Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪
প্রবন্ধ ৩

মানুষ তো রাষ্ট্র নয়

দেশ বললেই আমরা ভাবি সেনা, পুলিশ, কাঁটাতার। কেন? রাষ্ট্র বলেছে বলেই? লিখছেন শিলাদিত্য সেনইদের দিন অনেকটা রাত হয়ে গিয়েছিল ফিরতে। পার্ক সার্কাসের একটা মাল্টিপ্লেক্স থেকে বজরঙ্গি ভাইজান দেখে বেরিয়ে ট্যাক্সিচালককে যেই বলেছি সিআইটি রোড যাব, তিনি বললেন, ‘গলির মধ্যে ঢোকাবেন না কিন্তু, মহামেডান এরিয়া, কার-না-কার খপ্পরে পড়ে যাব।’ ইদের সময় এ অভিজ্ঞতা আমার প্রায়ই হয়।

শেষ আপডেট: ২২ জুলাই ২০১৫ ০০:০১
Share: Save:

ইদের দিন অনেকটা রাত হয়ে গিয়েছিল ফিরতে। পার্ক সার্কাসের একটা মাল্টিপ্লেক্স থেকে বজরঙ্গি ভাইজান দেখে বেরিয়ে ট্যাক্সিচালককে যেই বলেছি সিআইটি রোড যাব, তিনি বললেন, ‘গলির মধ্যে ঢোকাবেন না কিন্তু, মহামেডান এরিয়া, কার-না-কার খপ্পরে পড়ে যাব।’ ইদের সময় এ অভিজ্ঞতা আমার প্রায়ই হয়। যে আবাসনে থাকি, তার সামনে একটা বাজার গমগম করে ইদের চাঁদ দেখা পর্যন্ত, আর সেই বাজারের দিকে তাকিয়ে কোনও না কোনও হিন্দু প্রতিবেশী আমার কানে ফিস ফিস করেন, ‘দেখেছেন, প্রায় পাকিস্তান বানিয়ে ফেলল দেশটাকে!’

তো, সে দিন রাত দশটাতেও ঝলমল করছে মাল্টিপ্লেক্সটা, যেন সন্ধে নেমেছে সদ্য, সাদা ধবধবে পোশাকে সচ্ছল মুসলমানরা মেতে উঠছেন আনন্দে। হলের ভিতরেও দু’পাশেই দর্শকেরা কথা বলছিলেন ইংরেজি আর হিন্দিতে। যখন পবন, এক হনুমানভক্ত হিন্দু ভারতীয়, পাকিস্তানের ছোট্ট বোবা মেয়েটিকে তার বাবা-মা’র কাছে পৌঁছনোর জন্য লুকিয়ে পাকিস্তানে ঢুকে নানান কৌশলে প্রশাসনের চোখে ধুলো দিয়ে চলেছে, দর্শকরা তার সমর্থনে তখন সিটের হাতল চেপে রীতিমত উত্তেজিত। পবন যখন আক্রমণাত্মক, তাঁরাও যেন পারলে রুখে দাঁড়ান পাক সেনা-পুলিশ-প্রশাসনের বিরুদ্ধে। আবার সে যখন ধরা পড়ে মার খাচ্ছে, তাঁরা মুষড়ে পড়ছেন বটে, ফের সোৎসাহে সিধে হয়ে বসে দেখছেন তার ‘মিশন সাকসেসফুল’ হল কি না। সবশেষে যখন পাকিস্তানি আমজনতা নিজেদেরই সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, ভেঙে ফেলে সীমান্তের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, সারা হলের দর্শক দাঁড়িয়ে উঠে হাততালি দিতে থাকেন। দুর্ভাগ্য আমার, ইদের দিন সেই রাতের শো-তে আমার ওই ফিসফিস-করা হিন্দু সহনাগরিকদের খুঁজে থাকলে হয়তো তাঁদের, এমনকী তাঁদেরও, মালুম হত, রাষ্ট্র দিয়ে মানুষকে চেনাটা ভুল। অন্যায়। নির্বুদ্ধিতার প্রমাণ।

এই নির্বোধ ভ্রান্তি আমাদের গ্রাস করেছে। দেশ বললেই মগজে রাষ্ট্র জেগে ওঠে, জেগে ওঠে তার আইন, পুলিশ-প্রশাসন, কাঁটাতার। রাষ্ট্রই শিখিয়েছে, শিখিয়ে চলেছে, পাকিস্তান আমাদের পরম শত্রু, সুতরাং সে দেশের সংখ্যাগুরু এবং এ দেশের সংখ্যালঘু মুসলমানরা হিন্দুদের কাছে ‘ভিলেন’। আমরাও রাষ্ট্রের পরম অনুগত, বিশ্বাস করছি তাকে, তার শেখানো মন্ত্রেই বুঝে নিচ্ছি কে শত্রু, কে মিত্র। দেশের মাটি ও মানুষকে একাকার করে ফেলছি রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে। ফলে আমাদের রাষ্ট্র যখন প্রতিপক্ষ দমনের ‘যুক্তি’তে হিংসাত্মক ভূমিকা নিচ্ছে, যেটা অত্যন্ত বিপজ্জনক এবং ভয়ের, তা মেনে নেওয়ার বাধ্যতাও তৈরি হয়ে যাচ্ছে আমাদের মনে। বুঝতে ভুল হয় না, এই একই প্রক্রিয়া কাজ করছে সীমান্তের ও পারেও, সেখানেও রাষ্ট্র মানুষকে শেখাচ্ছে: সবার ওপরে রাষ্ট্র সত্য। আমরা, দু’দেশের রাষ্ট্র-অনুগত মানুষ খেয়ালই রাখছি না, প্রতিবেশীদের মনে মনে লড়িয়ে দিয়ে, লড়িয়ে রেখে, ফসল তুলছে রাষ্ট্রব্যবস্থা, ফসল তুলছে অস্ত্রব্যবসায়ী, ফসল তুলছে যুদ্ধপরিস্থিতির স্রষ্টারা, বিশ্বজোড়া যাদের ফাঁদ পাতা।

আসলে সমষ্টির মধ্যে ব্যক্তি আবার এক ধরনের আত্মপরিচয় লাভ করে। ফলে সমষ্টি যদি নিজেকে মিথ্যা পরিচয়ে ভোলায়, ব্যক্তিও তখন সেই মিথ্যা পরিচয়কেই আত্মপরিচয় বলে মনে করে। এ দেশেও স্বাধীনতার সময় থেকে সেই সমষ্টিবোধই হিন্দুত্বের রাজনীতি ও রাষ্ট্রশক্তিকে ক্রমাগত পুষ্ট করে চলেছে।

এই ভাবনাকেই চ্যালেঞ্জ করতে চেয়েছেন বজরঙ্গি ভাইজান-এর পরিচালক কবীর খান। তাঁর সাফ কথা: ‘জনসাধারণ আর রাষ্ট্রের মধ্যে তফাত করতেই হবে।’ এর আগেও তিনি এমন বিরুদ্ধ স্বর শুনিয়েছিলেন তাঁর জনপ্রিয় এক থা টাইগার ছবিতে। তাঁর ছবি চলে বলিউডের ধারাতেই, অনেক অ-সম্ভব, অনেক অ-বাস্তব, অনেক ফর্মুলা-বাঁধা স্বপ্নপূরণ তাতে। কিন্তু তার মধ্যে থেকেই অন্য এক অসম্ভবের রূপ ও কথা ফাঁদছেন তিনি।

আর তাই ভাবছিলাম, চেষ্টা করলে আমরাও পারি না? পাকিস্তানে গিয়ে পবনের মতো এক ধার্মিক হিন্দুর কী বন্ধুত্বই না হল চাঁদ নবাব-এর মতো মুসলমান সাংবাদিকের সঙ্গে। হবে না-ই বা কেন? মানুষ তো আর কাঁটাতারের বেড়া নয়!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE