মুসোলিনি। রবীন্দ্রচিত্রাবলি, বিশ্ব-ভারতী ও প্রতিক্ষণ।
তারিখটা ২১ নভেম্বর, ১৯৩০। পুত্র রথীন্দ্রনাথকে লিখছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর—‘Prof. Formichi এসেছিলেন। এখনো আমাদের উপরে তাঁর আন্তরিক টান আছে। আমার সঙ্গে দেখা হতেই তাঁর চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলুম ইটালি দিয়ে আমার যাওয়া চলবে কিনা। তিনি বললেন মুসোলিনিকে একখানা চিঠি লিখলেই সমস্ত জঞ্জাল সাফ হয়ে যায়। আমি তাঁকে বলেচি, চিঠি লিখব। চিঠিটা এইসঙ্গে পাঠাই। যদি দ্বিধার কারণ না থাকে পাঠিয়ে দিস। চিরকাল ইটালির সঙ্গে ঝগড়া জাগিয়ে রাখা ঠিক নয়। ঠিক জানিনে address-এ কিরকম করে লিখতে হয়। বোধ হচ্ছে এই রকম— Il Duce / Signor Mussolini.’
যে সময়ে রথীন্দ্রনাথকে এই চিঠি লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ, তখন তিনি নিউ ইয়র্কে। বিশ্বভারতীর জন্য অর্থসংগ্রহ তখন তাঁর বিদেশ সফরের একটা অন্যতম কারণ। ওই চিঠিতেই রথীন্দ্রনাথকে বলছেন রাশিয়ার কথা। লিখছেন, ‘তোরা রাশিয়ায় যদি আসতিস তাহলে বুঝতে পারতিস কাজ করবার ঢের আছে। কম টাকা হলেও চলে যদি বুদ্ধি থাকে ও উদ্যম থাকে, যদি নিজের উপর ভরসা থাকে।’ এই চিঠিতেই পুনশ্চের মতো করে লিখেছিলেন মুসোলিনির সঙ্গে পত্রবিনিময় করে ‘সমস্ত জঞ্জাল সাফ’ করার কথাটা।
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর বছরখানেক পরে রথীন্দ্রনাথকে লেখা চিঠিটি প্রথম সংকলিত হয় ‘চিঠিপত্র’-এর দ্বিতীয় খণ্ডে। আর সেই প্রথম সংস্করণ আজও হয়ে আছে একটা ধাঁধার মতো। আষাঢ় ১৩৪৯-এ প্রথম প্রকাশিত সেই চিঠিপত্র দুইয়ে মুসোলিনিকে লেখা চিঠিটি সংকলিত হয়, আবার হয়ওনি। শঙ্খ ঘোষ লিখেছেন সেই ধাঁধা-র গল্পটা, তাঁর ‘বইয়ের ঘর’-এ: ‘আমার বইয়ের ১০৯-১০ পৃষ্ঠায় যে-চিঠি ছাপা আছে, আর তার সঙ্গে ১০৬-০৯ পৃষ্ঠায় রথীন্দ্রনাথকে লেখা তাঁর যে কথাগুলি তা একেবারে ‘নেই’ হয়ে গেল, অথচ পৃষ্ঠাসংখ্যা রইল ঠিকঠাক? পরিষদের সে-বইও তো প্রথম সংস্করণের, কেননা ১৯৪২ সালের পরে তখনও পর্যন্ত (এবং আজও পর্যন্ত) সে-বইয়ের তো কোনো মুদ্রণই হয়নি আর! পরে খোঁজ নিয়ে দেখি, ঠিকই, কোনো কপিতেই পাচ্ছি না সেই চিঠি, এমনকী রবীন্দ্রভবনের কপিতেও না। তার মানে, বইটি ছাপা হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চয় কারও চোখে পড়ে যায় অনেকের কাছে অনভিপ্রেত ওই চিঠিখানা, পরিকল্পিতভাবেই পালটে ফেলা হয় তাকে, কেবল অগ্রিম-বাঁধিয়ে-ফেলা ইতস্তত কয়েকখানা বই হয়তো ছিটকে যায় এধার-ওধার...’।
তার পরে দীর্ঘ প্রায় সাত দশক দুর্লভ ছিল সে বই। পুনঃপ্রকাশিত হল যখন, তখনও বাদ পড়ে গিয়েছিল মুসোলিনিকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠিটি। ঐতিহাসিক সেই চিঠি, রবীন্দ্রনাথ ও ইটালির সর্বশক্তিমান ফাসিস্ত নায়ক ‘ইল দুচে’ বেনিতো মুসোলিনির সম্পর্ক ঘিরে যে বিতর্কের আখ্যান তৈরি হয়ে আছে রবীন্দ্রচর্চায়, তার পরিপ্রেক্ষিতেই বিতর্ক। ১৯২৫-এর শেষ দিকে মুসোলিনি ইতালীয় সাহিত্যের বিপুল সম্ভার-সহ অধ্যাপক জিওসেপ্পে তুচ্চি এবং ফর্মিকিকে বিশ্বভারতীতে অধ্যাপনার জন্য পাঠান। ১৯২৬ সালে রোমে মুসোলিনির সঙ্গে দেখা করে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন রবীন্দ্রনাথ। বিতর্কের সূত্রপাত সেখানেই। পরে রম্যাঁ রোলাঁ ফাসিস্ত মুসোলিনি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথকে সবিস্তার জানান। ফ্যাসিজ়মের বিরুদ্ধে অ্যান্ড্রুজ়কে লেখা রবীন্দ্রনাথের খোলা চিঠি প্রকাশিত হয় ‘ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান’ পত্রিকায়। তার পরে মুসোলিনির নিজস্ব পত্রিকা ‘পোপোলো দ’ইটালিয়া’ রবীন্দ্রনাথকে ‘তৈলাক্ত ও অসহ্য লোক’-এর মতো ব্যক্তিগত আক্রমণ করে। সম্পর্কের এই সমস্ত জঞ্জাল, জটিলতা সাফ করতে চেয়ে মুসোলিনিকে রবীন্দ্রনাথ চিঠি লিখেছিলেন,
Il Duce
Signor Mussolini
1172 Park Avenue
New York
Nov. 21, 1930
Your Excellency
It often comes to my memory how we were startled by the magnanimous token of your sympathy reaching us through my very dear friend Prof Formichi. The precious gift, the library of Italian literature, is a treasure to us highly prized by our institution and for which we are deeply grateful to Your Excellency.
I am also personally indebted to you for the lavish generosity you showed to me in your hospitality when I was your guest in Italy and I earnestly hope that the misunderstanding which has unfortunately caused a barrier between me and the great people you represent, the people for whom I have genuine love, will not remain permanent, and that this expression of my gratitude to you and your nation will be accepted. The politics of a country is its own; its culture belongs to all humanity. My mission is to acknowledge all that has eternal value in the self-expression of any country. Your Excellency has nobly offered to our institution in behalf of Italy the opportunity of a festival of spirit which will remain inexhaustible and ever claim our homage of a cordial admiration.
I am, Your Excellency,
Gratefully Yours...
Rabindranath Tagore
চিঠির কয়েকটা কথা খেয়াল করার মতো। কোনও দেশের রাজনীতি তার নিজস্ব, সংস্কৃতি সমগ্র মানবতার। সমস্ত বিতর্কের সম্ভাবনার পরোয়া না-করে মুসোলিনিকে লেখা চিঠিতে নিজের বিশ্বাস এমন করে জানাতে বোধহয় রবীন্দ্রনাথই পারেন। চিঠিটি পাঠানোও হয়েছিল।
খণ্ড খণ্ড করে রবীন্দ্রনাথকে যাঁরা দেখতে চান, নিজেদের ধারণার সমর্থন খুঁজে নিতে চান তাঁর কোনও বিচ্ছিন্ন মন্তব্যে, ওই চিঠির ব্যাখ্যা তাঁদের কাছে অন্য রকম হতেও পারে। হয়তো ওই চিঠির সাক্ষ্যেই কেউ প্রমাণ করে দিতে চাইবেন, ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য’-র কবি ফাসিস্ত-বন্ধু। আগাগোড়া, কালক্রম বজায় রেখে ওই আশি বছরের জীবনটিকে পড়তে পারলে হয়তো বাইরের সেই ভুল ভাঙবে। বিশেষ করে আরও বছর চারেক পরেই দেখা যাবে মুসোলিনির ব্যঙ্গচিত্র আঁকছেন রবীন্দ্রনাথ। তারও পরে বলবেন ‘সভ্যতার সংকট’। ঐতিহাসিক সেই চিঠি কোনও সংশয় না-রেখে তার যথাযথ স্থানে সম্প্রতি প্রকাশিত হল চিঠিপত্র দুইয়ে।
লেখক বিশ্বভারতীর গ্রন্থন বিভাগের প্রকাশনা উপ-পরিচালক (উদ্ধৃতি ও বানান অপরিবর্তিত), মতামত নিজস্ব
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy