গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
‘‘আমার কিন্তু পরনারী দেখলেই করোনারিতে রক্ত সঞ্চালন বেড়ে যায়!’’
মন্তব্যটি শুনে কেউই তেমন বিস্মিত হইনি। যে সিনিয়র সহকর্মী উক্তিটি করেছিলেন, তাঁর রসবোধ ‘প্রেম-বিয়ে-যৌনতাতেই’ আটকে থাকত। আমাদের অনেকেরই সেটা প্রথম চাকরি। পারমিতা বিয়ের পর সেদিনই জয়েন করেছিল। হুমড়ি খেয়ে ক’জন ওর বিয়ের অ্যালবাম দেখছিলাম। তখনই কথাটা শুনলাম। উদ্দেশ্য অবশ্যই পারমিতা। বক্তা উচ্চপদে ছিলেন বলে অনেকেই তাঁর চটুল মন্তব্যে বাধ্যতামূলক হাসি ফেরত দিত। কিন্তু আমি তো এমন কথা শুধু হাসিতে ভিজিয়ে গেলার মানুষ নই। আগাগোড়া বেণীর সঙ্গে মাথা দেওয়ায় বিশ্বাসী। ওঁকে বলেছিলাম, ‘‘আমরা কেউ বরের নারীও নই। পরের নারীও নই। আপনার করোনারিরও নই।’’ উত্তরে উনি কী বলেছিলেন সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু পারমিতার প্রতিক্রিয়া এ লেখায় প্রাসঙ্গিক। পারমিতা ওই লোকটির কান বাঁচিয়ে বলেছিল, ‘‘তোরা যে যার নিজের হতে পারিস। আমি কিন্তু আমার বরের নারী।’’ মেরুন তাঁত বেনারসি, সিঁদুরলাগা নাক, সোনাবাঁধানো পলা, মিনে করা নোয়া পরিহিতা পারমিতা তখন ‘বউ’ শব্দটির আদর্শ প্রতিনিধি। ওর সর্বাঙ্গ যেন তখন বিবাহে উৎসর্গিত।
আজও পারমিতা একই কথা ভাবে কিনা জানি না। কিন্তু এ ভাবনার শিকড় কোনখানে থাকে ক্রমশ জেনেছি। নিজের জীবন দিয়ে জেনেছি। কাজের সূত্রে জেনেছি।
বিবাহ প্রতিষ্ঠানটির মধ্যেই জন্মজন্মান্তরের মতো পরস্পরের হয়ে যাওয়ার আশ্বাস থাকে। আইন, মন্ত্র, জনসমক্ষে শুভদৃষ্টি, উচ্চারিত ‘কবুল কবুল’ সব আয়োজন দিয়ে আদতে সেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকেই সিলমোহর দেওয়া হয়। আর এই অতিরঞ্জিত প্রতিশ্রুতির মধ্যেই একটা তিরতিরে ফাটলের সম্ভাবনা থেকে যায়। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ বিয়েকে এমন ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে উপস্থাপিত করে, যে আমরা বিয়ের জিম্মায় নিজেদের সম্পর্ককে রেখে ঝাড়া হাত-পা হয়ে যাই। সংসারের আনুষঙ্গিক নিয়ে মেতে উঠি। সমাজ বিয়ে বাঁচাতে উৎসাহী হয়। দুটো মানুষের ভালবাসার ভিত নিয়ে মাথা ঘামায় না। মাঝখান থেকে যে সম্পর্ককে কেন্দ্র করে এত আড়ম্বর, আমরা ক্রমশ তারই যত্ন দিতে ভুলে যাই। বিয়ের আদব মেনে সন্তান আনি। দায়িত্ব বাড়ে। কিন্তু অনেকসময় অন্তরঙ্গতার সংলাপ কমতে থাকে। যৌনতা কালেভদ্রে আসে। কিন্তু আমরা অন্যের নিঃশ্বাসের গন্ধ ভুলতে থাকি। হয়ত একজনের খেয়াল হয়, ‘‘আমরা আর আগের মতো প্রেম করি না। চিঠি লিখি না।’’ অন্যজন দুনিয়াদারি সামলে ক্লান্ত হয়ে ভাবে, পরে হবে। পরে যে হবেই এতটা নিশ্চিত হই কেন? হই, কারণ বিয়ে সেই ভরসার একটা ভ্রম তৈরি করে দেয়। বিয়ের চারা অশ্বথ গাছের মতো আদর-পরিচর্যা ছাড়াই বাড়তে পারে। শুধু একদিন তার চাপে গোটা সম্পর্কটাই বিপজ্জনক বাড়ির মতো ভঙ্গুর হয়ে ওঠে। আমরা সম্পর্কের চিড় খাওয়া দেওয়াল ঢেকেঢুকে সুখী দাম্পত্যের প্রদর্শনী শুরু করি। বিয়ের মলাট অবিকৃত থাকে। বইটা বদলে যায়। বাইরের পৃথিবী দেখে সব পরিপাটি আছে। শুধু দু’জন মানুষ মাঝেমধ্যে টের পায়, তাদের গল্পে অন্য চরিত্রদের ভিড় বাড়ছে। তাদের আর নিভৃতির দরকারও পড়ছে না। এইভাবে অধিকাংশ বিয়ে টিকেও যায়। যতক্ষণ না দমকা হাওয়া আসে।
দমকা হাওয়া— প্রেম!
বিবাহ-পরবর্তী প্রেম কারও জীবনে আসবে কি না কেউ বলতে পারে না। বিয়ের একঘেয়েমি কাটাতে যারা আলগা ফ্লার্ট করে বা খুচখাচ অ্যাফেয়ারের তাল খোঁজে তাদের কথা বলছি না। সে ক্ষেত্রে বিবাহ সাময়িক টাল খেলেও সাধারণত মুখ থুবড়ে পড়ে না। প্রেম তো অন্য জিনিস! আমরা ডাকলেই আসবে এত উদার নয়। আবার না চাইলে বিদায় নেবে, এত বুঝদারও নয়। প্রেম কোনওদিন সমাজ-নিয়ম-প্রতিষ্ঠানের ধার ধারেনি। তাকে বৈধতা দিয়ে আইন মাপতে পারে। তাকে ‘পরকীয়া’ বলে সমাজ ডাকতে পারে। তাতে তার দাপট কমে না। তাকে নিয়ে হ্যাপাও কমে না। অন্যজনের অনুপ্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে বিয়ে নিজের অস্তিত্ব প্রমাণে তৎপর হয়ে ওঠে। শুরু হয় কঠিন নজরদারি। ফোন ঘাঁটাঘাঁটি। দোষারোপের হিড়িক। আমরা ঘরে ঘরে ব্যোমকেশ যাপনে লেগে পড়ি। তক্কেতক্কে থাকি। হাতেনাতে ধরেও ফেলি। কিন্তু যে যাবে বলে মনস্থির করেছে তাকে ধরে রাখা যায় কি? দুধ থেকে দই পাতা হয়ে গেলে আবার তাকে দুধ বানানো অসম্ভব। সম্পর্কও তা-ই। একবার ভিতের রসায়ন বদলে গেলে তাকে আগের অবস্থানে আনা দুষ্কর। আমরা যত সে চেষ্টা করি, তত সব আরও ঘেঁটে যায়। জটিলতা বাড়ে। তিক্ততা বাড়ে।
‘পরকীয়া’ সামনে এলেই যে প্রশ্নগুলি কুরে কুরে খায়, তার মধ্যে একটি হল— ‘‘কেন এতদিন গোপন করলে?’’ প্রশ্নটির মধ্যে বোকা বনে যাওয়ার একটা সরল কষ্ট থাকে। অন্য প্রেমটি হওয়ার পর থেকে যে ক’দিন সব ঠিক আছে ভেবে সংসার করেছি, সেটা নিখাদ পরিহাস বলে মনে হয়। কিন্তু ‘সে কেন বলল না’-র পাশাপাশিই ‘আমি কেন বুঝলাম না’-টাও ভেবে দেখা দরকার। হয়ত বহুকাল আর পরস্পরকে বুঝতে চাইনি। শুধু বিয়ে বুঝেছি। যে সব ক্ষেত্রে গোড়াতেই জানান দেওয়া হয়েছে সেখানেও অন্য ক্ষোভ থাকে। বিবাহের প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও কেন তুমি অন্য কারও হবে— এই নিয়ে রাগ-অভিযোগ আসে। নিজেকে প্রতারিত লাগে। ‘‘প্রেম যদি এসেও থাকে তুমি কেন নিজেকে আটকালে না’’— এমন প্রশ্নও ওঠে। যে অন্তত একবারও সজোরে প্রেমে পড়েছে, সে জানে বিবাহ দিয়ে প্রেম আটকানো যায় না। বিবাহ দিয়ে আরেকটা আইনি বিবাহ স্থগিত রাখা যায়। বিবাহ-পরবর্তী প্রেম প্রকাশ্যে আনা নিয়ে সংশয় থাকতেই পারে। আবার না-ও থাকতে পারে। প্রেম যার প্রতি জন্মেছে, তার কাছে প্রকাশিত হওয়ার জন্য উন্মুখ হয়। তার কাছে স্বীকারোক্তির তাগিদ ক্রমশ জোরাল হতে থাকে। বাকি কাকে কী বলব, কতটা বলব, তা স্থান-কাল-পাত্রের নিরিখে ভিন্ন হতে দেখেছি।
আরেকটি প্রশ্ন অনিবার্য ভাবে ওঠে। ‘‘তোমরা কতদূর গিয়েছ?’’ অর্থাৎ, শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে কি না। বিবাহের দিনলিপিতে আদর থাকুক বা না থাকুক, অন্য কেউ স্পর্শসুখে ভাগ বসালে আমাদের ব্রহ্মতালু জ্বলে ওঠে। যৌনতা যেন এক অ্যান্টিক মাউথ অরগ্যান। পড়ে পড়ে ধুলো খেলেও আমরা ফিরে দেখি না। কিন্তু অন্য কারও ঠোঁট ছুঁয়ে সে বেজে উঠছে দেখলে আমাদের অসহ্য লাগে। তক্ষুনি রেওয়াজে বসতে ইচ্ছে করে। হয়ত সুর লাগে না। নিজেকে আরও ব্যর্থ মনে হতে থাকে। অক্ষম মনে হতে থাকে। সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ে নতুন মানুষটির ওপর। যেন সে-ই ছলেবলে কৌশলে আমাদের ঘরের জনকে ফুসলেছে। সে অন্য নারী হলে সাক্ষাৎ ডাইনির অবতার। আর অন্য পুরুষ হলে নির্ঘাত পর্নোগ্রাফির নায়ক। আমরা ধরেই নিই, বিবাহ-পরবর্তী প্রেম মানেই বিছানা উদ্যাপন। বিবাহ যেন শুচিতায় নিকোন আলপনা। আর বিবাহিতের প্রেম মানেই নীল আলোয় চড়া আতর। যেন যৌনতা থাকলেই নিকৃষ্ট মানের প্রেম। সুতরাং ওটি পরকীয়ার মূলধন। দীর্ঘ দাম্পত্যে আদরের পাট চুকিয়ে ফেলার মধ্যে কোনও বিশেষ কৃতিত্ব নেই। কেউ অযৌনতায় (এসেক্সুয়ালিটি) বিশ্বাসী হলে আলাদা কথা। অন্তরঙ্গতাকেও যত্ন দিতে হয়। নতুন ভাষা আবিষ্কার করতে হয়। ওদিকে আবার বিবাহ-সমান্তরাল প্রেমেও কেউ সারাক্ষণ যৌনতা প্রাকটিস করে না। তাদেরও খুঁটিনাটি বলাকওয়া থাকে। ‘‘ওষুধ খেয়েছো কি না’’ থাকে। রাজনৈতিক বিতর্ক থাকে। আবার একসঙ্গে না থাকতে পারার ভারও থাকে। যেহেতু বাইরের পৃথিবীকে জানান দেওয়ার অবকাশ থাকে না, তাই এই প্রেম অনেক বেশি অন্তর্মুখী হতে শেখে। সমাজ তাদের বিরোধিতা করবে তারা জানে। জানে বলেই পরস্পরকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে আরও বেশি বেশি জুড়ে থাকার চেষ্টা করে। সেখানেও স্বীকৃতির প্রত্যাশা জন্মায়। অধিকারবোধের লড়াই আসে। তেমন অশান্তি চলতে থাকলে বেশিদিন টানা যায় না। ছেদ পড়ে।
অনেকসময় দেখেছি প্রেম এসেছে মানেই বিবাহবিচ্ছেদের পরিকল্পনা না-ও থাকতে পারে। অনেকেই প্রেম এবং বিবাহকে এক ফ্রেমে দেখে না। একজন মানুষ আপাদমস্তক মনোগ্যামিতে বিশ্বাসী হয়েও অনেকসময় বিবাহ আর প্রেমকে মনের মধ্যে আলাদা আলাদা ঘরে স্থাপন করাতে পারে। যদিও সে চাইলেই বাকি দু’জন এই সমান্তরাল অবস্থানে সম্মত হবে এমন নয়। কেউ যদি অন্যের উপস্থিতি-সহ নিজেকে মানতে না পারে, তখন কোনও একটি বিচ্ছেদ অবশ্যম্ভাবী। যে তরফেই আসুক, বিচ্ছেদের কষ্ট এবং অভিঘাত অবধারিত। বিবাহ দিয়ে সম্পত্তির ওপর অধিকার জন্মাতে পারে। কিন্তু একজন মানুষ কোনওদিন পুরোপুরি অন্যের হতে পারে না। বিবাহেও পারে না। না-বিবাহেও পারে না। ভালবাসার পাত্র হতে পারে। সেই পারাটুকুরও সময়সীমা বদলে যেতে পারে। এই উপলব্ধির সঙ্গে বোঝাপড়ায় আসা সহজ নয়। প্রতিটা চরিত্রের অসহায়তার ধরন আলাদা। ক্ষরণ আলাদা। এখানে কেউ ইচ্ছাকৃত ভাবে ভিলেন নয়। শুধু একে ওপরের আহত হওয়ার আখ্যানে আমাদের অনিচ্ছাকৃত ভূমিকা থেকে যায়।
সম্প্রতি অনেক বিশিষ্ট মানুষ তাঁদের বিবাহ এবং প্রেম নিয়ে নিয়ে প্রবল কাদা ছোড়াছুড়ি শুরু করেছেন। কেউই কাউকে সুচ্যগ্র মেদিনী ছাড়ছেন না। যে যত পারেন প্রমাণ-সহ একে অপরকে দুষছেন। কুৎসার মুখে চোঙা লাগিয়ে দিলে কারও নাম রেহাই পায় না। সকলেরই ব্যক্তিগত ইতিহাস তখন লোকমুখে ঘুরতে থাকে। তাতে কিছুদিন পরচর্চার কেন্দ্রে বসা যায়। অনেকদিনের নিস্তরঙ্গ সম্পর্ক নাটকীয় উত্তেজনায় টানটান হয়ে ওঠে। কিন্তু এত অমর্যাদার পর পরস্পরের প্রতি টান কি আদৌ ফেরে? পরকীয়ায় থানা-পুলিশ, আইন-আদালত করে বিয়ে যদি বা ফেরত আসে, প্রেম কি সত্যি আর ফেরে? লড়ে আনা বিয়ের কাছে নিজেরাই বা কতটা ফিরতে পারি? আমরা জেদের বশে বলি ‘‘ওকে কিছুতেই ছাড়ব না!’’ কিন্তু তলিয়ে ভাবি না, আদতে কী ধরে আছি। শুধু বিয়েটুকু ধরে রাখতে পারলেই বিয়ের দেওয়া যাবতীয় আশ্বাস ফলে যায় না।
(লেখক বিশিষ্ট মনোবিদ। মতামত একান্তই ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy