সততই সুখের নয় স্মৃতি। ফলে অতীতের স্মৃতি সুযোগ পেলেই অনুপ্রবেশ করে, অনুপ্রবেশকারীদের মতনই সুখের স্মৃতিকে ভেঙে দেয় অকস্মাৎ। পেশার কাজে এখন মাঝে-মধ্যে গুজরাতের দহেজ যেতে হয়। মধ্য ভারতের পবিত্র নদী নর্মদা যেখানে মিলিত হচ্ছে কচ্ছ উপসাগরে। পেট্রোরসায়ন শিল্পের নতুন কেন্দ্র দহেজ, কচ্ছ উপসাগরের কূলে বালিয়াড়ি, কিছু ঝোপঝাড়, সামান্য কিছু বাদাবন আর রুক্ষ জমি। সেখানেই শুরু হয়েছিল ভারত সরকারের পেট্রোরসায়ন কারখানা পরে যা কিনে নেয় রিলায়েন্স গোষ্ঠী। তার পর সেই দহেজ এখন পেট্রোরসায়ন শিল্পের এক নতুন অগ্রণী কেন্দ্র। রিলায়েন্স গোষ্ঠীর কারখানা আরও সম্প্রসারিত, ওএনজিসি, আদানি গোষ্ঠী-সহ অনেক শিল্পের ঠিকানা। লক্ষ লোকের কর্মসংস্থানের কেন্দ্র শুধু নয়, উন্নত বন্দর রাজপথ আর উন্নত শিল্প প্রযুক্তির গন্তব্য।
এ সব যদি পশ্চিমবঙ্গে হত! সে রকম একটা স্বপ্ন দেখছিলাম, একটা আধুনিক জলযানে আরামে বসে গঙ্গা পারাপার করছি, পাশে সহযাত্রীরা সবাই বেশ ঝকঝকে, পায়ে ভারী সেফটি বুট, পরনে শিল্প নিরাপত্তার জ্যাকেট। আলোচনা হচ্ছে এ বার বোনাস কী রকম হবে, জাপানি টিম কি এসে গেছে ইত্যাদি। হঠাৎ ঢেউয়ের প্রাবল্যে দুলে ওঠে জলযান, স্বপ্ন ভাঙে: বসে আছি ভটভটি নৌকায়, নৌকা ছেড়েছে ভাঙাচোরা ঘাট থেকে, প্রধান সহযাত্রীরা একটি স্থানীয় কীর্তনের দল, দ্বীপে আজ সারা রাত পালা হবে। আমরা যাচ্ছি নয়াচর দ্বীপে। হ্যাঁ নয়াচর, যা হতে পারত বাংলার দহেজ বা পারাদ্বীপ।
২০০৭ সালে ভারত সরকার পেট্রলিয়াম, রাসায়নিক ও পেট্রোরসায়ন শিল্প প্রসারণে পাঁচটি বিনিয়োগ কেন্দ্র নির্বাচিত করে। ভারত সরকারের সহায়তায় এই সব কেন্দ্রে একটি প্রধান পেট্রলিয়াম বা পেট্রোরসায়ন শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠবে একটি বৃহৎ শিল্পাঞ্চল যাতে কয়েক লক্ষ কোটি টাকার বিনিয়োগ আকর্ষিত হবে। এই পাঁচটি নির্বাচিত কেন্দ্রের মধ্যে স্থান পেয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের হলদিয়া পেট্রলিয়াম শোধনাগার। বাকি চারটি কেন্দ্র নির্বাচিত হয়েছিল গুজরাতের দহেজ, ওড়িশার পারাদ্বীপ, অন্ধ্রপ্রদেশের বিশাখাপত্তনম এবং তামিলনাড়ুর নাগপট্টিনাম। তামিলনাড়ু এই উদ্যোগ থেকে অনেক পরে বেরিয়ে এলেও তারা আলাদা করে তিনটি পেট্রোরসায়ন কেন্দ্র করছে।
এই উদ্যোগের জন্য প্রয়োজন অতিরিক্ত জমির এবং হলদিয়া তৈল শোধনাগার-সহ শিল্পাঞ্চলের পাশেই জমি খোঁজা হয় নন্দীগ্রামে। যখন সিঙ্গুরের টাটার কারখানার জমি নিয়ে প্রতিবাদ ধর্না ইত্যাদি চলছে, সেই একই সময়ে হলদিয়ায় শিল্পাঞ্চলের প্রসারণের জন্য জমি খোঁজা হচ্ছে নন্দীগ্রামে। সেখানেও প্রতিবাদ, আন্দোলন এবং সিঙ্গুরে যা ঘটেনি নন্দীগ্রামে ২০০৭-এর ১৪ মার্চ পুলিশের গুলিতে ১৪ জনের মৃত্যু হল। সিঙ্গুরের কারখানা নির্মাণের ৮০ শতাংশ হয়ে গেলেও ২০০৮-এর অক্টোবরে টাটা কর্তৃপক্ষ এই প্রকল্প থেকে বিদায় নেয়। ব্যক্তিগত ভাবে এটা আমার কাছে বিস্ময় যে, একই সময় (জানুয়ারি ২০০৬) ওড়িশায় কলিঙ্গনগরে টাটার ইস্পাত কারখানা স্থাপনে জমির বিবাদে পুলিশের গুলিতে ১৩ জন আদিবাসীর মৃত্যু হলেও টাটা পিছিয়ে আসেনি। সেখানে এখন ইস্পাত কারখানা পূর্ণ উদ্যমে চলছে এবং কলিঙ্গনগর এখন ধাতু শিল্পের অন্যতম বৃহৎ কেন্দ্র। ফলে সিঙ্গুর থেকে টাটার বিদায় একটি বিস্ময়, যেখানে বড় কোনও সংঘর্ষ হয়নি, কোনও মৃত্যুই হয়নি।
নয়াচর হলদিয়া বন্দরের ঠিক বিপরীতে গঙ্গার বুকে জেগে ওঠা একটি দ্বীপ। ১৯৪৮-এ এর প্রথম অস্তিত্ব দেখা যায়, তার পর ক্রমশ বড় হয়ে এটি আয়তনে এখন প্রায় ৫২ বর্গ কিলোমিটার, দৈর্ঘ্যে ১৫ কিমি, সবচেয়ে প্রশস্ত অংশ প্রায় সাড়ে ৪ কিমি। ১৯৯০ নাগাদ বামফ্রন্ট সরকার এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাঙ্কের ৩০ কোটি টাকায় এখানে মাছ চাষের জন্য ব্যবস্থা শুরু করে। ২০০০ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩১৪টি চিংড়ি চাষের জন্য পুকুর কাটা হয়, বিশাল পাম্প হাউস নির্মাণ হয়, বিভিন্ন মৎস্য সমবায় সংস্থাকে মাছ চাষের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সরকারি আবাস, অফিস গড়ে ওঠে কিন্তু বামপন্থী সরকারের অন্যান্য প্রকল্পের মতো এটাও মুখ থুবড়ে পড়ে। তবে মৎস্যজীবীরা সেই মাছ চাষ চালিয়ে যাচ্ছেন। সব মিলিয়ে তখন এই দ্বীপে প্রায় হাজার দুয়েক মানুষ থাকতেন এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সমীক্ষায় জানা যাচ্ছে যে, এঁরা নতুন শিল্প প্রকল্পে কাজ পেতে ইচ্ছুক। ফলে নয়াচর ছিল তৈল ও অনুসারী শিল্পের স্থাপনার আদর্শ স্থান। পশ্চিমবঙ্গে শিল্প স্থাপনের বড় সমস্যা জমি অধিগ্রহণ ও জমি মালিকদের পুনর্বাসন, যা নয়াচরে ছিল না। নয়াচর গড়ে উঠেছে সবে কয়েক দশক, এখানে তেমন জীববৈচিত্র ধ্বংসের ব্যাপারও ছিল না। উপকূল নিয়ন্ত্রণ আইনের জন্য প্রকল্পের কিছু বিশেষ ব্যবস্থার দরকার হতে পারত— এইটুকুই, যা অনেক নতুন প্রকল্পের ক্ষেত্রেই করতে হয়।
কিন্তু দেশে শিল্প গড়ে ওঠা ও তজ্জনিত উন্নয়নের বিরোধিতা এ দেশের অসরকারি সংস্থাগুলির একটি প্রধান কাজ। এতে বিদেশি অর্থের প্রভাব আছে বলেই মনে করা হয়। এই বিরোধিতায় প্রায়শই সহায়ক অংশগ্রহণকারীরা হচ্ছেন শিল্পের সঙ্গে বাস্তব সংযোগহীন উচ্চবিত্ত বিদ্বজ্জন সমাজের একটি অংশ। নয়াচরের ক্ষেত্রে যেখানে মাঠে কোথাও স্থানীয় জনসাধারণের কোনও অস্তিত্বই ছিল না, সেখানে উন্নয়ন বিরোধিতার কাগুজে ঝান্ডা নিয়ে নেমে পড়লেন এঁরা। এঁদের প্রকাশিত একটি সুলিখিত একশো পৃষ্ঠার পুস্তিকার প্রথম পঞ্চাশ পৃষ্ঠায় নয়াচরের কথা প্রায় নেই-ই। আছে পেট্রলিয়াম, রাসায়নিক ও পেট্রোরসায়ন শিল্পের ভয়ঙ্কর দূষণের গল্প। অর্থাৎ, এ সব শিল্প তাঁরা ভুলেও স্থাপন করতে দেবেন না। ভাগ্যিস শিক্ষাঙ্গনের বাইরে বাংলার রসায়ন শিল্পের পথিকৃৎ আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় আর বিশেষ আলোচিত নন, যদিও এই সব উচ্চবিত্ত প্রতিবাদীর সুখী জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে রয়েছে এই পেট্রোরসায়ন শিল্পের অবদান।
আমাদের ভটভটি নৌকা এখন প্রায় নয়াচরে ভিড়বে। কীর্তনের দল নামার তোড়জোড় করছে, রাতে ভোগ হবে হাজার জনের। নয়াচর থানার ছোট বাবু নৌকায় ছিলেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এই দ্বীপে সবাই বহিরাগত, সব জমিও সরকারের। তবে এখন মাছের চাষের কাজে থাকে প্রায় হাজার সাতেক লোক। পুরো দ্বীপের সব কাজই বেআইনি। একেবারে নৌকা লাগানোর ঘাটের কাছেই নতুন মনসা শীতলা, কৃষ্ণের মন্দির। লোকজন কিছু মেদিনীপুর, কিছু চব্বিশ পরগনার। দ্বীপের আর এক প্রান্তে রয়েছে মদিনা মসজিদ, সংখ্যায় এখন তারাই অনেক বেশি।
এ দ্বীপের পরিবেশ নিয়ে তো ভীষণ উদ্বেগ ছিলই। নয়াচরের দ্বীপের মধ্যে নদী থেকে প্রচুর খাঁড়ি ঢুকেছে। এই সব খাঁড়ি বুজে গেলে তো বাস্তুতন্ত্রের সর্বনাশ। এই খাঁড়ি থেকে সাধারণ মৎস্যজীবীরা কত রকমের মাছ ধরেন। তা ছাড়া জোয়ারের সময় এই সব খাঁড়ি দিয়ে জল ঢুকে ডুবিয়ে দেয় প্রায় দ্বীপের বেশির ভাগটাই। শিল্প হলে এই প্রাকৃতিক ব্যাপার বন্ধ, পরিবেশের বিপদ। তা ছাড়া প্রাকৃতিক অবস্থায় থাকলে এই দ্বীপে গড়ে উঠবে বাদাবন, এই বাদাবন এক-একটি ধাপে ধাপে (সাক্সেশন) তৈরি হয়। নয়াচর হয়ে উঠবে বাদাবন অধ্যয়নের এক পরীক্ষাগার। এ রকম একটি প্রকৃতির দানকে শিল্প এনে ধ্বংস করা সত্যি বড় অন্যায়।
নয়াচর প্রকল্প অবশ্য কেবল এ সব বিরোধিতায় পরিত্যক্ত হয়নি, বামপন্থী সরকারের অকর্মণ্যতাও ছিল গুরুতর। তাদের অংশীদার কোম্পানিটি এত বড় প্রকল্পের কাজের যোগ্যতাই ছিল না। এ ছাড়া ইতিমধ্যে ২০০৯-এর নির্বাচনে বামপন্থীদের ব্যাপক পরাজয় সরকারের অস্তিত্বেই প্রশ্ন তুলে দিয়েছিল। স্বাভাবিক ভাবেই তৃণমূল কংগ্রেস বামফ্রন্ট সরকারের এই প্রকল্পের বিরোধিতা করে, এই বুদ্ধিজীবীরা সহায়ক হন। এর পর তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় এলে এঁদের কেউ কেউ বিভিন্ন সরকারি পদে অলঙ্কৃত হন। এই সব ডামাডোলে সিঙ্গুরের পাশাপাশি নয়াচর পশ্চিমবঙ্গের শিল্পের পুনরুজ্জীবনের সব আশা শেষ করে দিল।
শিল্প হল না, কিন্তু পরিবেশের কী হল। বাম সরকার আগেই তাদের মৎস্য প্রকল্প ছেড়ে চলে গিয়েছিল, তার পরিকল্পিত ভাবে খোঁড়া মাছের ভেড়িগুলি চালাতে থাকলেন মৎস্যজীবীরা। শিল্প তো হলই না, ও-দিকে পুরো দ্বীপটাই চলে গেল ‘জোর যার মুলুক তার’-দের হাতে, যথেচ্ছ ভাবে কাটা হতে থাকল শত শত ভেড়ি, বুজে গেল অনেক অনেক খাঁড়ি। এখন গোটা দ্বীপটাই এ রকম উঁচু পাড়ে ঘেরা কয়েক হাজার ভেড়ির দ্বীপ। কোনও প্রাকৃতিক ব্যাপারস্যাপার নেই, কোনও বাদাবনের বিস্তৃতির সুযোগ নেই। কেবল মাছের চাষের জন্য ভেড়ির জলে মেশানো খাদ্য আর ওষুধের বর্জ্য জল ঢুকছে মাটিতে আর নদীর জলে।
না, শিল্প হয়নি। না, প্রকৃতিও বাঁচেনি। একমাত্র সফল হয়েছেন উন্নয়ন বিরোধিতার জন্য অনুদানপ্রাপ্ত সংস্থারা, আর নিশ্চিন্ত চাকুরে বিদ্বজ্জনেরা।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)