Advertisement
১৮ জানুয়ারি ২০২৫
বাংলা ও তিব্বতের মধ্যে খোলামেলা সম্পর্কের দীর্ঘ ইতিহাস
Bengal-Tibet

সিধে রাস্তার পথ, তিব্বত

ভারতীয়রা বেশির ভাগ সময়ে নেপাল হয়েই এভারেস্ট বিজয়ে যান। কারণ, চিনের রাস্তা বেয়ে উঠতে গেলে অনেক বেশি ডলার গুনাগার দিতে হয়।

ধ্বস্তভূমি: ভূমিকম্পের পরের দৃশ্য, শিগাৎসে, তিব্বত, ৭ জানুয়ারি।

ধ্বস্তভূমি: ভূমিকম্পের পরের দৃশ্য, শিগাৎসে, তিব্বত, ৭ জানুয়ারি। ছবি: রয়টার্স।

গৌতম চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১৮ জানুয়ারি ২০২৫ ০৬:২০
Share: Save:

রিখটার স্কেলে ৬.৮ মাত্রার ভূমিকম্প মানে? কতটা প্রবল হতে পারে সে কম্পন? কলকাতার সঙ্গে পুরনো সম্পর্কের ইতিহাস, ভূগোল সবই কি তছনছ হতে পারে তাতে?

প্রশ্নটা মাথায় এল এভারেস্ট অঞ্চলে চিনের সাম্প্রতিক কম্পনে। চিনের ওই দিক থেকে এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে পৌঁছনো সহজ, মাত্র এক দিন লাগে। রংবুক নামে এক গুম্ফাও আছে সেখানে, লামারা শান্তিস্বস্ত্যয়ন ও পুজোপাঠ করেন। দুনিয়ার সবচেয়ে উঁচু বৌদ্ধ মঠ।

দক্ষিণে নেপাল থেকে বেস ক্যাম্পে পৌঁছনোর প্রচলিত রাস্তাটা অনেক দীর্ঘ। বড় বড় হিমবাহ ভেঙে পড়ার খুম্বু এলাকা পেরিয়ে লোৎসে শৃঙ্গের মুখোমুখি চলতে চলতে সাউথ কল, ধাপের মতো হিলারি স্টেপ পেরিয়ে তার পর ২৯০২৮ ফুটের সেই উচ্চতম শৃঙ্গে আরোহণ। চলন্ত হিমবাহ, বরফ-আচ্ছাদিত বিস্তীর্ণ ভূভাগ সব মিলিয়ে সেই পথ ভয়ঙ্কর সুন্দর।

ভারতীয়রা বেশির ভাগ সময়ে নেপাল হয়েই এভারেস্ট বিজয়ে যান। কারণ, চিনের রাস্তা বেয়ে উঠতে গেলে অনেক বেশি ডলার গুনাগার দিতে হয়। ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাঙালির প্রথম দুই এভারেস্টজয়ী বসন্ত সিংহরায় ও দেবাশিস বিশ্বাস প্রথমে চিনের দিক থেকে এভারেস্ট ওঠা স্থির করেছিলেন, তার পর খরচের বহর শুনে নেপালের প্রচলিত পথ। নেট খুললেই দেখবেন, পর্যটনে চিনের হৃদি ভেসে যায় এভারেস্টপথে। রংবুক মনাস্ট্রি বা এভারেস্ট বেস ক্যাম্প অবধি গাড়ি যাওয়ার বন্দোবস্তও করে ফেলেছে তারা।

ভূমিকম্পটা এই অঞ্চলেই। সরকারি ভাবে মৃত ১২৬, আহত ১৮৮। এত লোক তো এভারেস্টে থাকতেন না। তাঁরা থাকতেন শিগাৎসে শহরে। লাসার পর স্বশাসিত তিব্বত এলাকার অন্যতম বড় শহর। সেখান থেকে ছোট্ট শহর গিয়ানৎসে হয়ে স্বল্প সময়ে নাথু লা চলে আসা যায়। সেই রাস্তা এখন নেই, নাথু লা হয়ে চিন-সীমান্ত আজও খোলেনি। বাঙালি পর্যটকরা গিয়ে দেখেন, কাঁটাতারের ও-পাশে বাঙ্কার। মেশিনগান-ওঁচানো চিনা সৈন্যরা সেখান থেকে বন্ধুত্বের হাত নাড়েন, এ-পাশ থেকেও হাতের মুদ্রায় সেই সৌহার্দের উত্তর দেখানো হয়। দলাই লামা ১৯৫৯-এ ভারতে আসার কয়েক মাসের মধ্যে হাজার হাজার শরণার্থীর সঙ্গে ছোমব্রে নামে এত তিব্বতিও ভারতে চলে আসেন। কালিম্পঙে তাঁর একটি রেস্তরাঁ ছিল, তার দেওয়ালে তিব্বতের একটি রিলিফ ম্যাপ। স্কুল ছুটির পর পড়ুয়ারা সেখানে মোমো, চাউ ইত্যাদি খেতে আসত। ছোমব্রে আড্ডা মারতে মারতে হতাশ স্বরে বলেছিলেন, “রাস্তাটা খোলে না কেন বলুন তো! নাথু লা খুলে গেলে দেখবেন, কলকাতা থেকে গ্যা‌ংটক আসতে যত সময় লাগে, ততটা সময়েই এখান থেকে শিগাৎসে, তার পর লাসা! আপনাকে নিয়ে যাব, কেমন?”

রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নামক জরদ্গব দানবটির খেয়ালে ছোমব্রে বা আমার সেই ইচ্ছা আর পূরণ হয়নি। তবে নাথু লা পেরিয়ে তিব্বতে ঢোকার পরই ছিল গিয়ানৎসে নামে এক ছোট্ট জনপদ। ব্রিটিশরা সেখানে একটি টেলিগ্রাফ অফিসও বসিয়েছিল। রাহুল সাংকৃত্যায়ন প্রথম বার তিব্বত সফর শেষে ওই পথেই ফিরেছিলেন। তাঁর তিব্বতে সওয়া বছর বইয়ে তার বিশদ বিবরণ আছে।

এই গিয়ানৎসে-র পরই শিগাৎসে। সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত শহর। তছনছ হয়ে যাওয়া বাড়ি, আর্ত চিৎকার, বেলচা হাতে হেলমেট মাথায় উদ্ধারকারী দলের ছুটোছুটি। জানুয়ারির শীতে আপাতত ওই এলাকায় তাপমাত্রা মাইনাস ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিছু দিন বাদে মাইনাস ১৬ ডিগ্রিতে পৌঁছবে। চিনের সংবাদ সংস্থা জিন হুয়ার খবরে জানলাম, বেশির ভাগ মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতি শহরের তিব্বতি এলাকায়।

তিব্বতি এলাকা? এই ভারতকে আপন করে নেওয়া, প্রয়াত এক ব্রিটিশ লেখকের কথা মনে পড়ল। প্যাট্রিক ফ্রেঞ্চ। গত শতকের ৮০-৯০ দশকেও প্যাট্রিক নির্বাসিত দলাই লামার শহরে হিমাচলের ম্যাকলিয়ডগঞ্জের বাসিন্দা। চিনের থেকে তিব্বতের মুক্তি দাবি করা ‘ফ্রি টিবেট সোসাইটি’র সম্পাদক। ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’, ‘মেষ চর্মাবৃত হিংস্র নেকড়ে’ দলাই লামার নাম নিলে বা ‘বো রাংস্তেন’ বা তিব্বত স্বাধীন হোক স্লোগান দিলে কী ভাবে উল্টো ঝুলিয়ে ইলেকট্রিক ব্যাটন দিয়ে পেটানো হত, নখ উপড়ে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হত, সে সব অত্যাচারের অনেক স্মাগলড ছবি ও লেখা আসত।

এই অত্যাচারিত তিব্বতি জীবন জানতেই প্যাট্রিক এক দিন তাঁর ব্রিটিশ পাসপোর্টের দৌলতে তিন মাসের তিব্বত সফরে বেরিয়ে পড়েন। শিগাৎসে শহরে তিনি অবাক। বিদেশি পর্যটকদের ভিড়ে ভর্তি রাজধানী লাসা শহর তো সভ্যভব্য, দলাই লামার নাম নেওয়া নিষিদ্ধ, এটুকুই। আর হিমালয় অঞ্চলের শিগাৎসে? এখানেই পাঞ্চেন লামার তাশি লুনপো মঠ। কিন্তু শহরের চিনা এলাকায় উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক আলো, পানশালা থেকে ডিস্কোথেক সব বিনোদন মজুত। তিব্বতি এলাকা অন্ধকার, ঠেসাঠেসি বাড়িঘর, অপরিষ্কার, জঞ্জাল ও দুর্গন্ধে ভরা রাস্তা। এক দল নাগরিককে দেশের শাসক কী ভাবে ইচ্ছাকৃত বৈষম্যের অন্ধকারে, ন্যূনতম সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত করে রাখতে পারে, শিগাৎসেই তার উদাহরণ। তবে ঘাবড়াবেন না, এ দেশে গণতন্ত্র চলছে।

পাঞ্চেন লামার শিগাৎসে শহরের আরও একটি বৈশিষ্ট্য আছে। লামাতন্ত্রে দলাই লামা দেশের ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় প্রধান। পাঞ্চেন লামা ধর্মীয় প্রধান। দলাই লামা বয়সে ছোট হলে পাঞ্চেন লামা তাঁকে আশীর্বাদ করে ধর্মীয় শিক্ষা দেন। পাঞ্চেন লামা বয়সে ছোট হলে আবার উল্টোটা। চতুর্দশ দলাই লামার বছর কুড়ি আগে গত পাঞ্চেন লামার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর আগে বেশ কয়েক বছর চিনের কারাগারে থাকতে হয়েছিল তাঁকে। এখন, দলাই লামার মৃত্যু হলে কোন বালককে তাঁর জায়গায় অভিষিক্ত করতে হবে, সেই সার্চ পার্টিতে পাঞ্চেন লামা থাকেন। পাঞ্চেন লামার ক্ষেত্রেও সে রকম। যাঁরা লামাতন্ত্রকে শুধুই শোষণ আর অত্যাচারের হাতিয়ার হিসাবে দেখেন, তাঁরা ভিতরের এই ধর্মীয় বন্দোবস্তটি জানেন না।

পাঞ্চেন লামার মৃত্যুর পরও সার্চ পার্টি তৈরি হয়, ম্যাকলিয়ডগঞ্জে বসে চতুর্দশ দলাই লামা গেদুং চোকি নিয়েগমা নামে এক বালককে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করেন। চিন অন্য একটি সার্চ পার্টি তৈরি করে, সেখানে পাঞ্চেন লামা হয় অন্য এক বালক। অতঃপর গেদুং চোকি নিয়েগমাকে নিয়ে যাওয়া হয় জেলখানায়, আজও খবর মেলেনি। সম্ভবত, গেদুং-ই দুনিয়ার সর্বকনিষ্ঠ রাজনৈতিক বন্দি। ইজ়রায়েল-প্যালেস্টাইন, আবু ঘ্রাইবের এই যুগেও!

টুরিস্ট অধ্যুষিত লাসা নয়, দলাই লামাও নয়। আধুনিক ভারতের সঙ্গে তিব্বতের প্রথম যোগাযোগ শিগাৎসে-র এই তাশি লুনপো গুম্ফা ও পাঞ্চেন লামার সঙ্গে। ১৭৭০ সাল। অষ্টম দলাই লামা নিতান্ত বালক। কলকাতা থেকে বড়লাট ওয়ারেন হেস্টিংস দূত পাঠাতে চেয়ে লাসায় চিঠি দিলেন। চিন তখনও বড়সড় হিংসুটে দৈত্য, লাসার শাসক তথা দলাই লামার অভিভাবকেরা তার ভয়ে ব্রিটিশ বড়লাটকে সটান না করে দিলেন।

কিন্তু তিনি, ওয়ারেন হেস্টিংস কি অত সহজে হার মানার পাত্র? রাশিয়া যাতে তিব্বত দিয়ে ভারতে ঢুকতে না পারে, তাঁকেই দেখতে হবে। ১৭৭৪ সালে তাই হেস্টিংসের প্রতিনিধি হয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জর্জ বোগলে হাজির হলেন শিগাৎসে শহরের তাশি লুনপো মঠে, পাঞ্চেন লামার দরবারে। ‘চমৎকার সৌহার্দের সঙ্গে আমাকে অভিবাদন করলেন। আমি কার্পেটের উপর উঁচু টুলে বসে, সামনে ভাত, মাংস, শুকনো ফল, মিষ্টি আর চা। লামা আমাদের সঙ্গেই চা খেলেন। কথাবার্তায় চমৎকার, বেশ হাসিখুশি,’ লিখছেন বোগলে। আধুনিক ভারত আর তিব্বতের ওই প্রথম যোগাযোগ।

‘বাংলা আর তিব্বতের অধিবাসীদের মধ্যে খোলামেলা সম্পর্কের সেতু তৈরিই আমার উদ্দেশ্য,’ পাঞ্চেন লামাকে লিখছেন হেস্টিংস। পুরো চিঠিটা ফারসি ভাষায় লেখা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজত্বে ফারসি তখনও শাসকের ভাষা। উর্দু আর ফারসি মানেই বিজাতীয় মুসলমানি ভাষা, এই অন্ধকার থেকে মুক্তি পেতেও এই ইতিহাসজানা জরুরি।

তিব্বতের কোন ইতিহাসকেই বা আমরা গুরুত্ব দিলাম? বাঙালি খুব অতীশ দীপঙ্করকে ভক্তি করে। অতীশ প্রথমে যান তিব্বতের গুজে রাজ্যের থোলিং মহাবিহারে। সেখানেই তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ বোধিপথপ্রদীপ রচনা। গুজে রাজ্যটি মুসলমান-অধ্যুষিত উইগুর রাজ্যের পাশে। দেশে ফিরতে না পেরে অতীশ শেষে ছিলেন লাসার কাছে নিয়েতাং মঠে। সত্তর দশকে মাওয়ের নেতৃত্বে চিনে যখন বৌদ্ধ মঠের বিনাশ চলছে, কলকাতার বাঙালি কিচ্ছু করেনি। শুধু সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশ আর্তি জানায়, ‘দোহাই, নিয়েতাংকে রেহাই দিন। ওটি আমাদের কাছে পবিত্র স্মৃতি।’ মাও ছোট্ট মঠটিকে রেহাই দেন।

আজকের ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে এই আর্তি ভুললেও চলবে না।

অন্য বিষয়গুলি:

History earthquake
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy