E-Paper

যাঁরা দেশহীন হয়ে গেলেন

অসমের মাটিতে বহু কষ্টে তিলে তিলে টাকা জমিয়ে সাধের পাকা বাড়ি তৈরি। হঠাৎ এক দিন সেখানে এসে পড়ল নোটিস— ঘর ছাড়ার। বাংলাভাষী মুসলিমদের কপালে জুটল বাংলাদেশির ছাপ্পা!

রাজীবাক্ষ রক্ষিত

শেষ আপডেট: ২১ মার্চ ২০২৫ ০৭:১৯
Share
Save

মানুষগুলোরই মতো, প্রশ্নগুলো খুব সহজ। কিন্তু জবাব মেলা জটিল, ঠিক যতটা জটিল তাঁদের ঘিরে এই রাজনীতির খেলা।

গ্যাস ওভেনে আঁচ জোগাচ্ছে মোবাইলের চার্জার। আলিমার সংসার ওই রান্নাঘরটুকু নিয়েই। কচুতলির সাবেক পাড়া এখন হরপ্পার নকশার মতো উপুড় হয়ে পড়ে আছে ঘাসের কাঁথায়। ছলছলে দিগারু নদী বয়ে চলেছে গেঁয়োপথের পাশে। ক’দিন আগেও সেই রাস্তা বরাবর রমরমিয়ে চলত তিন-তিনটে স্কুল। ও-পারে চাষের জমিতে হাওয়ার সঙ্গে খুনসুটি চলত সর্ষে, ধান, আনাজ খেতের।

অসমের মাটিতে বহু কষ্টে তিলে তিলে টাকা জমিয়ে সাধের পাকা বাড়ি তৈরি। হঠাৎ এক দিন সেখানে এসে পড়ল নোটিস— ঘর ছাড়ার। বাংলাভাষী মুসলিমদের কপালে জুটল বাংলাদেশির ছাপ্পা! পথের ভিড় আঙুল তুলে বলে দিল, ‘বাংলাদেশি’! ছুটে এল টিভি চ্যানেল। খবরে দেখানো হল, ‘অসমের জমিতে বাংলাদেশিদের দখলদারি!’ শুরু হল মারধর। কিছু দিনের মধ্যেই সরকারি কাগজ জানিয়ে দিল, এত বছরের বাসস্থানে তাঁদের অধিকার নেই। জমি ট্রাইবাল বেল্টের অধীনে পড়ে। ওই এলাকা শুধুই জনজাতির মানুষদের জন্য সংরক্ষিত। ১৯২৩-২৮ সালের জমির পাট্টা যাঁদের রয়েছে, তাঁরা বাদে কেউ থাকতে পারবেন না সেখানে।

তবে যে তাঁরা বিস্তর টাকা দিয়ে জমি কিনেছেন আর পাট্টা পেয়েছেন, কী মানে তার? সরকার যে দিয়েছে জলের লাইন, বিদ্যুতের লাইন, নিয়েছে খাজনা? এমনকি প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় দেওয়া হয়েছে একের পর এক বাড়ি। তা হলে? সরকার জানিয়ে দেয়, অতীত খুঁচিয়ে লাভ নেই। হাতে সময় তিন দিন।

সব কাজ নিখুঁত ভাবে সম্পন্ন করল এক্সক্যাভেটর, বুলডোজ়ারের দল। ছারখার হয়ে গেল অন্তত ১৮২টি পরিবার। হাতছাড়া হয়ে গেল ১০০ বিঘার উপরে জমি। অথচ একই ট্রাইবাল বেল্টে থাকা হিন্দুদের ঘরবাড়ি বেঁচেবর্তে থাকল বহাল তবিয়তে! রক্তজল করা টাকায় বানানো দোতলা বাড়ির গুঁড়িয়ে যাওয়া আসনে বসে মুখের কথা হারিয়ে যায়। শোনা যায়, ঘটনার কয়েক দিন পরে সরকারি ঘোষণায় বলা হয়েছিল, উচ্ছেদ হওয়া কারও ভোটাধিকার থাকবে না। সম্প্রতি প্রকাশিত চূড়ান্ত ভোটার তালিকায় সত্যিই নাম নেই কচুতলির সিংহভাগ সংখ্যালঘুর। বলা হয়েছে, যার যেখানে আসল বাড়ি সেখানে যাও, ভোটার তালিকায় নাম তোলো!

এখানকার অধিকাংশ মানুষেরই জমি তলিয়ে গিয়েছে ব্রহ্মপুত্রে। ১৯৮০-র দশকে এখনকার বাসিন্দাদের বাবারা এই এলাকায় এসে মুসলিম মালিকদের থেকেই জমি কিনে থাকা শুরু করেন। এখন তাঁদের ক্ষোভ, তদানীন্তন কংগ্রেস সরকার যদি জানাত এই জমি কেনাবেচা বেআইনি, তা হলে এত টাকায় অবৈধ জমি না কিনে তখনই অন্যত্র চলে যেতেন। বদলে ভোটব্যাঙ্ক তৈরির সরকারি শতরঞ্জে সহজবধ্য বোড়ের মতোই ব্যবহৃত হলেন তাঁরা।

এক সময় সংখ্যালঘু হয়েও বিজেপির হয়ে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন শিক্ষিত যুবক মোকাদ্দাস। কচুতলি বাজারে ছিল তাঁর ওষুধের দোকান, ছিল ৩০ বিঘা জমি। তিনি আজ সর্বহারা। মোটরসাইকেলের ঋণের কিস্তি জমা দিতে পারেননি কয়েক মাস। বললেন, “পরিস্থিতি এমন যে, তিন বার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারিনি। এখন তাই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি আদালতে। ৪৮ জন মিলে মামলা তুলেছি সুপ্রিম কোর্টে। সেখানে স্থগিতাদেশ দিয়েছে, আপাতত আমাদের সরানো যাবে না শিবির থেকে। কিন্তু সরকার এসে নিত্য হুমকি দিয়ে যাচ্ছে।”

স্থানীয় মসজিদ ও মাদ্রাসায় চলেনি বুলডোজ়ার। তাই সেখানেই মাথা গুঁজেছেন বহু পরিবার। কুরবান আলি, আইনুল সরকার, ইমান আলিরা তড়িঘড়ি পেতে দেন বেঞ্চ। সাংবাদিক দেখে জড়ো হয়ে যায় বড়সড় ভিড়। জানালেন, এই প্রথম কেউ তাঁদের কথা শুনতে এসেছেন। হাতে-হাতে সরকারি কাগজ। কোনওটা ভোটার পরিচয়পত্র, কোনওটা আধার, কোনওটা এনআরসিতে নাম থাকার প্রমাণ। জানা গেল, হঠাৎ করে দেশহীন হয়ে গেলেও এনআরসি প্রক্রিয়াতে কিন্তু এখানকার সকলেরই নাম উঠেছে!

বিঘার পর বিঘা জমি জেসিবি চালিয়ে তছনছ করে দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার শতাধিক বাড়ি ভাঙা হয়েছে। সরকারের তরফে দাবি করা হচ্ছে, ওঁদের সকলের অন্যত্র জমি রয়েছে। কিন্তু ওঁরা জানেন না সেই জমির ঠিকানা। চলতি বিধানসভায় সংখ্যালঘু বিধায়করা সরকারের কাছে অনুরোধ রেখেছেন, ন্যূনতম মানবিকতা দেখানো হোক গরুখুঁটি, কচুতলির মতো এলাকার উচ্ছেদ হওয়া মানুষদের প্রতি। তাঁদের কেউ বাংলাদেশি নন। অন্তত বিকল্প মাথা গোঁজার ঠাঁই দিয়ে ভাঙা হোক জবরদখল। কিন্তু শাসনযন্ত্র অনড়।

কচুতলি জুড়ে এখন শুধুই প্রশ্নের ভিড়। উত্তরহীন সব প্রশ্ন। কী দোষে আমরা ঘরছাড়া? সব প্রমাণ থাকার পরেও কেন আমরা ভোটাধিকারহীন? যদি আমরা নাগরিকই নই, তবে কী ভাবে এনআরসিতে নাম উঠল? আমরা এখন কোথায় যাব? আমাদের বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ কী?

বেলা পড়ে আসে। মায়াবী আলো হাত বোলাতে থাকে ভিটে-মাটির ধ্বংসস্তূপে। একটা-দুটো করে তারা ফোটে আকাশে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Assam Pradhan Mantri Awas Yojana

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।