মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মী মিলিয়ে মোট ২৫,৭৫৩ জনের চাকরি যাওয়ার বিষয়টি তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের পক্ষে আপাতদৃষ্টিতে এক বিশাল বড় ধাক্কা— ত্রিমুখী ধাক্কা। প্রথমত, সরকারি স্কুলগুলিতে এমনিতেই শিক্ষকের অভাব। সরকার-পোষিত বিদ্যালয়গুলিতে ২০২২ সালের মাঝামাঝি মাধ্যমিক স্তরে ১৩,৮৪২টি এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ৫,৫২৭টি শিক্ষকপদ শূন্য ছিল। গত ন’বছরে কোনও নিয়োগ হয়নি। এসএসসি-র অবৈধ নিয়োগের ধাক্কায় প্রায় ২৬,০০০ চাকরি খারিজ হলে বিদ্যালয়গুলিতে কী পরিমাণ অচলাবস্থা তৈরি হতে চলেছে, সম্প্রতিকালে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদ থেকে তা স্পষ্ট। তবে, স্কুলের বাচ্চাদের কোনও ভোট নেই— সুতরাং শাসক দল ভাবতেই পারে যে, ২০২৬-এর বিধানসভা নির্বাচনে এর বিশেষ প্রভাব পড়বে না।
দ্বিতীয়ত, এমনিতেই এ রাজ্যে চাকরি নেই— তার মধ্যে যদি আরও ছাব্বিশ হাজার মানুষের চাকরি যায়, তার নির্বাচনী প্রভাব তৃণমূলের পক্ষে ভাল হবে না। যাঁরা কোনও দিন চাকরি পাননি, বেকার হয়ে বসে আছেন, তাঁদের সে বিষয়ে ক্ষোভ থাকাই স্বাভাবিক— কিন্তু, চাকরি পাওয়ার পরেও সেই চাকরি চলে গেল, এই ঘটনাটি চরিত্রগত ভাবে আলাদা, এবং তার প্রতিক্রিয়া একটু বেশি মাত্রায় জটিল ও ঘোরতর হতে পারে।
তৃতীয় ধাক্কা তৃণমূলের ভাবমূর্তির উপরে। শাসক দলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নতুন নয়। তবে, এ ক্ষেত্রে অভিযোগগুলি আদালতে মামলার শুনানিতে প্রত্যক্ষ ভাবে সামনে উঠে এসেছে। খালি পদের থেকে বেশি নিয়োগপত্র দেওয়া হয়েছে, এই অনিয়মের অভিযোগ প্রথম থেকেই উঠেছিল। পরে দেখা গেল, অনেক ক্ষেত্রেই ভুল ভাবে অপটিক্যাল মার্ক রেকগনিশন বা ওএমআর শিট মূল্যায়নের মাধ্যমে চাকরি দেওয়া হয়েছে। আর, ২৩ লাখ উত্তরপত্রের মধ্যে কোনগুলি সঠিক ভাবে মূল্যায়িত হয়েছে, সে বিষয়ে কোনও স্পষ্টতা নেই। সেই কারণে আদালত, সমস্ত নিয়োগ বাতিল করে, নিয়োগ পরীক্ষার সমস্ত উত্তরপত্র পুনর্মূল্যায়নের নির্দেশ দিয়েছিল। পুনর্মূল্যায়ন সম্ভব হয়নি, কারণ পরীক্ষার এক বছর পরে উত্তরপত্র ধ্বংস করা হয়েছে।
ঘটনা হল, দেশে শিক্ষক নিয়োগে এ ধরনের দুর্নীতি নতুন কিছু নয়। প্রায় দেড় দশক আগে হরিয়ানায় প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমপ্রকাশ চৌটালা এবং তাঁর পুত্র অজয় চৌটালাকে এই গোত্রের দুর্নীতির কারণে কারাবাস করতে হয়েছিল। এক দিকে কর্মসংস্থানের সঙ্কট, অন্য দিকে সরকারি চাকরিতে বেসরকারি চাকরির থেকে অনেক বেশি বেতন, ও অন্যান্য নিরাপত্তা— সব মিলিয়ে সরকারি চাকরির বিপুল চাহিদা। এই অবস্থায় সরকারি চাকরির কালোবাজার যাতে না তৈরি হয়, তার জন্য প্রয়োজন অতিরিক্ত সতর্কতা। পশ্চিমবঙ্গে প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তরে কি এই সতর্কতার অভাব ঘটেছিল?
পশ্চিমবঙ্গে এসএসসি-র ধাক্কা এসেছে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের প্রায় এক বছর আগে। রাজনৈতিক ভাবে খুবই স্পর্শকাতর সময়। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিচক্ষণ রাজনৈতিক নেত্রী। তিনি শুধু ২০১১ সালের নির্বাচনে জিতে দীর্ঘ দিনের সিপিএম শাসনের সমাপ্তি ঘটাননি, তার পর দু’বার নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। উনি বহু সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন, কিন্তু কোনও কিছুই তাঁর নির্বাচনী জয়রথকে নিশ্চল করতে পারেনি। ২০২৬-এ কী হবে, সেটা জানার জন্য সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। ২০১৪ সালে সারদা কেলেঙ্কারি, ২০১৬ সালে নারদা কেলেঙ্কারি, ২০২৩-এ রেশন কারচুপি, ২০২৪ সালে সন্দেশখালি-কাণ্ড এবং আর জি কর-কাণ্ড— একের পর এক এগুলি প্রকাশ্যে এসেছে। অনেক মন্ত্রী, বড় বড় নেতা এবং প্রশাসনিক কর্তা অভিযুক্ত এবং গ্রেফতার হয়েছেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী অনেকটা রাজহাঁসের মতো, সব কিছুর ঊর্ধ্বে থেকেছেন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলতেই পারেন যে, কলকাতার কোনও থানার বড়বাবু কী গোলমাল করছেন, তার দায়িত্ব তাঁর উপরে কেন বর্তাবে? অথবা, কোথাও কোনও নেতা দুর্নীতিগ্রস্ত হলে তার জবাবদিহিই বা মুখ্যমন্ত্রীকে করতে হবে কেন? প্রশ্ন হল, বিধায়করা যদি জানেন যে, বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী বা অন্য কোনও মন্ত্রীর থেকে তাঁরা কোনও জবাব পাবেন না; সাধারণ মানুষ যদি জানে যে, সংসদীয় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তর মিলবে না— তা হলে তাঁরা ‘থানার বড়বাবু’দের কাছে সরাসরি কৈফিয়ত চাইবেন?
স্ক্যান্ডিনেভিয়ার ডেনমার্ক বা সুইডেনের মতো কয়েকটি দেশ ছাড়া রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ প্রায় সব দেশেই রয়েছে। কিছু অভিযোগ বিচারালয়ে প্রমাণিত হয়, এবং অভিযুক্ত নেতাদের আইনানুগ শাস্তি হয়। এই শাস্তির কথা সেই দেশের মানুষ অনেক সময়ই ভুলে যান, এবং মনে করেন যে, বেশির ভাগ নেতাই বিনা সাজায় মুক্তি পেয়ে যান। ভারতও এর ব্যতিক্রম নয়। আমরা ভুলে যাই যে, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীদের মধ্যে ২০০৬ সালে ঝাড়খণ্ডের শিবু সোরেন, ২০১৩ সালে বিহারের লালুপ্রসাদ যাদব এবং হরিয়ানার ওমপ্রকাশ চৌটালা, ২০১৪ সালে তামিলনাড়ুর জয়ললিতা, এবং ২০১৭ সালে ঝাড়খণ্ডের মধু কোটা আইনি বিচারে দোষী সাব্যস্ত হয়ে কারাবাস করতে বাধ্য হন।
২০২৬-এর নির্বাচনের আগে এই স্পর্শকাতর সময়ে এসএসসি-র ঘটনাক্রম তৃণমূলের জন্য কঠিন ধাক্কা। মুখ্যমন্ত্রী ইতিমধ্যেই যে সব প্রার্থী দুর্নীতি না করে শিক্ষক ও অশিক্ষক পদে চাকরি পেয়েছিলেন, তাঁদের চাকরি যাওয়া ও দুর্ভোগের জন্য যাঁরা এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও মামলা করেছিলেন, তাঁদের দোষারোপ করছেন। তাঁর সরকারে যাঁরা দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে অবৈধ ভাবে শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মীদের নিয়োগ করেছিলেন, তাঁদের সম্বন্ধে নির্বাক!
দলে যাই হোক না কেন, মুখ্যমন্ত্রী তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে দুর্নীতির অভিযোগ উঠতে দেন না। তাঁর সরকারে যা ঘটছে তাকে মন্ত্রী, নেতা এবং প্রশাসনিক কর্তাদের দায়িত্ব বলে অভিহিত করেন। জনতার কল্যাণে যা হচ্ছে তার সুফল তিনি সাদরে গ্রহণ করেন, যত গণ্ডগোলের দায়িত্ব মন্ত্রী-সান্ত্রী, প্রশাসনিক কর্তা ও অপরের উপরে ন্যস্ত করে রাজহাঁসের মতো শ্বেত-শুভ্র ভাবমূর্তি বহাল রাখেন। ২০২৬-এও সেটা পারবেন? কে জানে! তিনি ‘খেলা হবে’ বলতে ভালবাসেন। ‘খেল অভি বাকি হ্যায়’! তা ছাড়া, প্রবাদে বলে, ওস্তাদের মার শেষ রাতে!
চিনা ভাষায়, ‘সঙ্কট’ শব্দটি দু’টি হরফের সংমিশ্রণ— একটি ‘সুযোগ’ বোঝায়, এবং অপরটি ‘বিপদ’। এর মাধ্যমে বোঝানো হয়, প্রতিটি সঙ্কটের মধ্যেই একটি অনুকূল পদক্ষেপের সুযোগ লুকিয়ে থাকে। এসএসসি-র ধাক্কা ও তৃণমূলের ভাবমূর্তি সম্বন্ধে আসন্ন অমঙ্গলের লক্ষণের মধ্যে নেত্রী কি নতুন রাজনৈতিক সম্ভাবনার সুযোগ দেখছেন? সেটা অবশ্য তিনি ছাড়া কেউ জানেন না।
বিধায়ক, বিজেপি, পশ্চিমবঙ্গ
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)