প্রলয়: তাড়োবার অগরজ়ারী এলাকায় শিকারে বেরিয়েছে ছোটি মধু। ছবি: নীলাঞ্জন গঙ্গোপাধ্যায়।
রাজস্থানের অলওয়ার জেলার রেণী। নিরুপদ্রব এলাকা। রয়েছে গনগনে কিছু সর্ষেখেত। শহুরেরা এলেই সেখানে দু’হাত ছড়িয়ে নায়কের ভঙ্গিতে ছবি তোলেন। বছরের প্রথম দিনে, বিকেলের সোনালি রোদে সেই খেত থেকেই অতর্কিতে বেরিয়ে আসে দুর্দান্ত এক বেঙ্গল টাইগার। তখন বাংলা সফরান্তে ওড়িশায় ফিরেছে জ়িনত বাঘিনি, নিশ্চিন্ত জঙ্গলমহল। ঠিক সে সময়ই দেশের এই পশ্চিম প্রান্তে বনকর্মী ও গ্রামবাসীরা নির্ঘুম টি-২৪০২’এর তাণ্ডবে। রাজস্থানের সরিস্কা টাইগার রিজ়ার্ভ থেকে বেরিয়ে প্রায় ৬০ কিলোমিটার হেঁটে জাঁহাবাজ বাঘটি পৌঁছে গিয়েছিল দৌসা। পথে তিন গ্রামবাসীকে আহত করেছে। উদ্ধারকারী দল অচেতন করতে এলে খেপে গিয়ে তাঁদের গাড়ির উইন্ডস্ক্রিন ভেঙে আক্রমণেরও চেষ্টা করেছে। সেই সপ্তাহেই জম্মু ও কাশ্মীরে সেনার তোলা ছবিতে বাঘ দেখা গিয়েছে, একেবারে নিয়ন্ত্রণরেখার কাছে! বনদফতরের দাবি, ছবিটি জাল। কিন্তু ব্যাঘ্রবিদ ধর্মেন্দ্র কান্ডাল বলেছেন, সত্যিও হতে পারে। উত্তরাখণ্ডের রাজাজি ন্যাশনাল পার্কের একটি বাঘ হরিয়ানা হয়ে হিমাচল পেরিয়ে চলে গিয়েছিল। পীরপঞ্জালের ছবির বাঘটি সে-ই হলে দু’বছরে ৫০০ কিমি পেরিয়েছে।
অর্থাৎ, ওড়িশার সিমলিপাল থেকে ঝাড়খণ্ড হয়ে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া পর্যন্ত জ়িনতের প্রায় ৩০০ কিমি পার কোনও বিরল, বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সঙ্গীর খোঁজে বা ‘টেরিটরি’-র সন্ধানে লম্বা চলন বাঘেদের স্বাভাবিক বৃত্তি। বন্যপ্রাণপ্রেমীমাত্র এমন অনেক গল্প শোনান যেখানে বাঘ হাজারো কিলোমিটার হেঁটেছে। সকালের জঙ্গলভ্রমণে ঘুমোতে দেখা বাঘ সন্ধেয় পর্যটকের রাত্রিনিবাসের পাশেই টহল দিচ্ছে— এই আতঙ্কের স্পর্শ পেয়েছি নিজে। তবে আপাতত আকর্ষণ ও উত্তেজনার কেন্দ্রে জ়িনত। কেন সে এতখানি হাঁটল? সিমলিপাল বা ওড়িশা সরকারের উদ্দেশ্যে খুঁত নেই। আরও কিছু বনের মতো এখানেও বাঘেদের মধ্যে ইনব্রিডিং-এর (অন্তঃপ্রজনন) সমস্যা। মেলানিস্টিক (কালো) বাঘেদের সংখ্যাধিক্যই তার প্রমাণ। জিন বৈচিত্রের উন্নতির খাতিরে মহারাষ্ট্রের তাড়োবা-অন্ধারী ব্যাঘ্র প্রকল্প থেকে যমুনা ও জ়িনতকে আনা হয়। যমুনাকে সিমলিপালের দক্ষিণে ছাড়া হয়েছিল, সেও বালেশ্বরের কুলডিহা পর্যন্ত চলে গিয়েছিল। প্রায় ১০০ বর্গকিমি হাঁটাহাঁটি করে সে মোটামুটি সিমলিপালের গণ্ডির মধ্যেই রয়েছে।
জ়িনতকে বনের উত্তরভাগে ছাড়া হয়েছিল, আন্তঃরাজ্য সীমানার কাছেই। ওদের জন্মস্থান তাড়োবা পর্ণমোচী উদ্ভিদের জঙ্গল। মূলত সমতল শুকনো ন্যাড়া বন। আর সিমলিপাল চিরহরিৎ অরণ্য, বন্ধুর এলাকা। আকাশপথে ঘুমন্ত অবস্থায় এসে ভিন্ন ভূপ্রকৃতি দেখে বাঘিনিদের বিভ্রান্ত হওয়ারই কথা। সদ্যযুবতী বাঘিনি পুরুষ বাঘেদের প্রায়ই এড়িয়ে যায়, এখানে অজানা এলাকায় অচেনা বাঘের ঘ্রাণে আরও সিঁটিয়ে গিয়েছে। সিমলিপালের বাঘিনিদের উপস্থিতি টের পেয়ে সতর্কও হতে পারে, কারণ বাঘিনিরা নিজেদের মধ্যে এলাকা দখলের মারপিট করে। বাঘেরা অনর্থক ছোটাছুটি, ঝামেলা পছন্দ করে না। এত ঝঞ্ঝাট এড়াতে জ়িনত ওই এলাকা ছেড়ে এগিয়ে দেখতে চেয়েছে। সিমলিপাল লাগোয়া ঝাড়খণ্ডে, বেলপাহাড়িতে বন ঘন হয়েছে। শিকারে রাশ টানায় খরগোশ, বনশূকর ভালই। লোকালয়ের পাশ দিয়ে এগিয়েছে, ছাগল পেয়েছে। এতে হরিণ ধরার চেয়ে পরিশ্রমও কম। বিচরণের উৎসাহ বেড়েছে। হয়তো নিজের পুরনো জঙ্গলকেই খুঁজতে আরও এগিয়েছে, মহারাষ্ট্রের বদলে যে পশ্চিমবঙ্গে এসে পড়েছে— জানবে কোত্থেকে?
অভিযোগ উঠছে, বাঘিনিদের জন্য ওড়িশা সরকার যথেষ্ট প্রস্তুতি নেয়নি। ওদের ৭-১০ দিন সফ্ট এনক্লোজ়ার-এ (বড় ঘেরাটোপ, বেড়া প্রচ্ছন্ন) রেখেই কোর জঙ্গলে ছেড়ে দেয়। ধীরে ধীরে ঘেরাটোপের পরিধি বিস্তৃত করে জঙ্গলে ছাড়লে জলহাওয়া, ভূপ্রকৃতি, বন-বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো সহজ হত। আগেও বাঘ স্থানান্তরকরণে অসফল হয়েছে ওড়িশা। ২০১৮-য় মধ্যপ্রদেশের কানহা থেকে মহাবীর ও বান্ধবগড় থেকে সুন্দরীকে এনে সাতকোশিয়ার ব্যাঘ্র প্রকল্পকে পুনঃসঞ্জীবনের চেষ্টা হয়েছিল। মহাবীরকে চোরাশিকারিরা মারে। সুন্দরী নাকি দু’জন মানুষ মারে। তাকে বান্ধবগড় ফিরিয়ে নেয়। এ বারেও যমুনার পায়ের ছাপ আতঙ্ক ছড়িয়েছে কপ্তিপদা রেঞ্জ সংলগ্ন লোকালয়ে। রয়েছে জ়িনতকে চোরাশিকার থেকে বাঁচানোর চ্যালেঞ্জও।
আসলে বাঘ স্থানান্তরকরণ খুবই স্পর্শকাতর বিষয়। আমরা যতটা ভাবি বাঘ তার চেয়ে ঢের বেশি বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন প্রাণী। সরিস্কা বাঘশূন্য হলে সেখানে বাঘ পাঠানোর কারণে রণথম্ভোরের বাস্তুতন্ত্রে ও বাঘেদের আচরণে প্রভাব পড়েছিল। এতে সরিস্কায় বাঘ বাড়লেও সেখানে সমস্যা অনন্ত। বদমেজাজি টি-২৪০২’এর মতো বাঘেদের বেরিয়ে পড়ার দুর্ঘটনা আকছার। তাই, শ্বাপদের জীবনচক্রে মানুষের হস্তক্ষেপ বাঘবিশারদদের অপছন্দ। এতে প্রকৃতির সাম্য বিঘ্নিত হয়। কোনও জঙ্গলের বাঘসংখ্যা ধারণক্ষমতা ছাপিয়ে গেলে তাদের ধরেবেঁধে কম বাঘের জঙ্গল বা যেখানে নতুন বাঘ প্রয়োজন সেখানে নিয়ে যাওয়ার বদলে বাঘেদেরই বন থেকে বনে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ দিতে হবে। তার জন্য, বিভিন্ন জঙ্গলের মধ্যে সংযোগকারী অরণ্য-আচ্ছাদনকে মানুষ ও শ্বাপদ উভয়ের জন্য নিরাপদ করে তুলতে হবে। যাকে বলে বাঘ করিডর।
গত অক্টোবরে ছত্তীসগঢ়ের অচানকমার অভয়ারণ্যে এক নতুন বাঘের তথ্যপঞ্জি মিলিয়ে দেখা যায়, সে ৪০০ কিমি দূরের মধ্যপ্রদেশের পেঞ্চের বাসিন্দা। পেঞ্চ-কানহা, কানহা-অচানকমার করিডর ধরে এই জঙ্গলে এসেছে। গত বছরও বান্ধবগড়ের বাঘ ছত্তীসগঢ়ের জঙ্গল, ঝাড়খণ্ডের পালামৌ ঘুরে সিমলিপালে এসেছিল। তেমনই সাতকোশিয়া-সিমলিপাল-ঝাড়খণ্ডের করিডর আবার জেগে উঠেছে জ়িনতের গর্জনে, তার নিশান ধরে নতুন বাঘের আনাগোনার খবর মিলছে জঙ্গলমহলে।
আগেই আলোচিত (‘এখানে বাঘের ভয়’, ২৮-৭), সবই প্রোজেক্ট টাইগার-এর সাফল্যের চিহ্ন। সরকারি হিসাবেই দশ বছরে বাঘ বেড়েছে ৭৫%। সূত্রের দাবি, সংখ্যাটা আরও বেশি এবং স্থানাভাবে তাদের ৪০%-ই ঘুরছে সংরক্ষিত অরণ্যের বাইরে। জ়িনত ও বেলপাহাড়ির নতুন বাঘ, টি-২৪০২, ৩০০০ কিমি হেঁটে বিখ্যাত ওয়াকার, মৈপীঠে খাঁচাবন্দি হুলো বাঘা সবাই এই ৪০%-এরই উদাহরণ। এমন জায়গায় তাদের দর্শন মিলছে যেখানে তাদের উপস্থিতি কল্পনার বাইরে। রাজস্থানের নতুন বিপদ ‘সর্ষেখেতের বাঘ’, দুধওয়ার জঙ্গল লাগোয়া উত্তরপ্রদেশের মানুষদের ভয়ের কারণ ‘আখখেতের বাঘ’, পশ্চিমবঙ্গের প্রাপ্তি রাঢ়বাংলার শার্দূল!
বাঘগুলি কোন পথ ধরে কোথায় যাচ্ছে, কোন জঙ্গলে বহু বছর পর বাঘের ঝলক মিলেছে, সব কিছুকেই ধরে সংরক্ষণের কাজ এগোতে হবে। যে জঙ্গলে যাচ্ছে বা যে জঙ্গল ছেড়ে আসছে, সেখানে বাঘের খাদ্য বাড়াতে হবে। দারিদ্র ও উন্নয়নকে সামাল দিয়েই রক্ষা করতে হবে বাঘ করিডর। তা হলে বন ছাড়তে বাধ্য হলেও বাঘ অন্য বনে যাবে, লোকালয়ে হানা কমবে। আর, স্থানীয় মানুষকে সংরক্ষণ-প্রকল্পে শরিক করতেই হবে। পুনঃসক্রিয় হওয়া বাঘ-করিডর বা যে জঙ্গলে বাঘ ফিরেছে সেই এলাকার মানুষ বাঘের ডেরার পাশে থাকতে অভ্যস্ত নন। বাস্তুতন্ত্র ও অর্থনীতিতে বাঘের গুরুত্ব, কেন পশু প্ররোচিত হয়, বাঘ-ভেল্কি, জঙ্গল-কানুনের প্রশিক্ষণ জরুরি। জঙ্গলজীবীদের প্রতি সহৃদয় মনোযোগ ও গবাদি পশু হারালে ক্ষতিপূরণের বন্দোবস্ত চাই।
কাজেই, রেললাইন পেরিয়ে পরিত্যক্ত বিমানঘাঁটি টপকে জ়িনতের তিন রাজ্য পরিক্রমণ ‘ব্রেকিং নিউজ়’ নয়, বড় খবর হল তার চলার পথে মানুষের রক্ত লেগে নেই, সে নিজেও অক্ষত। এই ঘটনায় ইঙ্গিত, বাঘ ও মানুষের সহাবস্থান কী ভাবে সম্ভব হতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের বনদফতরের তৎপরতা, সাবধানতা এবং মানুষের সহযোগিতায় এই সাফল্য এসেছে। কিন্তু, সব বাঘের ডোরা যেমন আলাদা, তেমন প্রতিটি বাঘের স্বভাবচরিত্রও আলাদা। বিজ্ঞানের আলো ফেলেও তাদের অতীত, বর্তমান বা ভবিষ্যতের আচরণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় না। দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ ও চেনা-অচেনা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে খানিকটা অনুমান করেন সংরক্ষণবিদরা। সেই সব অভিজ্ঞতা বলছে, শীতে বাঘের পরিযাণ প্রবণতা, আগ্রাসন বাড়ে। নেহাত ভাগ্যক্রমে এবং জ়িনতের মর্জিতেই বাঘ-মানুষ সংঘাত ঠেকানো গিয়েছে, বন থেকে বেরিয়ে পড়া অন্য বাঘগুলি এমন ‘সুশীল’ হবে কি না জানা নেই। ২০১৮-য় লালগড়ে মৃত বাঘের ইতিহাস তো বটেই, বাদাবনের আলোচনা পৃথক রেখে শুধু মূল ভূখণ্ডেরই অন্যত্র ‘বন-ছাড়া বাঘ’ (স্ট্রেয়িং) সম্পর্কে যত তথ্য রেকর্ড হচ্ছে, তা বহুলাংশেই ভয়প্রদ।
গত বছর বান্ধবগড়ের একটি বাঘ ঢুকেছিল কসেরু গ্রামের ভূতভৈরবীর ঝোপে। বাঘ বেরিয়েছে শুনে খেতের ধারে গ্রামবাসীরা ভিড় করেন। এক যুবক ঝোপের দিকে এগোয়, শুধু ভাল করে বাঘ দেখবে বলে। বাঘ তাকে মুহূর্তে ধরে নেয়। সে বাঁচলেও, রেহাই পাননি বিজয় সিংহ। উত্তরপ্রদেশের মিঠনপুর মৌজা থেকে বাঘের জঙ্গল প্রায় দু’-তিনশো কিমি। কোনও জীবিত ব্যক্তি গ্রামে বাঘ দেখেছেন বলে মনে করতে পারেননি। বছর দশেক আগে, যখন সবে প্রোজেক্ট টাইগারের জয়যাত্রার গুণগান শুরু, তখনই শীত-ভোরের অন্ধকারে গ্রামের মাঠে প্রাকৃতিক প্রয়োজনে গিয়ে ফেরেননি বিজয়। তাঁর রক্তমাখা হাড়গোড় উদ্ধারের আগে কুয়াশা ভেদ করে মিলেছিল বাঘের পায়ের ছাপ, কারণ পাশেই পড়ে ছিল তখনও তারস্বরে চলতে থাকা মোবাইল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy