২০১৫ সালে কানাডার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর জাস্টিন ট্রুডো প্রথম যে ক’টা কাজ করেছিলেন, তার মধ্যে ছিল একটি ডেস্ক, সরকারি গুদামখানা থেকে উদ্ধার করা। কানাডার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী পিয়ের ট্রুডোর সেই ডেস্কখানা তাঁর পুত্র জাস্টিন কানাডার রাজধানী অটোয়ার পার্লামেন্ট হিল-এ নিজের অফিসে বসান। পিয়ের ট্রুডো প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ১৯৬৮-৭৯, এবং ১৯৮০-৮৪। কানাডাকে আমেরিকার ছায়া থেকে বার করে একটি স্বতন্ত্র, স্বাধীন পরিচিতি দেওয়ার যে চেষ্টা তিনি করেছিলেন, তার জন্য কানাডার প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে তাঁর একটি বিশিষ্ট স্থান তৈরি হয়েছিল। বাবার ডেস্কে বসে জাস্টিন হয়তো বাবার মাপের রাজনীতিবিদ হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। পর পর তিন বার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন জাস্টিন। কিন্তু তৃতীয় বার সরকারের রাশ ধরে রাখতে পারলেন না।
জাস্টিন ট্রুডোকে তাঁর দেশের ইতিহাস কী স্থান দেবে, তা বলার সময় এখনও আসেনি। তবে বেশ কয়েক মাস দোলাচলের পর যখন ট্রুডো ঘোষণা করলেন যে, তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ এবং লিবারাল পার্টির নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়াবেন, তখন তাঁর সমালোচক আর সমর্থক, দু’মহলেই স্বস্তি দেখা গেল। ভারত যে খুশি, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। জাস্টিন ট্রুডোর বিদায়-সংবাদ আশা জাগিয়েছে যে, এ বার দু’দেশের সম্পর্কে উন্নতি হবে। গত বছর সেপ্টেম্বর থেকে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে দ্রুত অবনতি এসেছে। কারণ, কানাডার প্রবাসী শিখদের মধ্যে সব চাইতে বেশি ভারত-বিরোধী, সন্ত্রাসবাদী অংশকে খোলাখুলি সমর্থন করছিলেন ট্রুডো। তাঁর বিদায়ের পরে খলিস্তানিদের প্রতি কানাডার সমর্থন কমবে, এমন আশা জেগেছে ভারতের ওয়াকিবহাল মহলে।
বেশ কিছু দিন ধরেই কানাডাকে ভারত অনুরোধ করে চলেছে, সে দেশের মধ্যে খলিস্তানিদের কীর্তিকলাপে রাশ টানতে। কিন্তু কানাডা কোনও পদক্ষেপ করতে রাজি হয়নি। তাদের যুক্তি, খলিস্তান-সমর্থকরা হিংসাত্মক কার্যকলাপে জড়িত নয়, তাই তাদের কাজকর্ম সে দেশের গণতন্ত্রকে আঘাত করছে না। ভারত অবশ্য এই অবস্থানের মধ্যে ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতিই দেখেছে। সংখ্যালঘু সরকারকে ক্ষমতায় রাখতে ট্রুডোকে অনেকটাই নির্ভর করতে হচ্ছে শিখদের সমর্থনের উপরে। শিখদের তুষ্ট না রেখে তাঁর উপায় কী?
কানাডার চার কোটি জনসংখ্যার মধ্যে তেরো লক্ষ ভারতীয়। যদিও হিন্দুদের সংখ্যা শিখেদের চাইতে কিছুটা বেশি, তবে শিখেরা সাধারণত ঐক্যবদ্ধ ভাবে ভোট দেয়, হিন্দুরা দেয় না। তাই শিখেরা কানাডার রাজনীতিতে নিজেদের ওজন বাড়াতে পেরেছে।
গত সেপ্টেম্বরে ট্রুডো কানাডার পার্লামেন্টে বলেন যে কানাডার এক শিখ নাগরিকের হত্যার সঙ্গে ভারতের সংযোগ বিষয়ে তাঁর কাছে গোয়েন্দাসূত্রে প্রাপ্ত ‘বিশ্বাসযোগ্য’ তথ্য রয়েছে। দু’দেশের সম্পর্কের উপর তাঁর এই কথার তীব্র প্রভাব পড়ে। ভারত অভিযোগ অস্বীকার করে, এবং কানাডার কাছে তথ্য দাবি করে। কানাডার সরকার দাবি করেছে যে, নরেন্দ্র মোদী সরকারের প্রবীণ নেতাদের সঙ্গে তথ্য ভাগ করে নেওয়া হয়েছে। তবে ভারত সরকারের বক্তব্য, যা পাওয়া গিয়েছে তা যথেষ্ট নয়। ওই তথ্যের ভিত্তিতে ওই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ভারতের সংযোগ প্রতিষ্ঠা করা যায় না।
লক্ষণীয়, নিহত কানাডার নাগরিক ছিলেন ভারতে নানা সন্ত্রাসবাদী ঘটনায় অভিযুক্ত খলিস্তানি নেতা। তাঁর হত্যাকে ঘিরে দু’দেশের সরকারের সংঘাতের পরিণামে একে অপরের হাই কমিশনার এবং অন্য কূটনীতিকদের বহিষ্কার করে, কূটনৈতিক সম্পর্কেও অনেক কাটছাঁট হয়। দু’দেশই নিজের নাগরিককে নিরুৎসাহ করে অপর দেশে যাত্রার থেকে। ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় থমকে যায়। দিল্লির মনোভাব কানাডার প্রতি রুষ্ট— ভারতে সন্ত্রাসবাদ ও বিচ্ছিন্নতা ওস্কানোর জন্য পাকিস্তান আর কানাডার নাম এক সঙ্গে উচ্চারিত হতেও শোনা গিয়েছে দিল্লিতে।
অথচ, ভারত ও কানাডার মধ্যে সম্পর্কে সম্প্রীতি ও সহযোগিতা ছিল যথেষ্ট। পঞ্চাশের দশকে নাগরিক ব্যবহারের জন্য ভারতকে পরমাণু বিদ্যুৎ তৈরির সরঞ্জাম দেয় কানাডা। তবে ভারত পরমাণু বোমা তৈরির জন্য প্রযুক্তি ব্যবহার করার পর (১৯৭৪) সম্পর্কে অবনতি হয়। সঙ্কট বাড়ে যখন কানাডা থেকে ওড়ার পর খলিস্তানি সন্ত্রাসবাদীরা এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান ‘কনিষ্ক’ উড়িয়ে দেয় মাঝ-আকাশে (১৯৮৫)। ২০১০ সালে সম্পর্কে ফের মোড় ঘোরে, যখন পরীক্ষামূলক পারমাণবিক বিস্ফোরণের জন্য ভারতের উপর পশ্চিমের দেশগুলির নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়। দুই দেশ পরমাণু শক্তি উৎপাদনে সহযোগিতা বিষয়ে চুক্তি করে, বাণিজ্য চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়।
কানাডার আট লক্ষ বিদেশি ছাত্রছাত্রীর প্রায় চল্লিশ শতাংশই ভারতীয়। কিন্তু কূটনৈতিক সম্পর্কে অবনতির পরে ভারতীয়দের ভিসা পাওয়ার পদ্ধতি আগের চাইতে কঠিন করেছে কানাডা। বিদেশি পড়ুয়াদের সংখ্যাও কমিয়ে দিচ্ছে তারা, কমবে ভারতীয় ছাত্রছাত্রীও। কানাডায় শাসক দল বদলালে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে উন্নতি হবে, এমন আশা করা হচ্ছে। তবে কানাডায় খলিস্তানিদের কাজ-কারবার কমবে কি না, তা অনিশ্চিত। কানাডার অর্থনীতির সঙ্কট, আবাসন সঙ্কটের মোকাবিলা করতে না পারলে কনজ়ারভেটিভ দলও জনমোহিনী রাজনীতির দিকে ঝুঁকতে পারে, চরমপন্থীদের প্রতি নরম মনোভাব দেখাতে পারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy