বাইশ বছরের পঞ্জাবি তরুণ গুরবিন্দরের সঙ্গে স্বপ্ন বেঁধেছিলেন উত্তরপ্রদেশের উনিশ বছরের তরুণী গিরজা কুমারী। কিন্তু ভিন্জাতের বিয়েতে মত ছিল না গিরজার পরিবারের। অগত্যা ঘর ছেড়ে সংসার পাতেন গিরজা। অতঃপর পরিবারের থেকে শাসানির ফোন, জীবনহানির হুমকিও। পঞ্জাবের তরন তারন জেলায় মাসদুয়েক আগের ঘটনা। চোদ্দো বছর আগে বাংলার নাগরিক সমাজে আলোড়ন তুলেছিল রিজ়ওয়ানুর-প্রিয়ঙ্কার ‘অসম’ প্রেম। গুরবিন্দর-গিরজা যদিও গত মাসে পুলিশি নিরাপত্তার আবেদন করেন পঞ্জাব ও হরিয়ানা হাই কোর্টে। ১১ মে বিচারপতি এইচ এস মদনের এজলাসে তাঁদের আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়। পরে তাঁরা সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করলে বিচারপতি নবীন সিংহ ও অজয় রস্তোগীর ডিভিশন বেঞ্চ ৪ জুন রায় দেয় যে, এটি জীবন ও স্বাধীনতার প্রশ্ন, অতএব পুলিশ সুপারকে আইন মোতাবেক আবেদনকারীদের নিরাপত্তা দিতে হবে।
আবেদন প্রত্যাখ্যানের পর্যবেক্ষণে হাই কোর্ট জানিয়েছিল, এই যুগল লিভ-ইন সম্পর্কে স্বীকৃতির সিলমোহর চাইছেন, যা নৈতিক ও সামাজিক ভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। গিরজা অবশ্য বলেন, তাঁর পরিচিতিপত্র পরিবার আটকে রেখেছে, তাই তাঁরা বিয়ে করতে চাইলেও পারছেন না। ভালবাসার স্বীকারোক্তি সরল, আইনের ব্যাখ্যা নয়। নিরাপত্তার আবেদনের সঙ্গে লিভ-ইন সম্পর্ক মিলিয়ে দেখা ঠিক কি না, কিংবা কোনও সম্পর্ককে লিভ-ইন ধরে নেওয়া এবং ‘অনৈতিক’ ও ‘অসামাজিক’ আখ্যা দেওয়া যায় কি না, সে বিতর্ক তোলা রইল। আদালতের রায় নিয়ে এ ভাবে মতামত জানানোও অনুচিত। বরং লিভ-ইন সম্পর্ক নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ, মূল্যায়ন ও দু’টি ঐতিহাসিক রায় ফিরে দেখা প্রয়োজন।
২০০৬ সালে ‘লতা সিংহ ভার্সাস স্টেট অব উত্তরপ্রদেশ’ সুপ্রিম কোর্ট জানায়, কেউ প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের লিভ-ইনকে অনৈতিক মানলেও, আইনের চোখে তা অপরাধ নয়। প্রাপ্তবয়স্ক নারীর স্বাধীন ভাবে সঙ্গী নির্বাচনের অধিকার আছে, বিয়ে হোক বা লিভ-ইন। ২০১০ সালে অভিনেত্রী খুশবু-র এক আবেদনের প্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছিল, এক সঙ্গে থাকা জীবনের অধিকার, তা অবৈধ হতে পারে না। আদালতের মত, লিভ-ইন বা প্রাক্বিবাহ যৌনতাকে প্রাতিষ্ঠানিক বিয়ের মূল ভাবনায় কুঠারাঘাত বলে মনে করেন অনেকে। এ দেশে বিয়ে সামাজিক প্রতিষ্ঠান হলেও খোলামনে ভাবা উচিত যে, সকলে তাতে সহমত নন। ভারতেই কিছু জনগোষ্ঠীতে বিবাহ-বহির্ভূত যৌনতাকেও ‘স্বাভাবিক’ ভাবা হয়। মূলস্রোতেও তেমন ধারণা অমিল নয়। সমাজ-নৈতিকতার ধারণা ‘সাবজেক্টিভ’। তা ছাড়া, ফৌজদারি আইনে ব্যক্তিসত্তা ও স্বাধীনতার উপর অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ কাম্য নয়।
আইনি সমর্থন মিলল। কিন্তু লিভ-ইন নৈতিক ও সামাজিক মানদণ্ডে এতখানি অচ্ছুত কেন? মনে রাখব, নৈতিকতা কোনও ধ্রুবক নয়, সময়ের সঙ্গে তা পাল্টায়। সমাজও স্থিতাবস্থার পক্ষে। যে আচরণ বহু যুগ ধরে বহমান, সামাজিকতা সেই শৃঙ্খলার সওয়াল করে। তা মুক্ত চিন্তা ও প্রগতির পরিপন্থী। এক কালে সতীদাহ এবং বিধবাদের পালনীয় অনুশাসন সামাজিক ভাবে স্বীকৃত হলেও তা ছিল অনৈতিক। ভেবে দেখি, লিভ-ইন কাকে বলে? দু’জন প্রাপ্তবয়স্কের একত্রে বসবাস ও সম্পর্ক, বৈবাহিক বন্ধন ছাড়াই। বিয়ে হল এক রকম সামাজিক ও আইনি চুক্তি, যা দুই স্বতন্ত্র সত্তাকে মানসিক, শারীরিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বন্ধনে বেঁধে রাখে। তা ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী হতে পারে, না-ও পারে, তবে ভালবাসার প্রতিশ্রুতিটুকু থাকে। লিভ-ইনও তা-ই, অনেকটা বেশি ব্যক্তিগত। মার্ক্স বলেছিলেন, বুর্জোয়া শ্রেণির কাছে বিবাহ উৎপাদনের মাধ্যম, নারী উপকরণ।
ধর্মমতে বিয়ে, রেজিস্ট্রি বিয়ে, লিভ-ইন— সবেরই পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত। কিন্তু মুক্ত চিন্তা ও প্রগতিভাবনা তা-ই, যা এগিয়ে যাওয়ার বাস্তবতাকে মেনে চলে। কানাডায় লিভ-ইন সামাজিক ভাবে স্বীকৃত। নির্দিষ্ট সময় এক সঙ্গে থাকলে, তা আইনি বিয়ের সমতুল। আমেরিকার দুই-তৃতীয়াংশ যুগলই এখন লিভ-ইনের পর বিয়ে করেন। কেউ বলতে পারেন, পশ্চিমি ধ্যানধারণা ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খায় না। কিন্তু শুধু পশ্চিম নয়, এ দেশেও লিভ-ইন সম্পর্কে থাকা বিখ্যাত মানুষের— লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিক, পরিচালক, ক্রীড়াবিদ— তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। হিন্দু ধর্মে যে আট রকমের বিবাহ প্রথা আছে তার একটি গান্ধর্ব বিবাহ, যেখানে দু’জনের ভালবাসার আকর্ষণই মুখ্য, বিয়ের জন্য ধর্মীয় রীতি, প্রত্যক্ষদর্শী বা পরিবারের অংশগ্রহণের প্রয়োজন নেই। রাজা দুষ্মন্ত ও শকুন্তলার বিয়ে হয়েছিল গান্ধর্ব মতে, আজকের লিভ-ইনের মতোই। সময়ের সঙ্গে মানসিকতার বদলও জরুরি। গ্রামাঞ্চলে এমন সম্পর্ককে সামাজিক ভাবে বয়কট করা হয়। ‘আধুনিক’ শহরেও এ নিয়ে চলে পরনিন্দা-পরচর্চা। রক্ষণশীলেরা প্রশ্ন তুলুন, যুক্তিনির্ভর তর্ক চলুক, কিন্তু এই কু-অভ্যাস বর্জন করা দরকার। সর্বোপরি, আইনের চোখে যা বৈধ, তাকে খোলামনে গ্রহণ করতে পারব না কেন? রিজ়ওয়ানুর ফিরবে না। গিরজাও হয়তো হারিয়ে যাবে। এমন অজস্র বন্ধন, যার মাথায় পরিবারের হাত নেই কিন্তু সামাজিক স্বীকৃতি চায়, সুনাগরিক হয়ে আমরা তাদের পাশে দাঁড়াতে পারব না?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy