সম্প্রতি গণতন্ত্রের পক্ষে অত্যন্ত বিপজ্জনক এক সঙ্কেত লক্ষ করছি আমরা। অমর্ত্য সেনের অসম্মান দেখেছি, দেখেছি রোমিলা থাপারদের অমর্যাদা। তবে কি এই দেশে বিদ্বান ও চিন্তকের আর কোনও মূল্য বাকি রইল না?
দুর্গতির রূপ ক্রমশ প্রকট হচ্ছে। যে কোনও প্রতিবাদীকেই যে কোনও সময় রাষ্ট্র দাগিয়ে দিতে পারে ‘মাওবাদী’ বা ‘আরবান নকশাল’ বলে।
কিছু দিন ধরে এক ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন তাড়া করে ফেলে। এমন যদি হয়, কোনও নিউজ় চ্যানেলে নানা দলের কয়েক জন রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ, সুনীতিবাবু ও সুকুমার সেন এসে বসেন? কী হবে তা হলে? সর্বজ্ঞ সভাপরিচালক নিশ্চয়ই তাঁরা দু’তিন মিনিটের বেশি বলতে গেলে তাঁদের দাবড়ানি দিয়ে থামিয়ে দেবেন! গাঁধী, আজাদ, নেহরু আর রাধাকৃষ্ণন, এঁরা কথা বললেও অশোভন ভাবে আক্রমণ করবেন সর্বভারতীয় চ্যানেলের পরিচালক।
আসলে, আমরা কয়েক দশক ধরেই দেখছি গোলকায়নের যুগে সত্যিকারের জ্ঞানচর্চা প্রায় সম্পূর্ণ পার্শ্বরেখায়িত হয়ে গিয়েছে। কেরিয়ারের জন্য ছাড়া জ্ঞান-সাধনার শতাব্দীপ্রাচীন মূল্য আর স্বীকৃত নয়। রাষ্ট্রীয় জীবনে চিন্তকদের প্রায় কোনও পরিসর থাকছে না, ভূমিকা তো নয়-ই।
শেষ কবে রাজ্যসভায় এক প্রকৃত জ্ঞানীকে দেখেছি আমরা? যিনি ভারতবর্ষের ইতিহাস, ভূগোল, বহুস্তরীয় অর্থনৈতিক বৈষম্য নিয়ে ভাবনাচিন্তা করেন? সাম্প্রতিক কালে কি কল্পনাও করতে পারি, রাজ্যসভায় ইরফান হাবিব, আশিস নন্দী, অনন্তমূর্তি বা গিরিশ কারনাড বিশেষ ভূমিকা পালন করছেন? হয়তো আমরা প্রাক্তন ক্রিকেট খেলোয়াড় বা অভিনেতাকে দেখব সেখানে, কিন্তু বিদ্যাচর্চা করা কোনও চিন্তককে নয়।
আসলে চিন্তা আর চিন্তকদের মধ্যেই সর্বনাশ দেখে এই সাম্প্রতিক সমাজ-রাজনীতি। মনে পড়ে, ব্রিটিশ দার্শনিক ফ্রান্সিস বেকন বলেছিলেন, ‘রিডিং মেকেথ আ ফুল ম্যান’। অর্থাৎ, ‘যত বেশি জানে, তত কম মানে’। আমি রাজনৈতিক দলের মনোনীত ব্যক্তিদের কথা বলছি না, কারণ তাঁদের টিকি বাঁধা আছে পার্টিতে। বার বার শিক্ষানীতির পরিবর্তন হয়, ছাত্রদের উন্নতির জন্য ততটা নয়, সরকারি উপস্থিতি টের পাওয়ানোর জন্য। কিন্তু সরকারি ছাপ মারা নয়, এমন সর্বজনমান্য প্রকৃত শিক্ষাবিদদের পরামর্শ নেওয়া হয় বলে জানি না। জাতীয় স্তরে কোনও বিতর্কও হয় না। রাজনীতির ঊর্ধ্বে না উঠে দেশের স্বাস্থ্য বা শিক্ষার ভাগ্য কি নির্ধারণ করা যায়?
এ কি তা হলে, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, যখন জাতীয়তাবাদের ‘নাড়ি তাজা হচ্ছে’ (কালান্তর), তখনকার ‘অজগর সাপের ঐক্যনীতি’? সে ক্ষেত্রে মাইকেল লিটলফোর্ডের গ্রন্থনামের অনুসরণে বলব দ্য ক্লোজ়িং অব দি ইন্ডিয়ান মাইন্ড-এর আর বেশি দেরি নেই।
কিছু দিন আগে মুম্বই ডি-ইন্টেলেকচুয়ালাইজ়ড: রাইজ় অ্যান্ড ডিক্লাইন অব আ কালচার অব থিঙ্কিং নামে একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। কলকাতা সম্পর্কেও শিরোনামটি প্রযোজ্য হতে বেশি দেরি নেই, কারণ এখানেও মহীরুহদের সংখ্যা দ্রুতবেগে কমে আসছে, এক অশ্রদ্ধেয় মূল্যবিশৃঙ্খলার মধ্যে বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের পক্ষে যথেষ্ট জ্ঞানচর্চা ও শ্রদ্ধা অর্জন করে সেই জায়গায় পৌঁছতে পারা সহজ নয়। শিক্ষকরা অবশ্য এখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে ঢুকে উদ্ভাসিত মুখগুলি দেখলে এক স্বপ্নের ভবিষ্যতের কথা ভাবেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের মন আশঙ্কাতেও ভরে যায়, এদের মধ্যে যারা প্রকৃত অগ্রণী, পূর্ণ বিকাশের জন্য তাদের দেশ ছাড়তে হবে না তো?
এমতাবস্থায় জ্ঞানী ব্যক্তিদের যে ভূমিকা থাকতে পারত, বাণিজ্যমুখী গোলকায়নের যুগে জ্ঞানচর্চা সম্পর্কে নিস্পৃহতার মধ্যে তার সম্ভাবনা দেখছি না। আমি এখানে তাঁদের কথা বলছি না, যাঁদের ফরাসিরা বিদ্রুপ করে বলে ‘কোলাবো’ (collaborateurs): যে আত্মবিক্রীত বুদ্ধিজীবীরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার-নিয়ন্ত্রিত ভিশি সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। ফ্রান্স আজও তাঁদের গ্রহণ করতে পারেনি। ফরাসি ইতিহাস ও সংস্কৃতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিশেষজ্ঞ থিয়োডোর জ়েলডিন তাঁর দীর্ঘ ক্ষেত্র-গবেষণায় দেখেছেন, ইন্টেলেকচুয়ালের সম্মান সে দেশে আজও অন্য সকলের চেয়ে বেশি। ১৯৬৮ সালের ছাত্র-আন্দোলনের সময় প্রেসিডেন্ট দ্য গল সার্ত্রকে গ্রেফতার করেও মুক্ত করে দেন, কারণ “ভলতেয়রকে তো বন্দি করা যায় না।”
ভারতীয় সমাজবিজ্ঞানীরা দেশ-বিদেশের গুণগ্রাহীর মাঝে প্রবল আদৃত হয়ে থাকেন, কিন্তু দেশে সাধারণ মানুষ তাঁদের নাম শোনেন না, বৃহত্তর রাষ্ট্রজীবনে তাঁদের নিয়ে নেতারা মাথা ঘামান না, হয়তো নামও শোনেন না। সম্প্রতি এক বিশ্বখ্যাত বিদ্বান জানালেন, নিজের নাম বলে জনৈক আমলাকে মেসেজ করেছিলেন করোনা বিষয়ে দু’-একটি পরামর্শ দেবেন বলে। ভদ্রলোক বিদ্যাচর্চার প্রতি সম্মান দূরে থাক, সৌজন্যের খাতিরেও উত্তর দেননি। পাশ্চাত্যের কোনও সভ্য দেশে এটা কিন্তু অচিন্তনীয়।
সত্যি কথাটা হল, ভারতে গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে একটা বিপদসঙ্কেত জ্বলে উঠছে। গত কয়েক দশক জুড়ে যে গোধূলি সন্ধির নৃত্য চলছে, সেখানে প্রশ্ন উঠতেই পারে, আমরা আর কত দিন প্লেটোর গুহার মধ্যে অবস্থান করব, যেখানে ছায়াই একমাত্র ভ্রান্ত আস্তিত্বিক সত্য? এ দেশে এক সময় বিতর্কে অংশগ্রহণ করতেন নেহরু, কৃষ্ণ মেনন, অম্বেডকর, আবুল কালাম আজাদ, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, এস এ ডাঙ্গে কিংবা গোপালন। এক সময় আমাদের এখানে বিধান পরিষদের সভাপতি ছিলেন স্বয়ং সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। রাষ্ট্র, প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও সাংবিধানিক নিয়ম মেনে বিদ্বজ্জনকে রাজ্যসভায় নিয়োগ করা যাবে না কেন? অতীত খুঁড়ে দেখব, রাজ্যসভায় মনোনীত হয়েছেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু, কালিদাস নাগ, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, কৃষ্ণ কৃপালনী, কৃষ্ণস্বামী আইয়ার, কাকা কালেকার, জগদীশন কুমারাপ্পা, কে এম পানিক্কর, উমাশঙ্কর জোশী, নুরুল হাসান, নির্মলা দেশপান্ডে, হাবিব তনভীর, অমৃতা প্রীতম, রবিশংকর, অসীমা চট্টোপাধ্যায়, কুলদীপ নায়ার, কপিলা বাৎস্যায়ন, মৃণাল সেন, শ্যাম বেনেগাল প্রমুখ। লোকসভায় গিয়েছেন মেঘনাদ সাহার মতো জ্ঞানীরা।
আর আজ আমরা তাঁকেই সংসদে পাঠাই, যিনি দেশের সম্পর্কে প্রায় কিছুই খবর রাখেন না, এমনকি গুছিয়ে কথাও বলতে পারেন না? এই শূন্যতায় নিজেদের মঙ্গলার্থে আপন হতে বাহির হওয়া যায় না? না কি ক্ষুদ্র স্বার্থই আমাদের বাধা হয়ে থাকবে, জনচেতনার রূপায়ণ গুরুত্ব পাবে না? ‘সুপ্রা-পলিটিক্যাল’ বলেও তো কিছু আছে। ক্রিস্টিন কুপার-এর ভাষায়, যে ‘পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল’ ক্ষেত্রবিশেষে কখনও হতেই পারেন ‘ইনএফেকচুয়াল’। নানা বাধা ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এক জন চিন্তাবিদ— এক আদর্শ-বর্জিত রাজনীতিকের চেয়ে বেশি মূল্যবান।
পাশ্চাত্যেও সক্রেটিস থেকে সার্ত্র বা চমস্কি পর্যন্ত মুক্তচিন্তার যে বিপুল ঐতিহ্যের বিস্তার, আজকের এই মিডিয়া বিস্ফোরণের যুগে সেটাও ক্রমশ ফিকে হয়ে এসেছে। জ্ঞানচর্চার বর্তমান বিচ্ছিন্নতা ও অগভীরতার পরিবেশে এই ফাঁক ভরাট করা সহজ নয়। দি আইডিয়াজ় ইন্ডাস্ট্রি বইতে ড্যানিয়েল ড্রেজ়নার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের প্রতি চরম অশ্রদ্ধা ও অনাস্থার পরিবেশে চিন্তাভাবনার ‘বাজার’-এর গণতন্ত্রীকরণের ফলে স্বাধীন মানবিক চিন্তার ক্ষেত্রে প্রতি পদক্ষেপে বাধার কথা লিখেছেন।
গত শতাব্দীতে দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝে রম্যাঁ রলাঁ তরুণ ইতিহাসবিদ কালিদাস নাগকে লিখেছিলেন, “আমি ওয়াচ-টাওয়ারের উপর থেকে এক ধন্যবাদহীন প্রহরীর কর্তব্য পালন করে চলেছি। মাঝে মাঝে খোলা মাঠে মধ্যরাতে আমি চিৎকার করে সাবধানবাণী উচ্চারণ করে চলেছি, যা হারিয়ে যাচ্ছে হাওয়ায়।... যে দিন আমি মরে যাব, আমার আশঙ্কা ওয়াচ-টাওয়ারটি পরিত্যক্ত হয়ে যাবে।— শুধু শোনা যাবে ঝড়ের গর্জন।”
এই অন্ধকার সময়ে বিবেকী চিন্তকের সম্মান ও রাষ্ট্রীয় মূল্য কমে গেলে, তাঁর মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করলে, রবীন্দ্রনাথ-কথিত ‘মনুষ্যত্বের অন্তহীন প্রতিকারহীন পরাভব’ অনিবার্য হয়ে উঠবে। রাজনীতির ভাষা হয়ে উঠবে আরও তিক্ত ও অশোভন। জড়ত্বের বেষ্টনে আমরা আরও আড়ষ্ট হয়ে যাব। আমাদের আয়ত্তের বাইরে চলে যাবে— সদ্য হারিয়ে ফেলা এক বিবেকবান চিন্তক শঙ্খ ঘোষ যাকে বলেছিলেন, ভিন্ন রুচির অধিকার আর সমগ্রের ভাবনা। অপরীক্ষিত জীবন তো বাঁচার যোগ্য নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy