Advertisement
E-Paper

তথ্যভান্ডার নামক সোনার খনি

একদা আধার কার্ড বিষয়ে ঘোর সন্দিহান ছিলেন গুজরাতের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তিনি টুইট করে বলেছিলেন, কেউই তাঁকে আধারের অপকারিতা বা উপকারিতা বোঝাতে সক্ষম হয়নি।

সুমন সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০২৫ ০৪:৪৭
Share
Save

সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন জানাল যে, ভুয়ো ভোটার কার্ড ধরতে এ বার থেকে আধারের সঙ্গে ভোটার কার্ডের সংযোগ করতে হবে। এখনও যদিও আইনি মতামত নেওয়া চলছে, তবুও এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে কংগ্রেস। তৃণমূল বলেছে যে, ভুয়ো ভোটার সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান না করে, এই সংযোগ করা যাবে না। অর্থাৎ, সংযোগের ক্ষেত্রে তাদেরও কোনও নীতিগত বিরোধ নেই।

একদা আধার কার্ড বিষয়ে ঘোর সন্দিহান ছিলেন গুজরাতের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তিনি টুইট করে বলেছিলেন, কেউই তাঁকে আধারের অপকারিতা বা উপকারিতা বোঝাতে সক্ষম হয়নি। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে সেই মোদীর সরকারই নির্দেশ দিল যে, প্রতিটি নাগরিকের যে বৈধ সরকার প্রদত্ত পরিচয়পত্র আছে, তার সঙ্গে আধারের সংযোগ করতে হবে। ২০০৯ সালে আধার চালু হয়েছিল। তার পরের পাঁচ বছরে এমন কী ঘটল, কে বা কারা নরেন্দ্র মোদীকে কী মন্ত্র দিলেন যে, তিনি আধারের স্বপক্ষে কথা বলতে শুরু করলেন?

এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে, ২০০৯ সালে যেতে হবে। যখন কংগ্রেস সরকার আধার প্রকল্প এনেছিল, তাদের যুক্তি ছিল দেশের ০.৩ শতাংশ মানুষের কোনও পরিচয়পত্র নেই, তাই তাঁদের একটি পরিচয়পত্রের প্রয়োজন। এ ছাড়াও বলা হল, আধার নাগরিকত্বের পরিচয় নয়। কেউ যদি ১৮২ দিন কোনও একটি জায়গায় থাকেন, তা হলে তিনি একটি আধার নম্বর পাওয়ার যোগ্য। কেউ আধারে নিজেকে নথিভুক্ত করাতেও পারেন, আবার না-ও পারেন। এ ছাড়াও বলা হল, আধার একজন নাগরিককে চেনার উপকরণ। আধারের তথ্যভান্ডারে যে বায়োমেট্রিক এবং ডেমোগ্রাফিক তথ্য সংরক্ষিত আছে, সেই তথ্যের সঙ্গে সেই ব্যক্তির বায়োমেট্রিক মিলে গেলেই, বলা যাবে সেই মানুষটি আসল।

তা হলে আধার নিয়ে সমস্যা কোথায়? প্রথমত, যাঁদের কোনও পরিচয়পত্র ছিল না, তাঁদেরই আধার দেওয়ার কথা হয়েছিল। তবে কেন সব নাগরিককে আধার করাতে বাধ্য করা হল, এবং কেনই বা সেই আধারকে সরকারপ্রদত্ত অন্যান্য পরিচয়পত্রের সঙ্গে সংযোগ করানোর প্রক্রিয়া শুরু হল? সরকারকে কি কেউ বুঝিয়েছিল যে, প্রতিটি নাগরিকের সমস্ত রকমের তথ্য যদি এক জায়গায় করা যায়, তা হলে সেই তথ্যভান্ডার হয়ে ওঠে একটি সোনার খনি? সেই তথ্য দিয়ে যেমন প্রতিটি নাগরিককে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, তেমনই প্রতি মুহূর্তে দেশের সমস্ত নাগরিককে নজরবন্দি করে রাখা সম্ভব। আর, এই ভান্ডার কখনও ফুরোবে না।

সম্ভবত এ কথাও তাঁরা বুঝেছিলেন যে, বেশির ভাগ ভারতীয় নাগরিকের তথ্যের গোপনীয়তা, তথ্যের সুরক্ষা বিষয়ে কোনও ধারণাই নেই, ফলত তাঁদের সমস্ত ধরনের ব্যক্তিগত তথ্য খুব সহজেই পাওয়া সম্ভব এবং বিশ্বের বাজারে তার মূল্যমানও খুব খারাপ নয়। এ ছাড়াও, আধার দেখিয়ে যদি প্যান কার্ড, পাসপোর্ট করা যায় বা ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টের সঙ্গে যদি আধারকে সংযোগ করানো বাধ্যতামূলক করানো যায়, তা হলে আর্থিক দুর্নীতিও করা সম্ভব, যা খালি চোখে দেখাও যাবে না; আবার মানুষের কাছে প্রচারও করা যাবে, আধার এবং ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট সংযোগ থাকার কারণে সরকার প্রচুর টাকা বাঁচাতে পারছে।

সেই সময় থেকেই অভিযোগ উঠছিল যে বহু ভুয়ো আধার তৈরি হচ্ছে। আধার নম্বর দিয়ে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা বা রেশন তুলে নেওয়া বা সরকারি অন্যান্য অনেক আর্থিক সুবিধা ভুয়ো অ্যাকাউন্ট মারফত বেরিয়ে যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছিল, বহু জীবিত মানুষের হাতের ছাপ বা চোখের মণি না মেলার কারণে তাঁরা বঞ্চিত হচ্ছিলেন। এই সমস্ত কারণে আধার নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে মামলা ওঠে। দীর্ঘ দিন শুনানি হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সওয়াল করা হয় যে, আধারের মাধ্যমে মানুষের গোপনীয়তা লঙ্ঘন হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, তখন যদি সওয়াল করা হত যে, আধার প্রকৃতপক্ষে ‘পরিচয় সংক্রান্ত জালিয়াতি’ করার উপকরণ, তা হলে হয়তো সে দিনই আধার বাতিল হত।

প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় সেই শুনানি চলাকালীন বলেছিলেন যে, আধারের বায়োমেট্রিক্সের তথ্য না-মেলার কারণে তাঁর বৃদ্ধ মায়েরও সরকারি পেনশন পেতে অসুবিধা হচ্ছে। শুনানির সময়ে জানা গিয়েছিল সরকার নিজেই আদালতে ৪৯০০০ আধার নথিভুক্তকরণের কেন্দ্র বাতিল করেছে। পরে আধার কর্তৃপক্ষ টুইটও করেছিলেন যে, নানান সময়ে ভুল বায়োমেট্রিক্স এবং ভুয়ো তথ্য দেওয়ার কারণে ৪০০০০ আধার বাতিল হয়েছে। শুধু কি এইটুকু বাতিল হয়েছে, না সংখ্যাটা আরও বেশি, তা কিন্তু আধার কর্তৃপক্ষ খোলসা করে বলেননি। এমনকি শুনানির সময়ে তথ্যে দেখা গিয়েছিল, নানান কারণে প্রায় ১২ শতাংশ আধার যাচাই করা সম্ভব হয় না, কখনও প্রযুক্তিগত ত্রুটি, কখনও বয়সজনিত কারণে বা কাজের ধরনের জন্য এই সমস্যা দেখা যায়।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে কি নকল আধার বা প্যান কার্ড তৈরি করা যায়? সম্প্রতি এই প্রশ্নটি ঘুরপাক খাচ্ছে সমাজমাধ্যমে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহায়তা ছাড়াই কিন্তু বহু ভুয়ো আধার করা হয়েছে এত দিন ধরে। এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহায়তায় কাজটি সহজতর হয়েছে। যতটুকু জানা যাচ্ছে, তাতে উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ আছে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এই প্রক্রিয়ায় প্রতারণার প্রচুর সুযোগ আছে এবং কেন্দ্রীয় সরকার যে ভাবে প্রতিটি মানুষের আধারকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক করেছে, তা আগামী দিনে সমস্যা বাড়াবে বই কমাবে না।

প্রশ্ন হচ্ছে, যে আধারের তথ্যভান্ডার আজ অবধি কোনও দিন অডিট হয়নি, যে তথ্যভান্ডারে কত ভুয়ো আধার আছে তা জানা নেই, যে আধার সংযোগের কারণে সম্প্রতি নানান ভুয়ো প্যান কার্ড বানানো বা পাসপোর্ট বানানো এবং ভোটার কার্ড বানিয়ে নেওয়ার ঘটনা সামনে এসেছে, সেই আধারকে আইন করে ভোটার তালিকায় সংযোগ করাটা কি আদৌ সমর্থনযোগ্য? সবচেয়ে বড় কথা, যে আধার শুধুমাত্র বাসস্থানের পরিচায়ক, সেই আধারকে ভোটার কার্ডের সঙ্গে সংযোগ করানো হলে, ভারতীয় নির্বাচন ব্যবস্থাই তো প্রশ্নচিহ্নের সামনে পড়বে। এটা কি কোনও রাজনৈতিক দল বুঝতে পারছে না, না কি মহারাষ্ট্র বা দিল্লির ভুয়ো ভোটারের ঘটনা সামনে আসার পরেও তাদের টনক নড়েনি?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

PM Narendra Modi aadhaar card Central Government BJP

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}