‘ললিতা একটা চৌকিতে বসিয়া ঘাড় হেঁট করিয়া দুই লোহার কাঠি লইয়া বুনানির কার্যে লাগিল।’
গোরা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
উল বোনা তো ললিতাদেরই কাজ, হঠাৎ কোনও ললিত তা করলে ভারী গোল বাধে। টোকিয়ো অলিম্পিক্স সোনাজয়ী ব্রিটিশ ডুবুরি (ডাইভার) টম ড্যালের উল বোনা নিয়ে তাই আপাতত তোলপাড় সমাজমাধ্যম।
বাসে, ট্রামে, ট্রেনে, ক্রিকেটের মাঠে মেয়েদের উল বোনা পরিচিত দৃশ্য। আগের থেকে কমে গেলেও সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। কিন্তু আজ অবধি বিশেষ কোনও ছেলেকে পাবলিক প্লেসে উল বুনতে দেখা গিয়েছে কি? ছোটবেলায় এক বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে গিয়ে দেখেছিলাম তার বাবা উল বুনছেন। দেখে ইস্তক— ছেলেদের কাজ, মেয়েদের কাজ সম্পর্কে যে খোপ খোপ ধারণা ছিল, তা ভেঙেচুরে গিয়েছিল। একই রকম ধাক্কা লেগেছিল যখন সেই সময়ে আমাদের মফস্সলি চোখে আধুনিকতার মূর্ত প্রতীক, কৃষ্ণকলিদিকে টিচার্স রুমে উল বুনতে দেখেছিলাম। উল বোনার মতো একটা মেয়েলি কাজ কেন করবেন আমার রোল-মডেল শিক্ষিকা?
এখন ভাবতে হাসি পায়, কিন্তু এই মানসিকতায় জেদ করে সেলাই শিখিনি। ভাগ্যক্রমে মাধ্যমিকে ওয়ার্ক এডুকেশনে বাইরের পরীক্ষক এসেছিলেন এক পুরুষ। তিনি আমার রিকেটি উলের মোজা বা সেলাই না করা তিন দিক আড়াল করা টেবিল-ঢাকার দিকে বিন্দুমাত্র দৃষ্টিপাত না করে রুমালের, উলের টুপির জ্যামিতিক আকার, তার ক্ষেত্রফল নিয়ে প্রশ্ন করতে আরম্ভ করলেন। আমিও হাঁপ ছেড়ে গরুর রচনাকে সানন্দে শ্মশানে নিয়ে গেলাম।
কিন্তু এমন দু’-একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে মেয়েরা তো নিরলস ভাবে দু’টি কাঁটার মধ্যে জীবন বুনে এসেছে এত কাল। শীত কাল কবে আসবে? সেই প্রশ্নের অপেক্ষা না করে সুপর্ণারা হানিকম্ব, সোজাক্রস, উল্টোক্রস, জেব্রাক্রস, গুজরাতি ছক, রংপুরি, বকুলফুল, ঝিনুক, কিরিমিরি, কপি পাতা, সাবু দানা, গোলাপ ফুল, সিঁড়ি ভাঙা ইত্যাদি প্যাটার্ন তুলেছে। শীত পড়লেই কানে আসত কাঁটার নম্বর, কোর প্লাই, ফ্রি প্লাই, সিঙ্গল নিটিং, ডাবল নিটিং, পিয়োর উল, ক্যাসমিয়ার, মেরিনো ধারিওয়াল, লাল ইমলি, চেরা উল, লাছি— এই সব শব্দ। লক্ষ্মীর পাঁচালীর পাশাপাশি ঘরে ঘরে শোভা পেত ‘উল বোনার সহজ পদ্ধতি’ জাতীয় বই।
শুধু বই নয়, বইয়ের বাইরেও প্যাটার্ন তুলতে মেয়েরা কত মরিয়া, তার নজির আছে একটি কৌতুক গল্পে, যেখানে পার্কে বসা একটি যুবক দেখে, তার দিকে এক তরুণী এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে। পুলকে একটু নড়েচড়ে উঠতেই সেই তরুণী হাঁ হাঁ করে বলে “আহা নড়ছেন কেন, আমি কখন থেকে আপনার সোয়েটারের প্যাটার্নটা তোলার চেষ্টা করছি!”
বাংলা সাহিত্যে যে গল্পটি বাইরে কর্মরতা মেয়েদের চিত্রণে পথিকৃৎ হয়ে আছে, নরেন্দ্রনাথ মিত্রের সেই ‘অবতরণিকা’ (যা থেকে পরে মহানগর সিনেমা নির্মাণ করেন সত্যজিৎ রায়), যাতে আরতির কাজ ছিল উল বোনার মেশিন বিক্রি করা। “স্টেশনারি শপ ছাড়াও বম্বে থেকে এক নতুন ধরনের উলের মেশিনের এজেন্সি নিয়েছেন মি মুখার্জি। সে মেশিনে শীতের সোয়েটার আর জাম্পার তৈরি হবে।... আড়াইশো টাকা দামের মেশিন। প্রধানত শখেরই জিনিস। বড় লোকের ঘরে ছাড়া খুব একটা বিক্রি হবে না। মুখার্জি অ্যান্ড মুখার্জি এমন মেয়ে চান যে নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এলেও অভিজাত পরিবারের মেয়েদের সঙ্গে রুচিসম্মত ভাবে আলাপ-ব্যবহার করতে পারবে। যাদের চেহারা চোখকে পীড়িত করে না, আচার ব্যবহার মনকে প্রসন্ন করে, এমন মেয়েদের চেয়েছিলেন মুখার্জি অ্যান্ড মুখার্জি।”
মজার কথা, এই যে হাতে বোনা থেকে মেশিনের বিবর্তন, তা কিন্তু শুরুতেই এক নারীর তীব্র বিরোধিতা পেয়েছিল। যে সে নারী নন, স্বয়ং রানি প্রথম এলিজ়াবেথ। ১৫৮৯ সালে উইলিয়াম লি তৈরি করেন মেকানিক্যাল নিটিং মেশিন স্টকিং ফ্রেম, সেই মেশিনে বোনা মোজা মোটেই পছন্দ হয়নি রানির। তা নাকি রানির গোড়ালির পক্ষে বড়ই কর্কশ, শুধু তা-ই নয়, তাঁর আশঙ্কা ছিল যন্ত্র এসে অনেককে কর্মহীন করবে। সেই সময় লি-র পাশে এসে দাঁড়ান ফ্রান্সের রাজা, আর সেখান থেকে সারা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে এই যন্ত্র।
ধরেই নেওয়া হয়, মেশিনের কার্যপদ্ধতি মেয়েদের জগতের বাইরে। তাই ‘অবতরণিকা’র আরতি স্বামীর আগে খেয়ে কাজে বেরিয়ে গেলে শাশুড়ি বিলাপ করেন, সে কিনা উপার্জন শুরুই করছে একটি বিলাতি যন্ত্রের কলাকৌশল বুঝিয়ে। একটি ধনীগৃহে বাড়ির বৌটি যখন কিছুতেই যন্ত্রটির কাজের পদ্ধতি বুঝতে পারছে না, তখন মৃদু অনুযোগের সুরে আরতি বলে “আপনার তো ভারী মোটাবুদ্ধি”! সেই কথায় রেগে গিয়ে বৌটির শাশুড়ি বলেন তাঁদের মতো ঘরে মেয়েদের একটু কম বুদ্ধি হলেও চলে! অর্থাৎ মেয়েদের কলকব্জা সংক্রান্ত বুদ্ধি থাকার দরকার নির্ভর করে পরিবারের অর্থকৌলীন্যের উপর।
ললিতারা শুধুই শখে বা সময় কাটাতে উল বুনতেন না, উল বোনা, সেলাই হয়ে উঠত স্বাবলম্বনের হাতিয়ার। লীলা মজুমদারের পাকদন্ডীতে আছে “শেষ পর্যন্ত সুরমাকে সরোজনলিনীতে ভর্তি করলাম। সাধারণ লেখাপড়া, দরজির কাজ, কারুকার্য, তাঁত, উল বোনা, ক্রুশ বোনা সবকিছুতে চার বছরে দক্ষ হয়ে উঠল সুরমা। ...সেই ইস্তক নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের বা কারো কাছ থেকে কখনো একটা পয়সা চায়নি এমন তার আত্মপ্রত্যয়।”
শুধুই কি শখ বা স্বাবলম্বন? উল বোনা যে বিপ্লবের আগুন জ্বালতে পারে, তা তো দেখিয়েছে চার্লস ডিকেন্সের আ টেল অব টু সিটিজ়। ঘরের এক কোণে শান্ত ভঙ্গিতে বসে মাদাম দেফার্জ দু’টি নিরীহ কাঁটা দিয়ে যা বুনতেন, তা তো শুধু আরামদায়ক পশমি অঙ্গাবরণ নয়, তা আসলে অত্যাচারীর মৃত্যু পরোয়ানা। ‘মেয়েলি’ হিসাবে চিহ্নিত উলকাঁটায় এই ভাবেই বোনা হয়েছিল শোষিতের প্রতিশোধ নেওয়ার রক্তাক্ত ইতিহাস।
সেলাই মেশিনের কথাই যদি ধরা হয়, তবে পুরুষ দর্জিদের একচেটিয়া ছিল পা-চালানো মেশিন, মেয়েদের জন্যে এল হাতে-ঘোরানো মেশিন। কিন্তু একনাগাড়ে তাতে কাজ করতে গিয়ে তাঁদের কোমরে ব্যথা হতে লাগল। আসলে সেলাই বা উল বোনার মেশিন বানানোর সময় নারীর সুবিধে অসুবিধের কথা কখনওই ভাবা হয়নি। অথচ ১৮৪৬ সালে সেলাই মেশিন আবিষ্কারের পর থেকে সেলাই কলই সেই যন্ত্র, যা মেয়েদের ঘর থেকে টেনে বার করে আনল বাইরে কলকারখানায়। নোংরা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মেশিনের উপর ঝুঁকে কাজ করতে করতে মেয়েদের শরীর ভেঙে পড়ত। তবু মেয়েরা আঁকড়ে ধরেছিলেন সেলাই মেশিন, আর তা নিয়ে কুৎসিত ইঙ্গিত দিতে ছাড়েননি পুরুষ পদার্থবিদরা। পা দিয়ে প্যাডল করার সময় কম্পন ছড়িয়ে তা নারীকে দেয় যৌন তৃপ্তি, এই রকম একটা তত্ত্বও তাঁরা খাড়া করতে চেয়েছিলেন।
জেন্ডার ও প্রযুক্তির বিষয়ে আলোচনার সময় অর্থনীতিবিদ নাজনীন আহমেদ বলছিলেন, “আমাদের অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছে আমাদের তৈরি পোশাকশিল্প কারখানা, যেখানে ৯০ ভাগই নারী শ্রমিক। কিন্তু দুঃখের বিষয়, কারখানার যন্ত্রপাতির সবই নারীবান্ধব নয়। নারীর শারীরিক গঠন, বিশেষ করে সন্তানসম্ভবা নারীর জন্য তা মোটেই উপযোগী নয়।”
আসলে নারীর যন্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে শিয়ালের বাসায় বকের নেমন্তন্ন খাওয়া চলেছেই। উল বোনা মেয়েদের নিয়ে কম হাসাহাসি হয় না। অফিস ছুটি থাকায় সোয়েটার বোনা শেষ হয়নি, এমন কটাক্ষের শিকারও নারীই। কিন্তু কে কবে উল-কাঁটাকে তাদের জন্যে আর একটু আরামপ্রদ করার কথা ভেবেছেন? টম ড্যালের জন্য অবস্থাটা বদলাবে কি?
কিংবা স্ত্রীর পিঠে আধবোনা সোয়েটার ফেলে মাপ বুঝে নিচ্ছেন স্বামী— এই রকম কোনও বিজ্ঞাপন? বলা যায় না, দেখতেও পারি খুব শিগগির!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy