সুন্দরবনে বহু অঞ্চলে ম্যানগ্রোভ লাগানোর বিশেষ জায়গা নেই, বিশেষ করে এর পশ্চিমাংশে; যেখানে বিধ্বংসী সাইক্লোনগুলি ইদানীং ঝাঁপিয়ে পড়ছে। আর লাগানোও যদি হয়, তবে বেশ কয়েক বছর লাগবে সেই ম্যানগ্রোভের ঝড় ও বন্যা সামলানোর মতো শক্তি অর্জন করতে। আমপানের পর ‘লাগানো’ পাঁচ কোটি ম্যানগ্রোভের ইয়াসের সময় করা ফ্লপ পারফর্ম্যান্স তারই প্রমাণ। প্রসঙ্গত, জাপান থেকে শুরু করে এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের অভিজ্ঞতা থেকে বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন যে, ম্যানগ্রোভ দিয়ে বাঁধ তৈরিতে প্রচুর অর্থ ব্যয় হলেও অনেক ক্ষেত্রেই সেই ম্যানগ্রোভ বাঁচছে না, এবং বাঁধের দীর্ঘমেয়াদি সাফল্য প্রশ্নের মুখে পড়ছে।
এটাও খেয়াল রাখা প্রয়োজন যে, এক দিকে যখন রাজ্য প্রশাসন— স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী— কোটি কোটি টাকা খরচ করে ম্যানগ্রোভ লাগানোর কথা বলছেন, তখন পাশাপাশি গোটা সুন্দরবনে যত্রতত্র ম্যানগ্রোভ কাটা চলছে, বহু ক্ষেত্রেই ছোট-বড় রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনিক কর্তাদের প্রশ্রয়ে বা প্রত্যক্ষ মদতে। মৌসুনি দ্বীপের বালিয়ারার মতো বিপন্ন অঞ্চলে সরকারি জমিতে অজস্র গাছ সাবাড় করে যাবতীয় নিয়ম ভেঙে গড়ে উঠেছে অজস্র বেআইনি হোটেল; গোসাবার বালি দ্বীপের মতো বিপন্ন অঞ্চলে নদীর ধারের ম্যানগ্রোভ জঙ্গল ফাঁকা করে চলেছে বিশাল হোটেল বানানোর পর্ব।
আয়লার পর প্রধানমন্ত্রীর দফতর ৭৭৮ কিলোমিটার বিশেষ ধরনের বাঁধ, যার পোশাকি নাম আয়লা বাঁধ, তৈরির জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকারও বেশি বরাদ্দ করে। বিশেষ ধরনের বাঁধ অর্থে মাটির উপরে ইট বা কংক্রিটের আস্তরণ; সঙ্গে বড় ঢাল, যাতে স্রোতের ধাক্কাকে সামলানো যায়; বাঁধের দু’পাশে ম্যানগ্রোভের সারি। এখন অবধি মাত্র ৮৪ কিলোমিটার আয়লা বাঁধ তৈরি হয়েছে— কেন্দ্রীয় বরাদ্দের পাঁচ ভাগের চার ভাগই ফেরত চলে গেছে। কিন্তু আয়লা বাঁধ যে কতটা কার্যকর, তা প্রমাণ হয়েছে ইয়াসের সময়, যখন প্রায় দু’শোটি জায়গায় মাটির বাঁধ ভাঙলেও আয়লা বাঁধ অক্ষত থেকেছে; যদিও কোথাও কোথাও জলোচ্ছ্বাস বাঁধ টপকে দ্বীপে ঢুকে পড়েছে। কোনও অঞ্চলে জমির অভাব হলে অন্য পদ্ধতি ভাবতে হবে, কিন্তু আয়লা বাঁধই আপাতত সুন্দরবন বাঁচানোর প্রধান ওষুধ।
এমন বাঁধ তৈরি শুরু করতে হবে সবচেয়ে বিপন্ন অঞ্চলগুলি থেকে। পাশাপাশি পরিবেশসম্মত পর্যটন, স্থানীয় প্রাকৃতিক সম্পদভিত্তিক শিল্প, প্রতি বাড়িতে পাকা ছাদযুক্ত অন্তত একটা উঁচু ঘর, কৃষি বিমার ব্যবস্থা ইত্যাদির মাধ্যমে স্থানীয় পরিবারগুলির আর্থ-সামাজিক উন্নতি ঘটাতে হবে। সুন্দরবনের মতো অঞ্চলে বার বার বিপর্যয় আসবেই; কিন্তু চ্যালেঞ্জটা হল এক দিকে বাঁধ, ম্যানগ্রোভ দিয়ে ঝড়, বন্যার তাণ্ডবকে যতটা সম্ভব সামলানো; অন্য দিকে, মানুষের আর্থিক ক্ষমতা বাড়িয়ে আগামী বিপর্যয়গুলির সঙ্গে আরও ভাল ভাবে যুঝতে পারার বন্দোবস্ত করা। কিন্তু এই লড়াইয়ে আয়লা বাঁধকেই সেনাপতির সম্মান দিতে হবে।
প্রশ্ন উঠছে, সুন্দরবন জুড়ে এমন বাঁধ বানাতে যে পঁচিশ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন, তা আসবে কোথা থেকে। এক দশক আগে পাঁচ হাজার কোটি টাকা দেওয়া কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে এখন পঁচিশ হাজার কোটি টাকার দরবার করা অপ্রাসঙ্গিক নয়। পাশাপাশি গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে দরবার করা যেতে পারে সাহায্যের জন্য, কেননা, এ নিয়ে তর্কের অবকাশ নেই যে, বিশ্বজোড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই আজ সুন্দরবন অস্তিত্বের সঙ্কটে। টাকার সংস্থান করার উপায় একটা বার করতে হবে, কিন্তু কিছুতেই গোড়ার গল্পে বলা কানাইয়ের বাবার মতো উত্তর দেওয়া যাবে না— ‘টাকা সাফ, কর মাফ; ইতি বাপ’। কেননা সুন্দরবনের সুরক্ষার উপর নির্ভর করছে ওখানকার মানুষ ও না-মানুষ অধিবাসীদের অস্তিত্বের পাশাপাশি কলকাতা সমেত দক্ষিণবঙ্গের কোটি কোটি মানুষেরও ভবিষ্যৎ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy